নৃপেণ দাস তখন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সর্বময় কর্তা। জ্যোতিষ গুহ অধ্যায় শেষ হয়েছে ক্লাবে। পিকে ব্যানার্জির কোচিং-এ সেবার লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ইস্টবেঙ্গল। পরদিন সকালেই ক্লাব লনে ঢুকে নৃপেণ দাস রেগে আগুন। তাঁকে ছাড়াই খেলোয়াড়দের নিয়ে লনে লাল-হলুদ পতাকা তুলে দিয়েছেন পিকে!
তার কিছুদিন আগেই প্লেয়ারদের পেমেন্ট দেরি হওয়ায় নিজের পেমেন্ট না নিয়ে কর্তাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খুলে চক্ষুশূল হয়ে গেছেন ময়দানের এই নব্য কোচটি। নৃপেণবাবু ডেকে পাঠালেন পিকে-কে। জবাব চাইলেন, কেন ক্লাব কর্তার অনুপস্থিতিতে পতাকা তুললেন তিনি৷ পিকে সপাটে জবাব দিয়েছিলেন যে ক্লাবের আসল পিলার তো প্লেয়াররাই। যদিও নৃপেণবাবুর কিছু আচরণে পিকে বিরক্ত ছিলেন। ইস্টবেঙ্গলকে উত্তরবঙ্গে খেলতে যাবার জন্য অনুরোধ করা হলে, নৃপেণবাবু ম্যাচ পিছু এক লক্ষ টাকা চেয়ে বসেন, যা কষ্ট দিয়েছিল পিকে-কে। টাকার কাছে খেলা হারিয়ে যাক মেনে নিতে পারেননি পিকে। তাই হয়তো আরিয়ান আর রেলের মতো দলে নিজের খেলোয়াড় জীবন শেষ করেও তিনি আজ কিংবদন্তি। নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে পিকে-কে কোনোদিন যেতে হয়নি ইস্ট বা মোহনের দরজায়।
আরও পড়ুন
থেমে গেল ‘ভোকাল টনিক’, ফুরোল লড়াই, দীর্ঘ অসুস্থতার পর প্রয়াত পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়
পিকে ব্যানার্জিই সম্ভবত ময়দানের সবচেয়ে দৃঢ় শিরদাঁড়া, যিনি জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব থেকে অলিম্পিকে প্রতিনিধিত্ব কিংবা এশিয়ান গেমসে সোনা থেকে পদ্মশ্রী বা অর্জুন পুরস্কার – এত সাফল্য অর্জন করেছেন। পিকে ব্যানার্জি ছুটেছেন চৌকো মাঠটার সাইডলাইন ধরে আর তাকে ধাওয়া করেছে সাফল্যের ডিফেন্স। তাই হয়ত ক্ষয়িষ্ণু বাংলা ফুটবলের পাশে দাঁড়িয়ে সমর্থকদের কাঁধে হাত রেখে এখনো সেই ডায়মন্ড ডার্বির মতোই তিনি বলেন- "দেখুনই না কি হয়, খেলাটা তো মাঠে হবে, আগেই হেরে যাব কেন?" - আপনাকে কোনোদিন হারতে দেখেনি তো কেউ…
সত্তরে পিকে জাপান থেকে কোচিং-এর ট্রেনিং নিয়ে ফিরেছেন। সে সময় বাংলা ময়দানে পিকে ব্যানার্জিকে নিয়ে মিথ ছিল যে তিনি ইস্টবেঙ্গলের বিপক্ষে যত জান লড়িয়ে খেলেন মোহনবাগানের বিপক্ষে খেলেন না। কিন্তু অদ্ভুতভাবে সেই ইস্টবেঙ্গলই তাঁর কাছে এল কোচ হবার প্রস্তাব নিয়ে। সত্তর সালের সেই প্রস্তাব পিকে প্রত্যাখ্যান করলেন। যদিও সত্তরের দশকের প্রথমার্ধটা যে পিকে-কে তার কোচিং জীবনের ভিত্তি গড়ে দেবে কেই বা জানত? বাহাত্তরে ইস্টবেঙ্গলে এলেন পিকে৷ মনে রাখতে হবে পিকেই কিন্তু প্রথম আধুনিক কোচ, যিনি পরিচিত ৪-২-৪ ছক ভেঙে মহম্মদ হাবিবকে একটু নিচে থেকে খেলিয়ে ৪-৩-৩ জমানা শুরু করেন ইস্টবেঙ্গলে৷ সত্তরের দশকের প্রথমার্ধটা জুড়ে লীগ-ডুরান্ড-শিল্ড সহ ট্রফির জোয়ারে ভাসল লেসলি ক্লডিয়াস, সৌজন্যে পিকে ব্যানার্জি। পিকেই প্রথন কোচ যিনি খেলোয়াড়দের বস নন, বন্ধু হতে পেরেছিলেন।
আরও পড়ুন
পেলের সঙ্গেই পেয়েছেন ফিফার সর্বোচ্চ সম্মান, একমাত্র এশীয় ফুটবলার বাংলার পিকে-ই
১৯৭৫ শিল্ড ফাইনালে মোহনবাগানের ঘরের মাঠে সেই ৫-০ জয়ের পর আনন্দবাজার পত্রিকার ক্রীড়া সাংবাদিক লিখেছিলেন -"আমি বুদ্ধি দিয়ে এই খেলার কোনো ব্যাখ্যা পেলাম না।" অথচ যা তিনি লিখতে পারেননি, তা হল ম্যাজিক নয় সেই ডার্বি ইস্টবেঙ্গল জিতেছিল পিকে নামক জিনিয়াসের মস্তিষ্কের ওপর ভর করে। মরশুমের আগে পিকে বুঝেছিলেন শ্যাম থাপাকে একটা দুরন্ত পিভট রোলে খেলালে দলটা দৌড়াবে, যেমন কথা তেমনি কাজ। শ্যাম তখন মুম্বইতে, তড়িঘড়ি ডেকে পাঠালেন সকলের প্রিয় প্রদীপ দা। শ্যাম তো বলেই দিলেন - "আমি কি পারব?" পিকের অদম্য ইচ্ছাশক্তি উত্তর দিয়েছিল। সুরজিত সেনগুপ্ত প্রবল অসুস্থ ডার্বির আগে৷ শিল্ড ফাইনালে নামার অবস্থা নেই। অথচ পিকে ব্যানার্জি ডাকলেন তাঁকে। কর্তা নৃপেণ দাস প্রায় ঘোষণা করে দিলেন সুরজিতের জায়গায় খেলবে শুভঙ্কর সান্যাল। কিন্তু পিকে একটা বাজি ধরলেন, সুরজিত না খেললে তিনি দলই নামাবেন না, জেদ ধরলেন তিনি। আর বাকিটা হয়ে গেল ইতিহাস। সুরজিত-সুভাষ জুটি প্রায় ছিঁড়ে খেল মোহনবাগানকে ফাইনালে।
পিকের জেদ প্রসঙ্গে মনে পড়ে আরেকটি ঘটনা। লীগের ম্যাচে মহামেডানের মুখোমুখি ইস্টবেঙ্গল। সেবার মহামেডানের টানা চারবার লিগজয়ের রেকর্ড ছোঁয়ার সুযোগ ইস্টবেঙ্গলের সামনে। কিন্তু সেই ম্যাচে চূড়ান্ত ফ্লপ হাবিব আর আকবর। গ্যালারিতে রটে গেল আকবর হাবিব মহামেডানের জন্য ম্যাচ ছেড়ে দিয়েছেন। ম্যাচ শেষে ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা ঘিরে ধরলেন পিকে-কে। জবাব চাইলেন এই ব্যাভিচারের। পিকে চেঁচিয়ে উঠে বললেন- "লিখে রাখুন এবার লিগ আমি ক্লাব তাঁবুতে ঢোকাবই, তার আগে কেউ আমার দলের সম্বন্ধে এসব বলে মনোবল ভাঙবেন না…"
আরও পড়ুন
ফুটবল ও ক্রিকেট – দুই খেলাতেই ময়দান কাঁপাতেন বাংলার চুণী গোস্বামী
সেবার ইস্টবেঙ্গল লিগ জিতেছিল মহাসমারোহে। রেকর্ডও ছুঁয়েছিল সাদাকালো শিবিরের।
