“সেবার একটা বাউলের আখড়ায় হাজির হয়েছিলাম। ওখানেই একটা মেয়ে বসেছিল। কোলে ওর সন্তান। কথায় কথায় জানা গেল, বাচ্চাটির বাবার খোঁজ নেই। মেয়েটি যেখানে থাকত, সেখানেই এক বড়োলোক পরিবার ছিল। তাদের ছেলে মেয়েটিকে ভুলিয়ে, ভালোবাসার কথা বলে বাগানে নিয়ে যায়। তারপর ভোগ করে। পরে ওই মেয়েটি বাচ্চা জন্ম দিলে, ছেলেটা অস্বীকার করে, চলে যায়।”
আরও পড়ুন
পাঁচালির হাত ধরে ‘লক্ষ্মীবিবি’ ঢুকে পড়েন মুসলমানের ঘরেও
বলছিলেন রতন কাহার। বলতে বলতে যেন সেই দিনগুলো সামনে দেখতেও পাচ্ছিলেন। শুনতে শুনতে যেন তার আঁচ খানিকটা পাওয়াও যাচ্ছিল। বলছিলেন, ওই ফুটফুটে বাচ্চাটাই তো ‘বড়োলোকের বিটি’। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার কুমারী মা, পুরনো ভালোবাসা আর দুঃখ। সব যেন কলমে ধরা দিয়েছিল রতন কাহারের। লিখে ফেললেন কয়েক লাইন; বেঁধে ফেললেন সুর। সুরটা তো চলে আসে আপনা আপনিই। সারাজীবন এই সঙ্গীতেরই তো সাধনা করে এসেছেন তিনি। তৈরি করলেন নিজের গান ‘বড়োলোকের বিটি লো/ লম্বা লম্বা চুল/ এমন মাথায় বিঁধে দিব/ লাল গেন্দা ফুল।’ গোটা গানে সেই কুমারী, অভাগিনী মেয়েটির ভালোবাসার কথাই ফুটে উঠেছিল।
আরও পড়ুন
‘এই পাটুলির মোড়ে দাঁড়িয়ে আমার কথাই বলছেন লালন’
তারপর কেটে গেছে কতগুলো বছর। গঙ্গা দিয়ে বয়ে গেছে কত জল। বাংলার লোকসঙ্গীতের জগতে এই গানটি একটি মাইলস্টোন হয়ে থেকে গেছে। ১৯৭৬-এ গানটির প্রথম রেকর্ডিং বার করেন স্বপ্না চক্রবর্তী। বাকিটা, ইতিহাস। কিন্তু কোথাও কি হারিয়ে যাচ্ছিল মূল স্রষ্টার নাম? বীরভূমের লাল মাটির বুকে তখনও হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন এক পাগল সুরসাধক। রতন কাহারও বৃদ্ধ হয়েছেন। অশক্ত শরীর তাও গান নিয়ে বাঁচে। নিজের গান এত বিখ্যাত হলে কি হবে, অবস্থা তাঁর বদলায়নি আজও। গান আর অভাব তাঁর চিরসঙ্গী। জীবনে রয়েছে অনেক অসুবিধা, অনেক প্রতিকূলতা। কিন্তু সেসব যেন গায়ে আসে না তাঁর।
আরও পড়ুন
সরব হয়েছেন অসমের বাঙালি-বিদ্বেষ বা ধর্মীয় বিভাজন নিয়েও, আজকের ভারত দেখলে কী বলতেন কালিকাপ্রসাদ?
