মুখ পুড়ে গেলেও পোড়েনি মন, আজও লড়াই থামেনি বাংলার অ্যাসিড আক্রান্তদের

‘ছপাক’ সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছে গত সপ্তাহেই। দীপিকা পাড়ুকোন অভিনীত ‘মালতী’ চরিত্রটির মূলে যে লক্ষ্মী আগরওয়াল, সে কথা আপামর ভারতবাসী জানেন। কদিন আগেই নিজের একটি ফাউন্ডেশনের কথা ঘোষণা করলেন তিনি। ‘ছপাক’-এর পর নতুন করে আবার দেশ জুড়ে অ্যাসিড আক্রান্তদের নিয়ে কথা বলা শুরু হয়েছে।

এরই মধ্যে ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর একটি পরিসংখ্যান উঠে এসেছে। যে পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতের অন্যান্য মেট্রোপলিটন শহরের তুলনায় কলকাতা অনেক বেশি নিরাপদ। একইসঙ্গে অন্য একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের যে তিনটি শহরে এখনও অ্যাসিড আক্রমণের ঘটনা ঘটে, তার মধ্যে কলকাতা অন্যতম। ২০১৮ সালে খোদ মহানগরীতেই ঘটেছে তিনটি অ্যাসিড আক্রমণের ঘটনা।

কয়েকদিন আগেই লক্ষ্মী আগরওয়াল প্রহরকে জানিয়েছিলেন, এখনও কলকাতার খোলা বাজারে অ্যাসিড বিক্রি হয়। অথচ সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী, লাইসেন্স ছাড়া অ্যাসিড বিক্রি করা যাবে না। এমন অবস্থায়, প্রহর কথা বলল কলকাতা এবং বাংলার কয়েকজন অ্যাসিড-আক্রান্ত নারীদের সঙ্গে। বোতল থেকে ছিটকে আসা অ্যাসিড তাঁদের গোটা জীবনটাই বদলে দিয়েছে। তবু তাঁরা লড়ছেন, ঘুরেও দাঁড়াচ্ছেন। সেই কথাই শুনলাম আমরা।

১। মনীষা পৈলান

দিনটা ছিল ১৭ নভেম্বর, ২০১৫। তখন ২১ বছর বয়স আমার। অফিস সেরে জয়নগরে নিজের বাড়ি ফিরছিলাম। বাড়ির কাছে আসতেই হঠাৎ মনে হল মুখে কেউ আগুন দিয়েছে। সারা মুখটা জ্বলতে লাগল। বুঝলাম, অ্যাসিড ছোঁড়া হয়েছে। ততক্ষণে আমিও দেখতে পাই ছেলেটাকে। আমাদের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক ছিল ওদের। অনেকদিন ধরেই উত্যক্ত করত। নিজের ‘ভালবাসা’ প্রমাণ করতে চাইত, বিয়ে করতে চাইত। কিন্তু আমার সেই ইচ্ছা ছিল না। সেখান থেকেই, এই আক্রমণ। ওর যাবতীয় কাজ সমর্থন করত গ্রামের বাকিরা। সেদিনও বোঝাতে পারিনি তাঁদের, আজও না। আজও ছেলেটা আমার সামনে ঘুরে বেড়ায়। এখন বিয়েও করেছে, কাজও পেয়েছে। কিন্তু সেই ঘটনার আজও বিচার হয়নি। কেস চলছে এখনও। আজ আমার দুটো চোখই ক্ষতিগ্রস্ত, একটি চোখে খানিক দেখতে পাই। চিকিৎসা চলছে এখনও। তাও আমি আশা রাখছি। নিজেরা সংগঠন বানানোর চেষ্টা করছি। পরিবার সবসময় পাশে থেকেছে আমার। আর এটাই সবচেয়ে জরুরি অ্যাসিড আক্রান্ত মেয়েদের ক্ষেত্রে। পরিবার পাশে থাকলে ভরসা, সাহস পাওয়া যায়। এরপর আমি কলকাতায় এসে পড়াশোনা করি আবার। একটা নতুন জগত দেখতে পাই। লড়াইয়ের সাহস পাই। ‘ছপাক’ দেখে হয়ত সমাজের একটা অংশের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হবে। কিন্তু সার্বিকভাবে আন্দোলনটাও জরুরি। খোলা বাজারে বেআইনি অ্যাসিড বিক্রি বন্ধ করতে কড়া আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে। দোকানদারও অনেক সময় ওয়াকিবহাল থাকেন না এর সম্পর্কে। তাঁদের সতর্ক করা হোক। সিনেমা অবশ্যই একটা আওয়াজ তুলবে, তার সঙ্গে এই জিনিসগুলোও তো দরকার। আর আমাদের লড়াইটা এই নিয়েই। কিছু অন্তত হোক, আর হবেই।

