সিনেমার গোটা দলকে রেঁধে খাওয়াতেন বৃদ্ধা, সমস্ত সঞ্চয় তুলে দিল কিশোরী: আড়ংঘাটার রূপকথা

পথের কথা আর কীই বা বলি! টেনে নিয়ে যায় যেদিকে চলার। কত মানুষ, কত না বিচিত্র অভিজ্ঞতা! কখনও কখনও থমকাতে হয়। ফিরে ভাবতে হয়, সত্যিই কি এমন? না আমারই ঘোর ভাবিয়ে নিচ্ছে এসব? বুঝি না কিছুই। শুধু মানুষ আর মানুষ। সেই মানুষের দোরেই উঁকি দেওয়া, হাঁক দিয়ে জিজ্ঞেস করা, ‘আছেন?’

হ্যাঁ, সাড়া পাওয়া যায়। অন্তত, পেয়েছিলেন উজ্জ্বলদা। উজ্জ্বল বসু, ‘দুধ পিঠের গাছ’ সিনেমাটির পরিচালক। নদীয়ার আড়ংঘাটার গ্রামের মানুষদের দোরে দাঁড়িয়েছিলেন। চেয়েছিলেন, সবার অর্থসাহায্যে তৈরি হোক সিনেমা। না, ফিরিয়ে দেননি তাঁরা। প্রায় ১,১২৬ জন মানুষ যুগিয়েছিলেন টাকা। তৈরি হল সিনেমা। উজ্জ্বলদার স্বপ্নের ‘দুধ পিঠের গাছ।’

দর্শকের সঙ্গে সিনেমার বন্ধুত্ব পর্দাতেই। কিন্তু পর্দার পিছনে, সিনেমা তৈরির মধ্যেও লুকিয়ে থাকে হাজারো গল্প। সেই গল্পের খোঁজেই পাড়ি দেওয়া আড়ংঘাটায়। মনে আশা, যদি কিছু পাওয়া যায়! আশা দেখিয়েছিলেন উজ্জ্বলদাই। ‘চলো তো… একবার হাজির হলেই দেখবে, কত গল্প!’ গল্পের গাছ বুঝি? উত্তরে হেসেছিলেন তিনি।

যাওয়া তো গেল! তারপর? হাজির হলাম মাঠনারায়ণপুরে। সঙ্গে উজ্জ্বলদা ও আরও অনেকে। আড়ংঘাটা মফঃস্বল থেকে, ভেতরে কিলোমিটার পাঁচেক। মাঠানারায়ণপুরেই মূলত শুটিং হয়েছিল সিনেমাটির। পথে এক প্রৌঢ়া কথা বলছিলেন উজ্জ্বলদা। শুটিং চলাকালীন, রোজ তাঁর বাড়িতেই পাত পেড়ে খেতেন ইউনিটের সব সদস্য। বৃদ্ধার আপত্তি নেই তাতে। হাসিমুখে খাইয়ে গেছেন প্রত্যেককে।

এবার প্রায় তিনমাস পরে আড়ংঘাটায় এলেন উজ্জ্বলদা। অবশ্য, শুটিং-এর পর পেরিয়ে গেছে পনেরো মাস। এতদিন পরে, মাঠনারায়ণপুরে উজ্জ্বলদা আবার। যাওয়ার পথেই দেখছিলাম, চারদিকে চাষের ক্ষেত। সবুজ গাছের সারি আর শান্ত পুকুর।

গ্রামে এলে, যেন আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে আমাদের শহুরে খোলসটা। মনে হয় যেন ভিনগ্রহ থেকে ছিটকে পড়েছি এখানে, আমার অধিকার নেই এই সারল্যের অংশীদার হওয়ার। আসলে বাংলার গ্রাম ও গ্রামের মানুষরা আমাকে যেন প্রশ্নচিহ্নের মুখে ফেলে দেয়। কেন অমন হতে পারি না, কীসের এত জটিলতা – এই প্রশ্ন কুরে কুরে খায়। আর অবাক হই, প্রণাম জানাই সরল মানুষগুলিকে।

মাঠনারায়ণপুরের সেই বাড়ির সামনে গিয়ে হাঁক দিলেন উজ্জ্বলদা – ‘মাসিমা, আছেন?’ বেরিয়ে এলেন সেই প্রৌঢ়া। মুখে বলিরেখা। হাসিমুখে বললেন, ‘এসেছেন আবার?’ উজ্জ্বলদার চোখে ভেসে উঠছে শুটিং-এর দিনগুলোর স্মৃতি। দূরে, সুবিশাল ধানক্ষেতের দিকে তাকিয়ে শোনাতে লাগলেন সেই গল্প। কীভাবে শুটিং-এর পুরো দল পাত পাড়ত প্রৌঢ়ার বাড়িতে। প্রৌঢ়াও ছিলেন অক্লান্ত।

