ইস্টবেঙ্গল গোল করলেই বিড়ি ধরাতেন হীরালাল, মোহনবাগানের ছিল ‘ছাতা-ঘোরানো মণ্ডল’

ময়দানের ঐ ছায়াঘেরা অঞ্চলটা তখন যেন হাত-পা বিছিয়ে রেখেছে আরও অনেকটা জায়গা জুড়ে। ধর্মতলা চত্বরে তখনো ট্রামডিপোর চারপাশে সবুজ ছেঁটে বাসের আস্তানা বানানো হয়নি। এসপ্ল্যানেড ম্যানশনের উল্টোদিক থেকে জলা জমিগুলো গিয়ে মিশে গেছে সবুজে, সেই খুঁটিপোতা ময়দানের স্যাঁতস্যাঁতে রোমান্টিসিজমের ভেতর ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ। ধূসর কলকাতার অফিসপাড়াকে কেমন আগলে রাখা মায়ের মতো কলকাতা ময়দান। একটু শীতের চাদর মুড়লেই জালের ভেতর পিচে রোলার টানছে মালি, জল ছড়াচ্ছে কেউ, নিস্তব্ধতার ভেতর চলছে শহর কলকাতার ফুসফুসে প্রাণ প্রতিষ্ঠার কাজ। পোর্ট ট্রাস্ট, আরিয়ান, উয়ারি থেকে ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগান। সার বাঁধা পরপর ক্লাব, ইডেনের আলোর তলায় তখন বাঙালির একমাত্র আবেগ ফুটবল। কলকাতার দুভাগ হয়ে যাওয়া বড়ো ম্যাচের দিন।

মোহনবাগান তাঁবুতে ম্যাচের আগে ভিড় জমত বাঁশ বাঁধা কাজুর ক্যান্টিনে৷ তখন বড়ো ম্যাচের আগে শেষ প্র্যাগক্টিসে এসে নৈহাটির নিতাই মণ্ডল তাঁবুর বাইরে একটি পাথরে লাল ভাঁড়ের টুকরো দিয়ে লিখে যেতেন কিছু একটা, অনেকেই পড়তে পারতেন না তাঁর হাতের লেখাও। সেই লেখার এমন তুকতাক জন্মাল ময়দানে যে, মোহনবাগান অন্তপ্রাণ নিতাই বড়ো ম্যাচের আগের দিন সকালে প্রত্যেকবার ক্লাবে আসতেন। ময়দানে তাঁর নাম হয়েছিল ‘ভাঁড় নিতাই’।

ইংরেজ আমলে তৈরি ময়দানের মালিক এখন ভারতীয় সেনা। তিন প্রধানের তখন মাঠ ঘেরার কাজ শেষ হয়েছে। কাঠের গ্যালারি। মোহনবাগান বা ইস্টবেঙ্গল তাঁবুর একটা দিক খোলা, ঐ দিকে কাঁটাতারের বেড়া আর জংলা অঞ্চল গিয়ে মিশেছে পাশের মাঠের সঙ্গে। একে বলে র্যা ম্পার্ট।

পঞ্চাশের দশকে ইস্টবেঙ্গলে খেলছেন আপ্পারাও-আহমেদের পঞ্চপাণ্ডব। এদিকে মোহনবাগানেও আস্তে আস্তে আসছেন চুণী-শৈলেন মান্না খেলছেন দোর্দণ্ডপ্রতাপে। বড়ো ম্যাচের দিন সমর্থক-আবেগের নমুনার গল্প মিশে আছে ময়দানের মাটির তলায় তলায়।

ম্যাচের দিন সকাল গোষ্ঠপাল আর লেসলির মুখ থেকে বিক্রি হত বড় বড় ব্যাটারির খোল আর কার্ডবোর্ডের তৈরি টেলিস্কোপ। তখন রেডিও যুগ আসছে। ট্রানজিস্টারের ভাঙা কমেন্ট্রিতেই দুলে উঠছে একটা জাতি। আড়াআড়ি দু’ভাগ গোটা বাংলা। যারা টিকিট পেতেন না তাদের সম্বল হত ওই টেলিস্কোপ আর ব্যাটারির খোল। এ-জিনিস পাওয়া যেত ভাড়াতেও, দুটি মিলে দু’ঘণ্টার ভাড়া আট আনা। খোলের ওপর ডানহাত চেপে টেলিস্কোপে চোখ রেখেই চলত বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব। একদিক খোলা অঞ্চলের দখলের জন্য রীতিমতো মারামারি দেখা দিত বড় ম্যাচের দুপুর থেকে। দুই প্রধানের মাঠে খেলা থাকলে একটা বড়ো অঞ্চলজুড়ে থাকত সারে সারে সাইকেল, তার ওপর উঠে লোক দাঁড়িয়ে যেত গোলের চিৎকার শুনে। গিজগিজে মাথার ভিড়ে ম্যাচে চোখ রাখা বাইরে থেকে অসম্ভব। ইস্টবেঙ্গল মাঠে বড়ো ম্যাচ থাকলে গাছের মাথায় জায়গা নিতে হত দুপুর থেকেই।

বড়ো ম্যাচের টিকিটের দাম তখন ৬০ পয়সা আর ১ টাকা। সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে কিনতে পারতেন না বহু মানুষই। তবু লক্ষ মানুষের জমায়েত দেখেছে সোনালি ময়দান। দেখেছে সুদূর বর্ধমান থেকে ট্রেনে চেপে আগের রাতে শিয়ালদা এসে, স্টেশনে রাত কাটিয়ে বড়ো ম্যাচ খালিপায়ে হেঁটে চলে আসা মোহনবাগান পাগল ভৈরব দাসকে।

হীরালাল সাহার নাম বললে আজ আর কেউ চিনতে পারবেন না। অথচ একসময়ে ময়দানে ইস্টবেঙ্গল কত গোলে জিতেছে জানার জন্য হীরালালের আঙুলের দিকে তাকালেই হত। ইস্টবেঙ্গল গোল করলেই একটি বিড়ি তিনি ধরিয়ে নিতেন আঙুলের ফাঁকে, যত গোল তত বিড়ি পরপর। চারের বেশি গোল মানে হীরালালের বিড়ি চলে আসবে বাঁ হাতে। ইস্টবেঙ্গল অন্তপ্রাণ এই মানুষটি যেন ময়দানের চলমান স্কোরবোর্ড। অফিসফেরত ধর্মতলার রোম্যান্টিক স্কোরকার্ড বটে।

মোহন গ্যালারির চেনা নাম ছিলেন ছাতা-ঘোরানো মণ্ডল! কী আশ্চর্য, ময়দান ভদ্রলোকের ভালো নামটা জানতেও চাইল না কোনোদিন। মোহনবাগান গোল করলেই একটা বিশালাকার ছাতা ঘোরাতেন মণ্ডলবাবু। ময়দানে আজ আর নেই একটা হীরালাল বা মণ্ডলবাবুরা, ইডেনে নেই ফুটবলও। তবু শীতের রোদের পরতে পরতে রয়েছে বড়ো ম্যাচের নস্টালজিয়া।

গোষ্ঠ পাল মোহনবাগান গ্যালারিতে বসতে চাইতেন না ব্রিটিশদের তৈরি বলে। মোহন সচিব ধীরেন দে বড়ো ম্যাচের দিন গোষ্ঠ পাল সরণীর ছায়াও মাড়াতেন না। ম্যাচের ৭০ মিনিট বসে থাকতেন বাবুঘাটের একটা নৌকায়। এক অমোঘ বিশ্বাস যে, ক্লাবে ম্যাচের দিন তিনি ঢুকলেই নাকি ইস্টবেঙ্গল তাদের হারিয়ে দেবে। নিজের ড্রাইভারকে বারে বারে দৌড় করিয়ে জেনে নিতেন স্কোরকার্ড। তখন কলকাতায় কংক্রিটের জঙ্গল হয়নি, তাই মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে গোল হলে চিৎকার স্পষ্ট হত শান্ত বাবুঘাটেও।

ইস্টবেঙ্গলের প্রয়াত সচিব পল্টু দাশ গ্যালারিতে একটি নির্দিষ্ট চেয়ার রেখেছিলেন নিজের। ফোর্ট উইলিয়ামের দিকে মুখ করে থাকতেন মোহনবাগান আক্রমণে এলে। আর গোটা ম্যাচ একবারও ওই সিটের সামনে থেকে নড়তেন না। ইস্টবেঙ্গলের এই তুকতাক আরও মজার হয়ে ওঠে সাবেক কর্তা স্বপন বলের আমলে। স্বপন বল ডার্বির দিন দুটো চেয়ার বা বেঞ্চি পাশাপাশি দিয়ে মাঝের জোড়া অংশটায় বসতেন। ওই ছিল বিশ্বাস- ময়দানের চেনা বড়ো ম্যাচের তুকতাক!

পঞ্চাশ বা ষাটের দশকের মাঝামাঝি অবধিও মাঠে আসতেন না মেয়েরা। বড় ম্যাচের দিন প্রথম শোভাবাজার রাজবাড়ি, দত্ত বাড়ি, সেনবাড়ির মহিলাদের একবার দেখা গেল মোহনবাগান গ্যালারিতে। সেই প্রথম মেয়েদের আনাগোনা শুরু হল ময়দানে। বড়ো ম্যাচের উন্মাদনা মাঠমুখী করল তাঁদেরও। ডার্বি ম্যাচ দেখেছিল রোম্যান্টিসিজমও। বদ্রু ব্যানার্জি বড়ো ম্যাচের দিন মাঠে আনতেন তাঁর প্রেমিকা বিখ্যাত অভিনেত্রী তপতী ঘোষকে। দল গোল করলে গ্যালারিতে হাত নাড়াতেন বদ্রু-তপতী!

ময়দানের গরম চায়ের পেয়ালায় চলকে যাওয়া সোনালি প্রেমের দিন তখন…

ডার্বির দিন ময়দানে মোহন তাঁবুতে স্টু আর টোস্ট খাওয়া ছিল এক দেখার জিনিস। আগের রাত থেকে বাঁশের ওপর ছাউনি দেওয়া ক্যান্টিনটায় শুরু হয়ে যেত ব্যস্ততা, ইডেন বা ইস্ট-মোহন মাঠে৷ ম্যাচ শেষে মোহনবাগান জিতলে কাজুর ক্যান্টিনে স্টু ছিল মোহন সমর্থকদের প্রাণের আরাম। আজ যেন ধূসর, ক্যাফেটেরিয়ার জৌলুসে কোনোমতে ধুলো জমা সাইকেলের পাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ভাঙাচোরা ক্যান্টিনটা। অথচ শোভাবাজার রাজবাড়ির কোমরে বেল্ট হাতে লাঠি সোনার চেন পরা ছেলে আর সাদা শার্ট খাঁকি প্যান্ট কেরানির আড্ডা জমত এই ক্যান্টিনে। স্মৃতির পাতায় তারা বেঁচে আছে আজ।

ইস্টবেঙ্গল ক্যান্টিনে ডার্বি স্পেশাল মেনু ছিল মাংসের ঘুগনি আর ডিমের পোচ।

এরপর এল রেডিওর যুগ, আস্তে আস্তে কলকাতা ছাড়িয়ে শহরতলি হয়ে অজ পাড়াগাঁয়ে বড়ো ম্যাচের দিন ভিড় জমতে শুরু করল পাড়ার ক্লাবে রেডিওটার সামনে। জগুবাবুর বাজার থেকে স্পেশাল অর্ডারে ইলিশ আর কোলে মার্কেট অঞ্চল থেকে আসত গলদা চিংড়ি। ম্যাচের সময় দুই গ্যালারিতে তাঁদের প্রিয় মাছের আগমন ছিল ডার্বির বিশেষ আকর্ষণ। কাঠের পাটাতন করে নিচে বাঁশের পায়া বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হত ইলিশ বা চিংড়ি। গোল হলেই উত্তাল হত সেই কাঠামোটা, উত্তাল হত গ্যালারি…

আস্তে আস্তে সুব্রত-প্রশান্ত জুটি, মানস-বিদেশ জুটি এল, পদ্মাপাড়ে এলেন মনা-সুধীর, দশক ঘুরতে ডার্বি দেখল কত ঘটনা।

সত্তরের দশকে এক কলকাতা লীগের ডার্বি ম্যাচে হেরে গেল মোহনবাগান। ইস্টবেঙ্গলে তখন কর্তা পল্টু দাশ। উত্তেজনায় তিনি মোহনবাগানের তরুণ বসুর সামনে জোড়া ইলিশ নিয়ে নেচে দিয়েছিলেন। তরুণ বসু তখন একটা মেরুন টুপি পরে মাঠে আসতেন। এই ঘটনার পর রাগে আর কোনোদিন টুপি মাথায় তোলেননি তরুণ বসু। প্রথমে মজিদ, তারপর কৃশানু জমানায় ইস্টবেঙ্গল যেন অপ্রতিরোধ্য হল ডার্বিতে।

মোহন সমর্থকদের কলার তোলা রোয়াব আবার দেখা গেল চিমা ওকোরিকে টুটু বসু নিয়ে আসার সময়। চিমা এসে ঝড় তুললেন, বাগানের প্রথম বিদেশি এনে মিথ ভাঙলেন টুটু। ১৯৯৭-তে সেই ঐতিহাসিক ডায়মন্ড ডার্বি, অমল-পিকের লড়াই, এক অনামী পাহাড়ি তরুণের সুপারস্টার হয়ে ওঠার গল্প।

বড়ো ম্যাচ যে কত অখ্যাত তরুণকে মহাতারকা বানিয়েছে, তার হিসেব রাখা সম্ভবও নয় আজ আর।

তখন কলকাতায় আসছে টেলিভিশনের যুগ, দূরদর্শনে সম্প্রচার শুরু হল বড়ো ম্যাচের। প্র্যারকটিসে প্লেয়ারের নাম লেখা জার্সির ভিড় বাড়ল এই সময়টা থেকেই।

ময়দানের ডার্বির সকাল মানেই ক্রীড়া সাংবাদিকদের ভিড়। পুষ্পল সরকার-মতি নন্দীদের মতো দুঁদে সাংবাদিকদের কলমে লেখা হত বড়ো ম্যাচের কত সোনালি প্যামফ্লেট। এই ধারা বয়ে চলল রূপক সাহা থেকে দেবাশিষ দত্ত অবধি। আজও চলছে…

কিন্তু এই বড়ো ম্যাচের উন্মাদনা, তা কি আজও একই রকম? সত্তরোর্দ্ধ দুই প্রাণ প্রিয় বন্ধুকে জিজ্ঞেস করতে তাঁদের গলায় যেন আলগা বিষণ্ণতা। সেই আবেগ আর কই? এখন তো সবই বিদেশি আর বাইরের স্টেটের ছেলে ভর্তি। বাঙালি আর কটা আছে!

কিন্তু আজও বড়ো ম্যাচ এলেই টেলিভিশনের সামনে বসে পড়েন দুজন, একজন ইস্টবেঙ্গল একজন মোহনবাগান। ছেলেবেলার মতো ট্রামে চেপে মাঠে যাওয়ায় অন্তরায় হয়েছে বয়েস, তবু বড়ো ম্যাচের আগের রাতে আজও ঘুম আসে না শহর কলকাতার। মাঠমুখী জনতার ভিড়ে ডার্বি আজও যেন কোথাও দুহাত মেলে ডাকে এক শতাব্দীপ্রাচীন ধর্মগ্রন্থের মতো, যেখানে খেলা-সমাজ-রাজনীতি-রোম্যান্টিসজম মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

ক্রমশ বদলেছে ময়দান। আজ কর্পোরেটের হাওয়ায় ময়দানে হাজার ওয়াটের আলো। খেলা ময়দান থেকে অনেকদিন সরে গেছে যুবভারতীতে। তবু সেই স্যাকারিন দেওয়া চা-ওয়ালা, ম্যাচের দিন পেয়ারা আর শাকালু বয়ে আনা রবিদা, মাঠে জল ছেটানো বনমালী - সক্কলে যেন ঢুকে যাচ্ছে কোনো স্মৃতির পাতার ভেতর, যেখানে ময়দানের গন্ধ লেগে আছে প্রতিটা পরতে। চেনা ব্যাটারির খোল-টেলিস্কোপ পাল্টেছে টিফো-ব্যানারে, ট্রানজিস্টারের নস্টালজিয়া থেকে এসেছে হটস্টার-স্মার্ট টিভি। তবু, তবু তো এশিয়ার বৃহত্তম ডার্বি আজও বেঁচে আছে মাথা তুলে, এত ঝড় বুকে নিয়ে সে শুধু স্মৃতির পাতা উল্টে চলেছে প্রতিটা ম্যাচের পর।

আবার একটা বড়ো ম্যাচ, আবার একটা জাতির দুভাগ হয়ে যাবার দিন। একটা প্রাচীন জাতির ভরকেন্দ্রে থাকা কোনো দলিল আজ পাতা উল্টে চলে যাবে পরের অধ্যায়ে। কোনো দস্তাবেজের ভেতর হাসবেন ধীরেন দে থেকে জ্যোতিষ গুহ, চুণী গোস্বামী থেকে আহমেদ খান, হীরালাল দত্ত থেকে ছাতা-ঘোরানো মণ্ডল। এখানেই বাঙালির বৃহত্তম সংস্কৃতির চলমান ইতিহাস থমকে দাঁড়ায় ৯০ মিনিট, লেখা হয় নতুন অধ্যায়। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা যে শুধু মাঠে নয়, মাঠের বাইরে অবিরাম সময়ের স্রোতে ভেসে চলা বাঙালির একটুকরো প্রাণের আরাম…