“ছোটোবেলা থেকে অনেক লড়াই করেছি পড়াশোনা নিয়ে। বড়ো ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়ার সুযোগ হয়নি। সেরকম অবস্থাও ছিল না। সেইজন্য আমি চেষ্টা করি যাতে ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা পড়াশোনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। তারা যাতে নিজেদের পছন্দমতো কেরিয়ারের রাস্তা খুঁজে পায়, সেই চেষ্টাও করি আমি।”
কথাপ্রসঙ্গে প্রহরকে বলছিলেন পূজা মাহাতো। বলছিলেন নিজের লড়াইয়ের কথা, স্বপ্নের কথা। কিন্তু সেটা বলতে বলতে এক মুহূর্তের জন্য ভুলে যেতে হয় তাঁর বয়স। এখনও কলেজ পেরোননি পূজা; গলায় লেগে আছে একুশের সেই দুরন্ত সাহস। এমন অনেক ছেলেমেয়েই বেঁচে আছে আমাদের চারপাশে, যারা স্রেফ অবস্থার কারণে বা টাকার জন্য পড়াশোনা করতে পারছে না। নিজের সবটুকু দিয়ে তাদের পাশেই এগিয়ে এসেছেন ২১-এর পূজা। নিজেও যে এই অবস্থার মধ্যে দিয়ে গেছেন একসময়…
আরও পড়ুন
গোটা দেশে, এমনকি কলকাতায় আজো প্রকাশ্যে বিকোচ্ছে অ্যাসিড, লড়াই থামেনি, বলছেন লক্ষ্মী আগরওয়াল
ছোটবেলা থেকে আজ অবধি, মা-ই সব। বাবা’র কথা মনে পড়ে না সেভাবে। পূজা যখন খুব ছোটো, তখনই স্ত্রী আর মেয়েকে ফেলে রেখে বাড়ি ছাড়েন বাবা। সংসার, অর্থ, মেয়ের ভবিষ্যৎ- সমস্ত কিছু নিয়ে অথৈ জলে পড়েন মা। বারুইপুর হাসপাতালের সামান্য সাফাই কর্মী তিনি। এই অবস্থায় কী করে মেয়ের পড়াশোনা এগোবে? এই সময়ই খোঁজ মিলল বাঁকড়াহাটের ‘সাবেরা ফাউন্ডেশন’-এর। থাকা, খাওয়া, পড়াশোনা— সমস্ত কিছুই ওখানের হোস্টেলে বিনামূল্যে। মেয়ে পড়তেও পারবে, অন্যদিকে দু’বেলা খাবারও জুটবে। ওখানেই জায়গা পেলেন পূজা। বয়স তখন মাত্র তিন…
সেখান থেকেই পড়াশোনা শুরু। বলা ভালো, স্বপ্ন দেখারও শুরু। তাঁর মতো আরও ১০০ জন বাচ্চার সঙ্গে বেড়ে উঠছিলেন তিনি। একসময় এসে দাঁড়ালেন মাধ্যমিকের চৌকাঠে। সময়টা ২০১৪। ততদিনে স্বপ্ন আরও বড়ো হয়েছে। টিভি, মিডিয়ার প্রতি আকর্ষণও তৈরি হচ্ছিল। সেই সময়ই ঘটে গেল আরেকটা দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনা; নাকি জীবনের মোড় ঘুরে যাওয়ার প্রস্তুতির শুরুয়াৎ?
আরও পড়ুন
স্বনির্ভরতাই যথেষ্ট নয়, উদ্যোগপতি হয়ে উঠুক গ্রামের মেয়েরা – অন্যরকম লড়াই শিবানীর
যে হোস্টেলে থাকতেন পূজা, তার কর্তৃপক্ষ হঠাৎ ঘোষণা করলেন যে, কিছু কারণের জন্য আর সুযোগ সুবিধা দেওয়া হবে না। পরীক্ষার খরচও দেওয়া হবে না। একটা নিশ্চিত আশ্রয় চলে গেল আবার! এদিকে সামনেই জীবনের সবচেয়ে বড়ো পরীক্ষা। কী করে দেবেন তিনি? এই অবস্থায় পড়লে আমরা অনেকেই হয়তো খেই হারিয়ে ফেলতাম। ওই ঝড়ের মধ্যেও, নিজের নৌকাটি ঠিক রাখলেন পূজা। “আমাদের হোস্টেলে অনেক বিদেশি সাহায্য করত, অনুদান দিত। সেরকম একজনের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল। অ্যালফান্সো। নিউ ইয়র্কের বাসিন্দা। কলকাতার ‘গার্ল টু বি’ এনজিও’র প্রতিষ্ঠাতা। তিনিই আমাকে সাহায্য করলেন। তারপরই পরীক্ষা দিলাম। উচ্চমাধ্যমিকও এই করেই। তারপর, গোখেল মেমোরিয়াল গার্লস কলেজে কমিউনিকেটিভ ইংরেজি নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি। সেখানেও উনিই আমার কলেজের ফি, থাকার খরচ দেন।”