২। সঞ্চয়িতা যাদব

আজ থেকে পাঁচ বছর আগের কথা। তখন একটা জায়গায় কম্পিউটারে বসে বিল করতাম। সেটাই কাজ ছিল। একজনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সেটা আর রাখতে চাইনি। সেই জন্যই ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমার ওপর অ্যাসিড ছোঁড়া হয়, দমদমে। আজ হিউম্যান রাইটসের সঙ্গে যুক্ত, কাজও করছি। কিন্তু এই পথটা খুবই কঠিন ছিল। আমার ডান চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। রাস্তাঘাটে বেরোলে, বিশেষ করে মেয়েদের থেকেই এটা সেটা শুনতে হত। বাসে-মেট্রোয় টিটকিরি শুনতে হত। বাচ্চারাও ভয় পেত, তাদের অভিবাবকরাও সরিয়ে নিয়ে যেত। বাচ্চাদের বলত, আমি নাকি ধরে নিয়ে যাব। পরে আরও অ্যাসিড আক্রান্ত মেয়েদের সঙ্গে দেখা হয় কাজের সূত্রে। আজ পরিস্থিতি একটু বদলালেও, অ্যাসিড ছোঁড়া বন্ধ হয়নি। অ্যাসিড বিক্রিও বন্ধ হয়নি। ‘ছপাক’ তো একটা সিনেমা, আমি তো সেই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গিয়েছি। ওই গল্পটা তো আমারই গল্প, আমাদেরই গল্প। মানুষের মন থেকে অ্যাসিড না দূর হলে কিছু হবে না। সেই সঙ্গে দরকার আক্রান্ত মেয়েদের পাশে দাঁড়ানো।

৩। মনিকা মণ্ডল

ঘটনাটা ঘটেছিল নুঙ্গিতে, ওখানেই আমার বাপের বাড়ি। তখন আমি প্রেগন্যান্ট ছিলাম। যেহেতু প্রথম বাচ্চা, তাই বড়দা আমায় বাড়ি নিয়ে এল সাধের জন্য। সঙ্গে ছিল অনেক গয়না। তখন নতুন ঘর হচ্ছিল। সেই সময় আমাদের এক প্রতিবেশী সেসব দেখেছে। পরে সে চুরি করে সেই গয়নাগাটি। আমি বাড়িতে বলি থানায় যাওয়ার জন্য। তখনই হুমকি আসতে থাকে। আমি গ্রাহ্য করতাম না। ২০১৬-এর মার্চে বাপের বাড়িতে পুজো দেওয়ার জন্য আসি। তখনই সেই লোকটি অ্যাসিড ছোঁড়ে আমায়। মুখের বদলে পিঠে, হাতে এসে পড়ে সেই অ্যাসিড। চিকিৎসা চলছে এখনও। তবে সমস্ত প্রতিবেশী, পরিবার আমার সঙ্গে ছিল। সবাই সহযোগিতা করেছে। তবে শ্বশুরবাড়ির কেউ জানে না। আমি এখনও ‘ছপাক’ দেখিনি। তবে এই অ্যাসিড বিক্রি বন্ধ হোক। সেই সঙ্গে সরকারও আমাদের পাশে থাকুক। ওই মানুষগুলো আর যাতে কিছু না করতে পারে, সেটারই ব্যবস্থা করা হোক।

৪। ঝুমা সাঁতরা

রিষড়ায় বাড়ির পাশেই থাকত ছেলেটি। আমায় প্রপোজ করেছিল। কিন্তু আমি সাড়া দিইনি, এড়িয়ে চলতাম। তাতেই আমায় অ্যাসিড ছোঁড়ে ছেলেটা, ২০১৪ সালে। আমার সমস্ত মুখ পুড়ে যায়। চোখ নষ্ট হয়ে যায় একদম। কিন্তু আমার আশেপাশের লোকেরা কেউ কোনও সাহায্য করেনি। এমনকি, যখন অ্যাসিড পড়ল, আমি চিৎকার করছিলাম। তখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্যও কেউ এগিয়ে আসেনি। কেউ ধরেওনি। আমার ছেলের মাস্টার আর পাড়ার অন্য একটা ছেলেই ছিল শুধু। অ্যাসিড আক্রান্ত হওয়ার পরই আমাদের ঘরবন্দি করে রাখা হয়। বাঁকা চোখে দেখা হয়। এটা কেন? আমরা তো অপরাধ করিনি। কোনদিন ওড়নায় মুখ জড়িয়ে বেরোইনি। আমি ভয় পাব কেন? নিজের মনে সবসময় সেই জোর রাখি। লড়াই করেই বাঁচব আমরা। শুধু একটা সিনেমা কীভাবে ওই লোকগুলোর মন বদলাবে! সমাজই যদি না বদলায়!