“বুঝলেন, আমরা হলাম মাটির মানুষ, মাটির শিল্পী। মাটির ঘরে থাকি। অনেক কষ্ট হয় বটে, কিন্তু আমাদের এতেই চলে যায়। কম বয়সে বিড়ি বাঁধতাম। বাকি জীবনটা পথে পথে গান নিয়েই কাটিয়েছি।” কথাটা বলার সময় ওই বৃদ্ধ গলাতেও যেন একটা আত্মতেজের খোঁজ পাওয়া গেল। আলকাপ, ঝুমুর, ভাদু— একের পর এক লোকসঙ্গীতের ধারাকে সমৃদ্ধ করে গেছেন রতন কাহার। সেই সঙ্গে জুড়ে ছিল একজন সাধক, যার সারা শরীর জুড়ে কেবল মাটিরই গন্ধ। ‘মাটির একতারা’। সম্মান যে পাননি, তা নয়। ছোট্ট বাড়িতে অনেক পুরস্কার। কিন্তু অভাব যে যায়নি কোনোদিন! ফাঁক পেয়ে একটি প্রশ্ন করা গেল— এখন তো চারিদিক বন্ধ। দোকানবাজারও খোলা নেই। কী করে চলছে? উত্তর এল, “একটু তো অসুবিধা হচ্ছে বটে। কী করব বলুন…”
আরও পড়ুন
অন্তর্ধানের ১৬০ বছর পর ‘ফিরলেন’ শ্রীচৈতন্য, দীক্ষা দিলেন ঘোষপাড়ার রামশরণকে
কালের ঢেউয়ে রতন কাহারের নাম প্রায় মুছেই গেছিল। লোকসঙ্গীতের মানুষ ও তার বাইরের গুটিকয়েক লোক ছাড়া বৃহত্তর অংশের ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন তিনি। সম্প্রতি হঠাৎই তিনি আলোচনার সামনের সারিতে চলে এলেন। সৌজন্যে একটি হিন্দি র্যা পের মিউজিক ভিডিও। সেখানে ‘বড়োলোকের বিটি লো’ গানটির প্রথম স্তবকটি ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু পুরো চিত্রায়ণটাই বিকৃত! কোথায় সেই বাউলের আখড়া; কোথায় সেই কুমারী মেয়েটি! কাহার পরিবারের কারোর সঙ্গেও কোনো যোগাযোগ করা হয়নি। অনুমতি নেওয়া তো দূরের কথা। খবরটা শুনে একটু চুপ করেই থাকেন রতন কাহার। চুপ করে থাকেন তাঁর ছেলেও। “আমরা তো গরিব মানুষ। আমরা আর কী করব বলুন। বাবার গান এভাবে কত লোকে নিয়ে নিয়েছে আগে। আমাদের আর কী জোর আছে!”
আরও পড়ুন
১ নভেম্বর, বাংলাকে ঘিরে পৃথিবীর দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলন জন্ম দিয়েছিল পুরুলিয়ার
এইসব সময় নিজেকেও বড়ো অসহায় মনে হয়। আমরাই বা কি করতে পেরেছি? রতন কাহারের মতো শিল্পীদের দূরেই সরিয়ে রেখেছি। আমরাও কি অবহেলা করিনি এদের? এই বয়সেও গানকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছেন এই মানুষটি। প্রবল দারিদ্র, শত সম্মানেও যা মোছেনি কখনও। রতন কাহারের এই একটি গান গেয়েই কত মানুষ নাম করে ফেলল। এই হিন্দি র্যা প তারই সাম্প্রতিক সংযোজন। কিন্তু স্রষ্টার দিকে কেউ ফিরেও তাকায়নি। আজকের সোশ্যাল মিডিয়ায় যাবতীয় বাদ-প্রতিবাদের ভিড়ে আবারও সবাই চিনছেন রতন কাহারকে। স্বীকৃতি দিচ্ছেন তাঁর গানকে। আর এসবের থেকে বহু মাইল দূরে, বীরভূমের লাল মাটির পাশে আপনমনে বসে থাকেন সেই বৃদ্ধ। সুর ভাজেন গলায়। অভাব যেন কোথায় চলে যায়! রতন কাহার তখন একজন সাধক হয়ে ওঠেন। সুরের সাধক…
ঋণ – শুভদীপ চক্রবর্তী