বাতাস আমাদের বয়ে নিয়ে যাবে (দ্বিতীয় পর্ব)

দি উইন্ড উইল ক্যারি আস
আব্বাস কিয়ারোস্তামি
ইরান, ১৯৯৯    

সাংবাদিক একটি গ্রাম্য চায়ের দোকানে এসে বসেছে। সে দোকান থেকে ক্যামেরাটা ফেরত পেয়েছে।

এক মহিলা সেখানে চা পরিবেশন করছেন দেখে সে বলে - মহিলারা দোকানে চা দিচ্ছেন, এমন দেখিনি তো?
এই মহিলা তর্ক করেন, কেন, তোমার বাড়িতে কে পরিবেশন করেন? তোমার বাবাকে কে খেতে দেন?
সাংবাদিক থতমত খেয়ে বলেঃ মা!
মহিলা তর্কে জিতে যান।
আব্বাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন পুংতন্ত্রের নাগরিক ও অন্তরালবর্তী রাজনীতি। আমরা মহিলাদের দোকানে পরিবেশনরত হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত নই, অথচ বাড়িতে সহজে তাদের পরিবেশনে খাবার খেয়ে থাকি।
ছবির এই সূক্ষ্ম ভাঁজটি লিঙ্গ-রাজনীতির এক বিশ্লেষণ হয়ে দাঁড়ায়।

আরও পড়ুন
বাতাস আমাদের বয়ে নিয়ে যাবে (প্রথম পর্ব)

এবারে মহিলা ক্লান্তির কথা বললে এক কৃষক প্রৌঢ় প্রতিবাদ করেন। তিনি যেহেতু রোদে পুড়ে চাষ করেন, ক্লান্তি যেন একমাত্র তারই হতে পারে।
আবার পুরুষতন্ত্রের স্বর কথা বলতে থাকে।
প্রথম বার সূক্ষ্ম ভাবে তা কথা বলে সাংবাদিকের মুখে, নাগরিক উচ্চারণে।
দ্বিতীয়বার গ্রাম্য কৃষকের মুখে, প্রত্যন্ত উচ্চারণে।
পুরুষতন্ত্রের মুখটি সর্বদা, সর্বস্থলে এক - আব্বাস বুঝিয়ে দেন।

আরও পড়ুন
শেষ পঞ্চাশ দ্বিতীয় পর্ব : কল্পজগতের গুপ্তধন

সাংবাদিক ছবি তুলতে গেলে মহিলা সংস্কার বশত প্রতিবাদ করেন - ছবি তুলো না।
এই গ্রামে একটি সংস্কার আছে ছবি তোলা নিয়ে, আমরা জানলাম।
সাংবাদিক গ্রাম্য সংস্কারের বিরোধী, 'গর্হিত' কাজের প্রকল্প নিয়েই এসেছে।
অতি বৃদ্ধার বৃদ্ধ ছেলেকে অনুসরণ করে সাংবাদিক পৌঁছে যায় সেই উঁচু জায়গায় - যেখান থেকে জানলাটি দেখা যাচ্ছে।

আরও পড়ুন
‘শেষ পঞ্চাশ’ প্রথম পর্ব: দ্বাদশ ব্যক্তি

বৃদ্ধার ছেলে নিচে বসে আছেন, তাঁকে খাবার দেওয়া হচ্ছে।
বৃদ্ধার অবস্থার উন্নতি ঘটেনি, আমরা সংলাপ মারফত জানতে পারি।
এবারেও রিল টাইম আর রিয়েল টাইম এক।
এই টেনশন অতএব সাংবাদিকের এবং আমাদেরও।

আরও পড়ুন
দ্বাদশ ব্যক্তি

সাংবাদিক বসের ফোনের কানেকশন না পেয়ে উঁচু জায়গার উদ্দেশে ছুটছে, তার এই ছোটাতে সন্ত্রস্ত যেন গ্রামের নিস্তরঙ্গ জীবন, পশু পাখিগুলি চিৎকার শুরু করেছে।
গ্রামের মধ্যে নাগরিক দ্রুতির অবতারণা।