ভেবে আশ্চর্য লাগল। আমাদের শহুরে জীবনযাপনে এমনটি দেখতে পাই কই! যে যার নিজের জগত নিয়েই ব্যস্ত। সেখানে, দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করা একজন কিনা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন পুরো শুটিং টিমকে খাওয়ানোর দায়িত্ব! কীভাবে পারলেন তিনি?

দ্বিধা কাটিয়ে, জিজ্ঞেস করেই ফেললাম শেষমেশ। এই যে এতজনের দায়িত্ব নিলেন তিনি, স্বেচ্ছায়, অসুবিধা হয়নি কোনো? কেনই বা এগিয়ে এলেন নিজে থেকে? হাসলেন তিনি। ততক্ষণে ‘মাসিমা’ হয়ে উঠেছেন আমারও। বললেন, ‘মাস্টারমশাই(উজ্জ্বলদা) এখনে সিনেমা বানাবেন, আর আমরা সাধ্যমতো পাশে থাকব না, তা হয়! মাস্টারমশাই এখানেই পড়াতেন স্কুলে, তিনি তো আমাদের আত্মীয়! আত্মীয়ের পাশে দাঁড়াব না, তা কি হয়!’

আত্মীয়তার এমন আখ্যান শুনে অবাক আমরাও। কোন সহজাত প্রবৃত্তিতে উজ্জ্বলদাকে আপন করে নিলেন মাসিমা? বোঝার চেষ্টা করেও পারব না।

নাম জিজ্ঞেস করিনি তাঁর! কী দরকার! নাম হয়তো ভুলে যাব, কিন্তু মনে থাকবে ওই মুখ। ‘মাসিমা’ বলে ডেকেছি যখন, আত্মীয়তায় বাঁধা তো পড়েছেনই! আত্মার সঙ্গে সম্পর্ক যাঁর, তাঁকে ভোলায় সাধ্য কার!

তখনও বুঝিনি, আরও আশ্চর্য অপেক্ষা করছিল সামনে। উজ্জ্বলদা ডেকে নিলেন স্নেহাকে। স্নেহা, বছর দশেকের ছোট্ট মেয়ে। সম্পর্কে প্রৌঢ়ার নাতনি। উজ্জ্বলদা বলছিলেন, ওটুকু বয়সেই উজ্জ্বলদার হাতে তুলে দিয়েছিল সিনেমা তৈরির টাকা। তাও নিজের ঘট ভেঙে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম স্নেহার দিকে। পারল! অল্পবয়সের কতটুকুই বা সম্বল! পারল ওভাবে উজাড় করে দিতে! আমি হলে পারতাম?

না, পারতাম না। আর সে-কারণেই লাজুক মেয়েটির পায়ের কাছে নামিয়ে রাখলাম একগুচ্ছ বিস্ময়ফুল। মাস্টারমশাই সিনেমা বানাবে, টাকার প্রয়োজন তাঁর, এ-কথা শুনে নিজের সামান্য সঞ্চয়ও দিয়ে দিতে দ্বিধা করেনি সে। এই শিক্ষা আর কই পাব!

উজ্জ্বলদাকে বলিনি, কিন্তু মনে-মনে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি তাঁকে। তাঁর ‘দুধ পিঠের গাছ’ এক অর্থে ইতিহাস তৈরি তো করছেই! কিন্তু তার পাশাপাশি, এসব গল্পেরও জন্ম দিয়েছে সে। আমাকে নিয়ে এসেছে মানুষের কাছে। সেই মানুষ, যার কাছে নত হতে সংকোচ নেই কোনো। যদি কোথাও নিজেকে বিলীন করে মিশে যেতে হয়, তা এখানেই, এখানেই, এখানেই…

আড়ংঘাটা গৌরাঙ্গের ভূমি। প্রেম এখানকার বাতাসে। আমি যদি সেই প্রেমের কণামাত্র না নিয়ে ফিরে যাই, পদকর্তারা ক্ষমা করবেন না। মানুষভজনের শেষ নেই। উজ্জ্বলদা, দুধপিঠের গাছের দিকে তাকিয়ে আছি আমিও। পাব সেই অপার্থিব স্বাদ?