কলেজে তখন ফার্স্ট ইয়ার। আচমকাই একটা সুযোগ এসে যায়। হোপ কলকাতা ফাউন্ডেশনের সূত্রে একটা ফুল টাইম স্কলারশিপ পান। গন্তব্য, আমেরিকা! স্বপ্নের যাত্রা শুরু হল পূজা’র। ২০১৭ সালে আকাশ ছুঁয়ে মার্কিন মুলুকে পা বাড়ালেন তিনি। সাংবাদিকতা ও মিডিয়া নিয়ে পড়ার ইচ্ছার প্রথম ধাপে পৌঁছলেন তিনি। টিভি রিপোর্টিং নিয়ে ইন্টার্নশিপ, ভলান্টিয়ার ইত্যাদি নানা কাজ করেছিলেন সেখানে। বেস্ট প্রোগ্রাম ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডরের পুরস্কারও পেয়েছিলেন ওই কাজের জন্য। মার্কিন মুলুকে কাটানো সেই দশটি মাস জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত, মানেন পূজাও।
আরও পড়ুন
ধর্মের ভিতর থেকে গোঁড়ামির বিরোধিতা, শাহিনা জাভেদ এক অন্যস্বরের নাম
২০১৮-তে দেশে ফিরে আবারও গোখেলে শুরু করেন পড়াশোনা। পরে আমেরিকান সেন্টারের সূত্রে বিভিন্ন ওয়ার্কশপে অংশ নেন। যোগ দেন দিল্লির একটি এনজিও ‘প্রভা’র লিডারশিপ স্কিলের ওয়ার্কশপে। সেই সঙ্গে শুরু হয় নিজের কাজ। লক্ষ্য, যে বাচ্চারা নানা কারণে পড়তে পারে না তাদের পড়াশোনার দিকে নিয়ে যাওয়া এবং সঠিক দিশা দেখানো। ‘প্রভা’র ওয়ার্কশপেই তুলে ধরেন নিজের বিশেষ ভাবনার- কেরিয়ার কাউন্সেলিং। যার যেদিকে ইচ্ছা, যেদিকে দক্ষতা, তাকে সেই সংক্রান্ত বিভিন্ন রাস্তা দেখানোই ছিল এর উদ্দেশ্য। শুধুমাত্র থিয়োরির পাতাতেই নয়, রাস্তায় নেমেও এই কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন তিনি। এই জানুয়ারিতেই তিনটে এনজিও’র ৪৫ জন বাচ্চাদের নিয়ে কেরিয়ার কাউন্সেলিংয়ের আয়োজন করেন পূজা। আর তাঁর বয়স? মাত্র ২১। এখনও গ্র্যাজুয়েশনও শেষ হয়নি…
ছোটোবেলা থেকে তিনি লড়াই করে এসেছেন প্রতিটা মুহূর্তে। বাড়ির অবস্থা কখনই অনুকূল ছিল না। মা’র পাশে দাঁড়ানোর জন্য এখনও চেষ্টা করে যাচ্ছেন পূজা মাহাতো। নিজের পড়াশোনা, সামাজিক কাজ, সেসব তো আছেই; সেই সঙ্গে চলছে ইন্টার্নশিপ ও চাকরির চেষ্টা। কলকাতার একটি জনপ্রিয় রেডিও স্টেশনেও পুজোর সময় কাজ করেছিলেন তিনি। স্বপ্ন এখন ইংরেজি খবরের চ্যানেলে খবর পরিবেশকের কাজ করা। আর অদূর ভবিষ্যতে? খানিক লজ্জা পেয়ে বললেন, “নিউ ইয়র্ক টাইমসের এডিটর।”
আরও পড়ুন
মুখ পুড়ে গেলেও পোড়েনি মন, আজও লড়াই থামেনি বাংলার অ্যাসিড আক্রান্তদের
২০১৪-এর পর গত তিন-চার বছরে জীবন তো অনেকটাই বদলেছে। অনেক কাজের সঙ্গে আজ জড়িয়ে পূজা। আজ এখানে দাঁড়িয়ে মা কী বলেন? চুপ করে থাকলেন খানিক। বোধহয় ফিরে ফিরে আসছিল ওই সময়গুলোর কথা। “একটা সময় মা বলত, যদি ছেলে থাকত তাহলে কিছু না কিছু রোজগার হত সংসারে। আজ মা খুবই গর্বিত। সবার কাছ থেকে শোনেন আমার কথা। খুশিই হন। তবে এখনও বারুইপুরের হাসপাতালে কাজ করেন তিনি। মা’র পাশে দাঁড়াতে কলেজ, এনজিও’র কাজ সামলে বাড়িতে শুরু করেছেন টিউশন। আজও বারুইপুরের সেই বাড়িতেই থাকি আমরা।”
এভাবেই সংসারের নদী এগিয়ে চলে। তাতে ভাসতে থাকে মা-মেয়ের নৌকা। আজ পূজা’র নামের সঙ্গে যতই আমেরিকা লেগে থাকুক, এখনও বারুইপুরের সেই লড়াকু মেয়েটিই রয়ে গেছেন। সেই সঙ্গে দেখছেন আরও অনেক বাচ্চাদের। মাত্র ২১ বছরেই এতগুলো স্বপ্নের মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু এখনও ফুরিয়ে যায়নি সবটা। কাজেই, হাল ছেড়ো না বন্ধু…