৫। সুনীতি কর্মকার

অনেক ছোট বয়সে বিয়ে হয় আমার। কিন্তু পরে জানতে পারি, যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে, তাঁর অন্য কারোর সঙ্গে সম্পর্ক আছে। সেটা মেনে নিতে পারিনি। প্রতিবাদ করেছিলাম। সেজন্য ঘুমন্ত অবস্থায় আমার মুখে অ্যাসিড ছোঁড়া হল। তখন ২০১১। থাকতাম সোদপুর-লাগোয়া নাটাগড়ের রেল কলোনিতে। আজও সেই মানুষটা শাস্তি পায়নি। জামিনে ছাড়া পেয়েছে। তারপর চারপাশ থেকে একটা অবজ্ঞার ভাব আসত। লোকজন ভয় পেত। আমার বোনরাও কাছে আসত না। পরে অবশ্য মেনে নেয় বাড়ির লোকেরা, পাশে দাঁড়ায়। এখন তো কিছু আর করার নেই। মেনে নিয়েছি এই অবস্থা। লড়াই তো চলছেই। তবে সিনেমা দেখে মানুষ হয়ত দু’ফোঁটা চোখের জল ফেলবে। তারপর আর মনে রাখবে কি? মানুষকে তো বদলাতে পারছি না আমরা।

৬। পম্পা দাস প্রামাণিক

২৩ বছর বয়স ছিল আমার। বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। তখনই জানতে পারি, আমার স্বামীর অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক আছে। একদিন সমস্তটা জানাজানি হয়ে যায়। আমার বাপের বাড়ির লোকেরাও জেনে ফেলে। ২০১৭ সালে ভাইফোঁটার পরের দিন শ্বশুরবাড়ির সবাই মিলে ঘরে আটকে রাখে আমায়। তারপর আমার মুখে অ্যাসিড ঢেলে দেয়। ওই অবস্থাতেই আমাকে ফেলে চলে গিয়েছিল। গ্রামের লোকেরা এসে আমায় হাসপাতালে নিয়ে যায়। এখনও অপারেশন চলছে আমার। মুখের বাঁ দিকের অনেকটাই পুড়ে গেছে। বাঁ চোখটা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। গলায় বেল্ট পরে আছি। এখন কাকদ্বীপেই বাপের বাড়িতে থাকি। এখানেই কেস চলছে। আমাদের এই কষ্টটা, এই যন্ত্রণাটা যে পর্দায় তুলে ধরা হয়েছে, এই জন্য অবশ্যই একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য দীপিকাদের।

৭। সাহানারা খাতুন শেখ

জমিজমা নিয়ে পরিবারে বিবাদ চলছিল। প্রতিদিন অশান্তি হত। সেটা ছিল ২০০৯ সাল, ২১ এপ্রিল। পলাশিতে নিজের বাড়িতেই রাতে জানলাটা খুলে শুয়েছিলাম। জমি নিয়ে রাগ থেকেই আমার কাকা আর পিসেমশাই আমায় তখন অ্যাসিড ছোঁড়ে। তারপর মা-কে ধাক্কা মেরে পালিয়ে যায়। এখন অবশ্য তাঁরা ধরা পড়েছে, যাবজ্জীবন সাজাও পেয়েছে। তবে প্রথম দিকে আত্মীয়, পাড়া প্রতিবেশীরা একটু দূরে দূরেই রাখত। ভয় পেত। কোথাও বেড়াতাম না, বাড়িতেই থাকতাম একা একা। তবে আগের থেকে এখন সচেতনতা বাড়ছে। সিনেমাটা হওয়ার পর আরও বাড়বে হয়তো। কিন্তু অ্যাসিড বিক্রি তো বন্ধ করতে হবে। এরকম ক্ষতি যেন আর কারোর না হয়, সেটাই আমরা চাই।

৮। পলি দেবনাথ

বিহার-ঝাড়খণ্ডে লোকের বাড়িতে কাজ করে রোজগার করতাম। সেখানেই একটি ছেলে আমায় কুপ্রস্তাব দিত। বলত ওর সঙ্গে থাকতে। রাজি না হওয়ায় অ্যাসিড মারার হুমকি দিত; কিন্তু সুযোগ পেত না। ২০১৪ সালের ১৮ জুন সুযোগ পেয়ে কাজে যাওয়ার সময় স্টেশনে আমাকে অ্যাসিড ছোঁড়ে। সে অবশ্য ধরা পড়েনি আজও। পুলিশ কোনো চেষ্টাই করেনি। আমি এখনও মুখ লুকিয়ে রাখি মাঝে মধ্যে। লোকে দেখলে ভয় পায়, বাচ্চারা কাঁদে। একটা চোখে দেখতেই পাই না। স্বামীও থাকে না আমার সঙ্গে। শুধু আছে একমাত্র সন্তান। আমাকে অনেকেই পছন্দ করে না। মনটা তো আমার একই আছে, মুখটা তো পুড়েছে। যে অন্যায় করেছে তাকে তো কেউ কিছু বলছে না! এটার কি বদল হবে আর? আমার পরেও তো এই ঘটনা ঘটেছে অনেকের সঙ্গে। থামেনি তো। সমাজ, পুলিশ-প্রশাসন যদি এই দোষীদের শাস্তি দেয়, তাহলে কিছু বদল হবে। কিন্তু শাস্তি তো পায় না।

বিশেষ কৃতজ্ঞতা – অপরাজিতা বসু, বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায়