'এই পাটুলির মোড়ে দাঁড়িয়ে আমার কথাই বলছেন লালন'

তিনি বর্তমানে বাংলা লোকসঙ্গীতের একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। বাউল গান থেকে শুরু করে রাজনীতি, সমাজ, আন্দোলন ও অবক্ষয় - অকপট সাত্যকি ব্যানার্জি। মুখোমুখি তন্ময় ভট্টাচার্য।

আপনার জন্ম, বড় হওয়া সবটাই কলকাতায়। পড়াশুনাও ইতিহাস নিয়ে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। এমন নাগরিক জীবন থেকে লোকসঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া, যার যাপন পুরোটাই আলাদা, সেটা কীভাবে সম্ভব হল?

আমি গানবাজনা শিখছি ছোটবেলা থেকে। প্রথমে তবলা বাজাতে শিখি এবং তারও বেশ কয়েক বছর বাদে আমি সরোদ শেখা আরম্ভ করি। এর সম্পূর্ণটাই মায়ের দৌলতে। তিনিই নিয়ে যেতেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। যাদবপুরে ঢোকার পরে বাড়িতে থাকার সময়টাও বেশ কমে গেল। সবসময় সরোদের মতো বাদ্য নিয়ে ঘোরা সম্ভব ছিল না। তার আগে আমার গান শোনা বলতে বাংলা আধুনিক, ধ্রুপদ সঙ্গীত এসব। নিজের অসম্ভব ভালোও লাগত। ফার্স্ট ইয়ারে প্রথম শুনি গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’। এর আগে শুনিইনি। যাদবপুরে ঢোকার পর যে পরিবেশ, তা আমি আগে পাইনি, তখন বাড়িতে ফেরার সেভাবে চেষ্টাও থাকত না কোনো, ফলে রেওয়াজ কমে আসতে লাগল।

আরও পড়ুন
'মনে কষ্ট নিয়ে সিনেমা বানিয়ে লাভ নেই' - প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য্যের সাক্ষাৎকার

ওই বছরেই আমরা প্রথম পৌষমেলায় যাই বন্ধুরা মিলে, শান্তিনিকেতনে। সেবার গিয়ে বাউলের গান শোনা, সে ভোলার মত নয়। চারদিকে লোক দাঁড়িয়ে আছে, মাঝে একটা লোক দোতারা বাজিয়ে কী অপূর্ব ভঙ্গিমায় গাইছে! আবার যারা শুনছে, তাদের মধ্যেই একজন উঠে গিয়ে খমক বাজানো শুরু করছে। এ এক অভূতপূর্ব জিনিস। সবথেকে যেটা নাড়া দিয়ে যায় সেটা হল গানটাকে বলছে কীভাবে। এভাবে বাংলা গানকে যে বলা যেতে পারে তার কোনও ধারণাই আমার ছিল না। এখন বুঝতে পারি, সেই বলার ধরনই আমাকে টেনেছিল। বলতে পারো মোহিনীশক্তির মত আটকে রেখেছিল। মাথায় ঘুরতে থাকে – যে গান এতদিন শুনে এসেছি, তার থেকে এই গান কতটা আলাদা!

তখনও এ গান যে গাইব, তা জানতাম না। তারপর গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের বাউল জ্যাজ শুনতে শুরু করলাম এবং সেগুলো গাইতে আরম্ভ করলাম ধীরে ধীরে। এরপর দিল্লিতে ভর্তি হই পড়াশুনার জন্য। একটা দোতারা কিনে নিয়ে যাই। যদিও বেশিদিন দিল্লিতে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। আসলে তখন যাদবপুরের সঙ্গে এমন একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল যে, ছেড়ে থাকাটা সম্ভব হচ্ছিল না।

https://www.youtube.com/watch?v=okysArT_MDM

তখন সময়টাও অন্যরকম। মানে, এখন যেমন বাউল গান একটা উপজীব্য বিষয় হয়ে উঠতে পারে, সেই গান গেয়ে একজন হেসেখেলে জীবন কাটিয়ে দিতে পারে, তখন তা ছিল না। বেশ নাক সিঁটকানির মুখোমুখি হতে হয়েছে।

এখন যেহেতু বাউল সঙ্গীতের বাজার আগের থেকে অনেক ভালো, সেহেতু এর পরিবেশনও অনেক বেশি হচ্ছে? এতে কি আদতে গানের মূল ভাবের ক্ষতি হচ্ছে কোথাও?

হ্যাঁ, এখন আবার অদ্ভুত বিষয় হল যে সম্পূর্ণটাই বাউল সঙ্গীত। আগে যেমন একটা ধারণা ছিল, কেন্দুলিতে কারা যায়? আর্ট কলেজের ছেলেরা যায় নেশা করতে। এখন কিন্তু স্রোত অন্যধারায় চলছে সম্পূর্ণ। সবাই যাচ্ছে। সবাই বাউল গান গাইছে। সে লোপামুদ্রা বলো, বা রূপঙ্কর – তাঁরা সেটা গাইছেনও। এখনও শ্রীকান্ত আচার্য করেননি, তবে হয়তো করলেন বলে। (হাসি)

আসলে ফার্স্ট ইয়ারে ঢুকে আমার একটা বামভাবাপন্ন মন তৈরি হয়, তার কালচারাল এক্সপ্রেশন হিসেবে বাউলের সঙ্গে যোগাযোগ আরও বেশি পরিমাণে হয়। আর গণসংগীতও অতটা টানে না, কারণ সেই জেনেরেশনটা আমাদের আগের। তাই বাউল। যেহেতু ইতিহাস বড় কাছের, সেহেতু আমার কাছে এ এক আবহমানকে উচ্চারণ করা। এ গান যেন আজকের নয়, আবহমানের। তারপর বাউল-ফকির মেলায় সনাতন দাস বাউল, পবন দাস বাউল আর গৌর খ্যাপাকে দেখা। ২০০৪-এ শুরু হয় এই মেলা।      

আমি নির্বোধ কাজ করতে পারি না। যে কাজ আমাকে তাড়িত না করে, তা আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়।

আজ আপনি চাইলেই অনেক বেশি বাজারগত ভাবে বিখ্যাত বা আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছোতে পারতেন অথচ আপনাকে এ-ব্যাপারে তেমন উদ্যোগী দেখা যায় না। এর কি কোনো আদর্শগত দিক আছে? নাকি যাপন আপনাকে এটার থেকে সরিয়ে রেখেছে?

আমি নির্বোধ কাজ করতে পারি না। যে কাজ আমাকে তাড়িত না করে, তা আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়। যেমন, ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’-র মতো সিনেমা আমি যখন প্রথম দেখি, তখন মনে হয় এখানে কাজ করতে পারলে দারুণ কিছু হবে। নিজের পছন্দ না হলে করতামই না। কিছু জিনিসে বাধা থাকা ভালো। 

আপনি বিভিন্ন আন্দোলনের সময় গান বেঁধেছেন‘হোক কলরব’ আন্দোলনের সময় গান লিখেছিলেন। আবার, সামনেই যশোর রোডের জন্য কনসার্ট করছেন এর জন্য আপনাকে সরকারের রোষানলে পড়তে হয়নি?

না এখনও পড়িনি, তবে পড়তে হতে পারে। তার জন্য আমি চিন্তিতই নই। এর উল্টোটাও হয়েছে।  যেমন আমাকে বিজেপির এক কর্মকর্তা ফোন করে বলেছিলেন, তিনি নাকি আমার ভক্ত। তবে আমার মনে হয় না সরকার এসব ছোট জিনিস নিয়ে মাথা ঘামায় বলে।

সেদিন যাদবপুরে বাম সংগঠনের কোনও একটা অনুষ্ঠানে গেছিলাম। তার আগেই কোনও একটা নাটক ওরা করেছিল, তাতে ‘আজাদি আজাদি’ বলে স্লোগান, কী ভালো ব্যাপার! ওরা হয়তো বাইরে এসেই উবের চেপে বাড়ি ফিরবে, কিন্তু মঞ্চে ওই যে বিচ্ছুরণ, তা তো মিথ্যে নয়!

 যশোর রোডে যেটা হচ্ছে, সেটা জানা উচিত সবার। এই আন্দোলন সম্পর্কে ওখানকার স্থানীয় মানুষরাই জানেন না ভালো করে। কী বিশাল আন্দোলন বলো তো? এখানে গাইতে আমার ভালো লাগবে। কারণ আমি জানি যা হচ্ছে, পাপ হচ্ছে। আমি এর বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়ে কিছু কথা বলব।

জনপ্রিয়তা কখনওই আর্টের পরিমাপ করে না, করতে পারে না।

কিন্তু আশ্চর্য লাগে যখন কলকাতাতে ব্রিজ ভেঙে পড়ে, তখন কাউকে পাওয়া যায় না। অথচ ওটা কত মানুষের যাতায়াতের রাস্তা। এখন প্রতিবাদ রাজনৈতিক। কোনটার প্রতিবাদ হয় কোনটার হয় না সেটাও ঠিক করতে হয়। তবে হ্যাঁ, আমি মিছিলেও হাঁটিনি কোনোদিন। আমি গানটাই পারি। তার বাইরে কিছু করতে আলসেমি লাগে।

প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য্য একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, সাত্যকির করা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক তাঁর ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’ সিনেমাটাকেও ছাপিয়ে যেতে পারে এ ব্যাপারে আপনার কী মত?

আমার তো উল্টোটা মনে হয়। দ্যাখো, এই সিনেমাতে আমার কাজ করার মূল কারণটা বলি। খানিক আগে আবহমান কালের কথা বলছিলাম না? ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’ এমনই একটা সিনেমা। যে কোনও যুগে যাও তুমি, শ্রীকান্তকে পাবেই। নকশালবাড়ি বলো, স্বদেশি বলো, যে-কোনও আন্দোলন যে-কোনও যৌবন উচ্ছ্বাস যেখানে রয়েছে, সেখানে বারবার এই ঘটনা ঘটে যায়। এই সিনেমার কাজটা আমার খুব কাছের কাজ। প্রদীপ্তর মধ্যে বা আমার মধ্যে শ্রীকান্ত আছে, এ বড় আপন। এতও অস্থির একজন মানুষ, জয় গোস্বামীর কথায় বলা যায়, সুন্দরের থেকে ফিরে আসা। শ্রীকান্ত বারবার ফিরে আসছে সুন্দরের কাছ থেকে। সেই অস্থিরতার সঙ্গে আমার অস্থিরতা মিলিয়ে দিতে পারলেই তো হবে!

কোথাও গিয়ে আপনি কি নাগরিকত্বের সঙ্গে লোকগানের একটা মেলবন্ধন ঘটাতে চাইছেন?

কথাটা শুনে তাই মনে হচ্ছে, কিন্তু ঘটনা তা নয়। যখন আমি ‘বনমালী তুমি পরজনমে হইয়ো রাধা’ গাইছি, সেখানে ডায়লগটা মূল হয়ে উঠছে। মেলবন্ধনের থেকে সেটা বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সেটা খুব জরুরি। যেমন পাল্লাগান, যেখানে গানের পিঠে গান তৈরি হচ্ছে, সেটাও আমাকে খুব টানে।

আমরাও বাজারের কাছে হাতজোড় করে নিজেদের ভাষা, খাদ্য জামাকাপড় সবকিছু সমর্পণ করে দিয়েছি।

আপনি ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ফোক ফেস্টে দু’বার গেছেন, সেখানে শ্রোতার আবেদন অনেকটাই আলাদা। একজন পারফর্মার হিসেবে সেই চাহিদা কি আলাদা কোনও চাপ তৈরি করে?

না সেরকমটা নয়। লোকে আমার গান শুনতে পছন্দ করে আমার ধরণটার জন্যই। আর যদি শুধুই মনোরঞ্জন করার ব্যাপার হয় তাহলে আমি কেন, আরও তাবড় তাবড় শিল্পী আছেন। এর জন্য আমি নই। কিন্তু এর সঙ্গে মগ্নতার কোনও সম্পর্ক নেই। এবং নাচ, সেই নাচেরও একটা মগ্নতা আছে। যদি গান শুনতে শুনতে নাচ আসে সেটাও মগ্নতার জন্য হতে পারে।

আপনি যখন মঞ্চে, তখন কি আলাদা কোনও পরিকল্পনা থাকে যে, কীভাবে অনুষ্ঠানটি এগোবে?

নিশ্চয়ই সে পরিকল্পনা আমার থাকে, আমি চেষ্টা করি সেই গানের পিঠে গান দিয়ে একটা ন্যারেটিভ তৈরি করতে। যেমন ‘বনমালী বন ছেড়ে ফিরে আয়’ বা ‘মৃত্যুর মতো কেমন পাশে পড়ে আছ কবিতা’, সেখান থেকে ‘ভাবের জলেতে সই ডুব দিলাম না’, স্বভাবতই তখন ‘ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো প্রভু’ গান চলে আসে। কারণ আমি নিজে একজন নাগরিক, সেটাকে অস্বীকার করি কীভাবে!

লোকসঙ্গীতকে অনেকের কাছেই জনপ্রিয় করেছেন কালিকাপ্রসাদ তাঁর কাজ নিয়ে আপনার কী অভিমত?

জনপ্রিয়তা কখনওই আর্টের পরিমাপ করে না, করতে পারে না। যদি বলো যে, অনেক লোক তো জানল – তাতে কী যায় আসে? হ্যাঁ, এক্সপ্লোরার চার্ম থাকতে পারে। আমি এটাকে খুব একটা ভালো চোখে দেখি না।

চারদিকে একটা প্রচণ্ড কথা উঠছে যে, যত প্রজন্ম এগোচ্ছে তত বাঙালিত্ব ক্ষয় পাচ্ছে। অন্য ভাষা অন্য সংস্কৃতি সেটাকে গ্রাস করছে। আপনিও কি সেটাই মনে করেন?

এটা কিন্তু বহুদিন ধরেই হচ্ছে। আমরাও বাজারের কাছে হাতজোড় করে নিজেদের ভাষা, খাদ্য জামাকাপড় সবকিছু সমর্পণ করে দিয়েছি। তারা ঠিক করে দিচ্ছে, এর মধ্যে এইটুকু তোমরা রাখো, এইটুকুই ঠিক। আমরাও করজোড়ে মেনে নিয়েছি। ভীরুতা গ্রাস করছে।

আমাদের সময়ে আরও বেশি করে গান লেখা দরকার মানুষের।

আজ যে-কোনো জাতিগত পরিচয়কেই ইউনিফর্ম করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। একধরনের বাজার, একধরনের পোশাক, একধরনের বাড়ি সব এক। কর্পোরেট পোশাক এক। এতে ক্ষতি বাড়ছে বই কমছে না। এর মধ্যে টিকে থাকার লড়াই-ই আমার গান, আমাদের জীবন। এটাই তো পরীক্ষার আসল সময়! পারলে এই প্রতিকূলতার মধ্যেই পারতে হবে।

আমাদের এই সময়ের চ্যালেঞ্জটা অনেক বেশি। এটা আগের প্রজন্ম, মানে সুনীল-শক্তি বা গৌতম চট্টোপাধ্যায়দের সময়ে এত ছিল না। দিনকেদিন গুপ্তঘাতকের মতো ঢুকছে টিভিতে, খবরের কাগজে বা সিনেমায়। আমাদের সময়ে আরও বেশি করে গান লেখা দরকার মানুষের। যুদ্ধটা তো শুরু হয়েছে, চলছে।

এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে, ‘বৈদিক মেঘে ঘোর অন্ধকার’ গাইতে আমার তো অসুবিধা হচ্ছে না। লালন তো একই কথা বলছেন। এই পাটুলির মোড়ে দাঁড়িয়ে আমার কথাই বলছেন লালন। ‘উদয় হয় না দিনমণি’। বলছেন, ‘আর কি রে এই পাপীর ভাগ্যে/দয়াল চান্দের দয়া হবে/দিন কি সাঁই এই হালে যাবে/বেয়ে এই পাপের তরণী।’ আবার বলছেন, ‘এই দেশেতে এই সুখ হল/আবার কোথা যাই না জানি/পেয়েছি এক ভাঙ্গা নৌকা/ জনম গেল ছেঁচতে পানি।’ সেই দেশ তো কুষ্টিয়ায় নয়। প্রত্যন্ত কোনো গ্রামেও নয়। সেই দেশ আমার এই ঘরে, আমার মধ্যে। এটাই তো বাউলের সঙ্গীত!

(ছবি - দীপালি সর্দার)