প্রদীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়! উত্তরবঙ্গের ব্রিটিশ রেজিমেন্টে জন্মানো ছেলেটা খেলার টানে বিহারে ইয়ুথ একডেমি ছুটে গেছিল। ভারত তখন স্বাধীন হচ্ছে সবে। কোচ পিকের জীবন নিয়ে মূল্যায়ন হলেও খেলোয়াড় পিকের জীবনও কিন্তু কম বর্ণময় নয়। ইস্টার্ন রেলে খেলার সময় জাতীয় দলে ডাক, এবং ১৯ বছর বয়সে জাতীয় দলে অভিষেক। ১৯৫৮, ৬২, ৬৬ এশিয়ান গেমসের আগেই ১৯৫৬ মেলবোর্ন অলিম্পিক্সে সাড়া জাগানো ফুটবল খেলে দিয়েছেন অভিষেকে। আর ১৯৬০ রোম অলিম্পিকে ফ্রান্সের মতো দলের সঙ্গে গোল করে সমতায় ফেরানো। পিকের খেলোয়াড় জীবন হয়তো এক এবং একমাত্র জীবন, যা লাল-হলুদ বা সবুজ-মেরুন জার্সি ছাড়াই জাতীয় দলের সম্পদ হতে পেরেছিল।
আরও পড়ুন
পরজন্মেও মোহন-সমর্থক হতে চেয়েছিলেন উমাকান্ত, আত্মহত্যার ৪৫ বছর পর ফিরল সেই স্মৃতিই
পিকে ময়দানের ম্যাজিশিয়ন নন, পিকে ময়দানী ফুটবলের হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা যিনি পাশ্চাত্যের ফুটবল বিজ্ঞানের বীজ নিঃশব্দে পুঁতে দিচ্ছিলেন বাংলার মাটির তলায় তলায়। চুণী গোস্বামী, অমল দত্ত সহ আরও অনেকের মতো স্পটলাইটের জৌলুস হয়তো পিকের ওপর ছিল না কোনোদিন। কিন্তু নিঃশব্দে খেলে গেছেন পিকে জীবনের গালিচায়।
তিরাশি বছরের প্রবীণ যখন নিঃশব্দে বসে থাকতেন, তাঁর চকচক করে ওঠা দুচোখে যেন প্রাণ পেত ভারতীয় ফুটবল। ভারতীয় ফুটবলে মাইলফলক খোদাই করার পিকের আগে হয়তো আর কেউ নেই। অমল দত্ত কিংবা চুণী-সুব্রত ভট্টাচার্যকে মাথায় রেখেও পিকের মতো প্রভাব ময়দানে আর হয়ত কারও ছিল না কখনো। পিকে ব্যানার্জি সেই স্নেহশীল পিতা হতে পেরেছিলেন, যিনি অমল দত্তের ডায়মন্ড সিস্টেমকে গুঁড়ো করে দেবার পর তাঁর সন্তানসম বাইচুং-এর হাতে জলের বোতল এগিয়ে পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। পিকে সেই কঠোর অভিভাবক, যিনি পড়ন্তবেলার বাদশা মজিদ বাসকর শেষ সুযোগ চাইলে দৃপ্ত কণ্ঠে না করে দিতে পারেন। পিকে সেই ভরসার নাম যিনি সমর্থকদের কাঁধে হাত দিয়ে তিন দশক ধরে বলে গেছেন - "আমি তো আছি, লড়ে যাব, দেখাই যাক না কী হয়!"
আরও পড়ুন
ইস্টবেঙ্গল গোল করলেই বিড়ি ধরাতেন হীরালাল, মোহনবাগানের ছিল ‘ছাতা-ঘোরানো মণ্ডল’
ভারতীয় ফুটবলে আজ কর্পোরেটের হাওয়া, আলোর ঝলকানিতে ইতিহাস মুছে যেতে পারে না। ভারতের আসমুদ্র হিমাচলের চওড়া কাঁধ পিকের নাম ইতিহাস মনে রাখবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। আর মনে রাখবে ফিফা। ফিফার সর্বোচ্চ সম্মান ফিফা অর্ডার অফ মেরিটের তালিকায় বেকেনবাওয়ার, মালদিনী, পেলে, ক্রুয়েফের পাশে আজীবন জ্বলজ্বল করবে একটা নাম -
‘প্রদীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় - ইন্ডিয়া…’
Powered by Froala Editor