আরও পড়ুন
জলপাইশাখার মধ্যে দিয়ে যেতে (দ্বিতীয় পর্ব)

সাংবাদিক গাড়ি নিয়ে যাচ্ছে উঁচু জায়গার সন্ধানে।

এখানে আমরা দেখছি, উঁচু জায়গায় এসে গাড়িটি থেমেছে।

আরও পড়ুন
জলপাইশাখার মধ্যে দিয়ে যেতে

নেক্সট শট, গাড়ির দরজা খুলে সাংবাদিক নামছে। অর্থাৎ, দুটি শট আলাদা/বিপরীত দুটি পাশ থেকে তোলা হয়েছে।
আব্বাস এই পদ্ধতি প্রয়োগ করেছেন আগের ছবিতেও (যেমন ধরা যাক ‘টেস্ট অব চেরি’)।
সেখানে টু শট নেই কথা বার্তার সময়, একবার কথকের মুখ, একবার শ্রোতার মুখ- সুতরাং বাস্তবতার দুটি ভিন্ন পাশ - এই ভাবে চলেছে শট।
বাস্তবের একটি পাশ, নয়তো অপর পাশ - এই দেখতে পারি আমরা। ছবির ভাষাতে তার আভাস পাচ্ছি।
শট কাটার দ্বারা আসলে পরিপ্রেক্ষিত বোঝানো হচ্ছে।

আরও পড়ুন
সিনেমার গোটা দলকে রেঁধে খাওয়াতেন বৃদ্ধা, সমস্ত সঞ্চয় তুলে দিল কিশোরী: আড়ংঘাটার রূপকথা

আমরা দেখতে পাচ্ছি, সাংবাদিক উঁচু জায়গা খুঁজতে যেখানে এসেছে, সেটি আসলে একটি সমাধিভূমি।
আব্বাস মৃত্যুর সিম্বল প্রয়োগ করে যাবেন এভাবেই, একের পর এক।

সাংবাদিক একটি গর্তের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।
গর্তের ভেতরে  কূপ খননরত ব্যক্তির সাথে তার কথোপকথন চলবে।

গর্তটি ছবিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বারবার ফিরে আসবে এই জায়গাটা।
খননকারী লোকটি গর্তের মধ্যে আছে, তাকে আমরা দেখতে পাব না।
আমরা বুঝতে পারছি, এই ছবির অনুসন্ধানের একটি প্রধান বিষয় হল, বাস্তবতা সংক্রান্ত অনুসন্ধান। এই চেনা বাস্তবের আসল রূপটি কী?
এবং, এই বাস্তবতার ওপারে কি আছে?
প্রথম প্রশ্নের জবাব খুঁজতে চেয়ে ছবিটি কিউবিস্ট ধরণে একই বাস্তবের বহু পরিপ্রেক্ষিত নির্বাচন করছে, বাস্তবের প্রায় সব কটি তল দেখাতে চাইছে। ছবি হয়ে উঠছে বাস্তবতা ও দৃষ্টি সংক্রান্ত প্রবন্ধ। যেমন,  পিকাসো বা ব্রাকের চিত্র।
দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব খুঁজতে চেয়ে ছবিটি স্বেচ্ছায় বাস্তবের কিছু কিছু অংশ বা কিছু কিছু বাস্তব-কে দেখানো পরিহার করেছে।

যেমন, ছবিতে সাংবাদিকের তিন বন্ধুকে আমরা দেখতে পাচ্ছি না। এবং দেখতে পাবোও না।
যেমন, এই গর্তের লোকটিকে আমরা দেখতে পাচ্ছি না। গোটা ছবি জুড়ে একবারও এই লোকটিকে আমরা দেখব না, শুধু একবার, শেষের দিকে তার আহত পায়ের পাতার একটি তল দেখতে পাব।

আরও পড়ুন
একটা গোটা গ্রামই প্রযোজক, ছকভাঙা এক সিনেমার গড়ে ওঠার ‘সত্যি রূপকথা’

সাংবাদিক গর্তের মানুষটিকে বলে - তোমার গর্তের ঐ জিনিসটি ছুঁড়ে দাও তো।
বস্তুটি ছোঁড়া হয় নিচু থেকে, একটি হাড়, আমরা দেখতে পাই। এক পুরুষের পায়ের হাড়। আমরা বুঝি, এই গর্তে তার কবর ছিল।
সাংবাদিকের হাতে দুটি জিনিস আমরা দেখছি - টেলিফোন আর মানবঅস্থি। একটি প্রযুক্তির, মানবনির্মিত, একটি প্রাকৃতিক, প্রকৃতি সৃজিত।
আবারও আব্বাস মৃত্যুর সিম্বল প্রয়োগ করেন- হাড়ের অবতারণা।
হাড়টি মৃত মানুষের একমাত্র স্মৃতিচিহ্ন।
এই হাড়ের মধ্যে গোটা মানুষটির জীবন ও সুতরাং বাস্তবতা ঘনীভূত হয়ে আছে।
কিন্তু মানুষটি মৃত - আমাদের সংস্কার মেনে সে এখন বাস্তবতার ওপারে।
বাস্তবতার ওপার কি আছে? মৃত্যুতেই কি সব শেষ নয়?
এর উপস্থিতির প্রমাণ/ অপ্রমাণ আমরা  জানতে পারব না কারণ কোনো মৃত ঐ 'ওপার' থেকে ফিরে এসে বলেনি, ওপারে কী আছে।
এই ওপারকে সম্ভ্রম জানাতেই সমাধিস্থলগুলি আছে।
এগুলি ওপারের সোপান।
এই গর্তের মানুষটি ছবির ফ্রেমের মধ্যে নেই।
সে আমাদের কাছে বেঁচে আছে শুধু শব্দের উপস্থিতির মাধ্যমে - সংলাপের মাধ্যমে।
মানুষটি সিনেমার কাছে ওপারের বাসিন্দা, সিনেমাটিক বাস্তবের কাছে এই গর্তটাই যেন ‘ওপার’। কেননা তা সিনেমার নাগালের বাইরে।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, সাংবাদিক হাড়টি রেখেছে গাড়ির ড্যাশবোর্ডের ওপরে।
এই হাড় গাড়িতে আপাতত থেকে যাবে, ছবির দৃষ্টির আওতায় আপাতত থাকবে না।
ছবির ন্যারেটিভে আপাতত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে।
পরে, ছবির শেষে আব্বাস এই হাড়কে ফিরিয়ে আনবেন, ন্যারেটিভের অংশ হিসেবে তার বিচ্ছিন্ন সুতোটি সেলাই করে দেবেন।

আরও পড়ুন
‘রজত কাপুরকে অনেক জ্বালানোর পরেও তাঁর পেশাদারিত্ব মুগ্ধ করেছে’ – ‘শব্দ জব্দ’ টিমের সঙ্গে আড্ডা

ফারজাদের সঙ্গে সাংবাদিকের আবার দেখা হয়। একটি গাছের গুঁড়ি দিয়ে ফারজাদ এগিয়ে এলে সাংবাদিক তাকে জিগ্যেস করেঃ এটা কি তার ব্যক্তিগত সেতু?
ফারজাদের উত্তরঃ সমস্ত বাচ্চাই এটা ব্যবহার করে থাকে।
শিশুদের সম্পত্তির ধারণা এই রকমই হয়। তাদের অধিকারের সেতু একটি সামান্য গুঁড়ি। আমরা আভাস পাই অনেকগুলি শিশুর, কিন্তু তারা কই?
না, ফারজাদের বন্ধুদের দেখা মেলে না।
মিলবে, ছবির শেষে। আপাতত, ‘বন্ধু-হীন' ফারজাদ ও সাংবাদিকের টানাপোড়েনে ছবির ন্যারেটিভ এগোতে থাকে।

(ক্রমশ)