সরব হয়েছেন অসমের বাঙালি-বিদ্বেষ বা ধর্মীয় বিভাজন নিয়েও, আজকের ভারত দেখলে কী বলতেন কালিকাপ্রসাদ?

এই তো কয়েকদিন আগের ঘটনা। নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল বা ক্যাব রাজ্যসভায় পাশের পরে, বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল আসাম। আসামের সাধারণ মানুষ তীব্র বিরোধিতা করলেন এই বিলের। তাঁদের দাবি, আসামে যেন প্রযোজ্য না হয় এই বিল। সংঘাত বাঁধল রাষ্ট্রের সঙ্গে। গুলিতে প্রাণ হারালেন কয়েকজন। সারা দেশ সচকিত হয়ে উঠল সেই খবরে।

কিন্তু কী ছিল আসামের মানুষজনের দাবি? তাঁদের ‘বঙ্গাল খেদা আন্দোলন’ চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। বরাক উপত্যকা সহ আসামের বিভিন্ন অঞ্চলে যে-যে বাঙালিরা বাস করেন, তাঁদের বিরুদ্ধেই ক্ষোভ অসমিয়াদের। এনআরসি-তে ১৯ লক্ষ বাঙালি নাগরিকত্ব হারানোর পরে কিন্তু পথে নামেননি অসমিয়ারা। প্রসঙ্গত, সেই ১৯ লক্ষের মধ্যে ১৪ লক্ষই ছিলেন হিন্দু। এখন, কেন্দ্রীয় সরকার যখন বললেন যে সব হিন্দু শরণার্থীদেরই নাগরিকত্ব দেওয়া হবে, ক্ষেপে উঠলেন অসমিয়ারা। সে আবার কী! তাহলে তো বাঙালিরা আসামে থাকার অধিকার পেয়ে যাবে! অসমের দীর্ঘদিন ধরে চলা ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলন হেরে যাবে তো তাহলে!

এমন যখন পরিস্থিতি, আমার মনে পড়ছিল অন্য এক মানুষের কথা। তিনি আজ আর জীবিত নেই। ৭ মার্চ, ২০১৭ সালে চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে। তিনিও আসামেরই বাঙালি। সিলেট থেকে তাঁর পূর্বপুরুষরা চলে এসেছিলেন আসামের শিলচরে। সেখানেই জন্ম, বড় হওয়া। পরবর্তীকালে অবশ্য তিনি কলকাতায় আসেন। তাঁর কর্মজীবনও এগিয়েছে কলকাতাকে কেন্দ্র করেই। কিন্তু কোনোদিনই নিজের শিকড় ও ঐতিহ্যকে ভুলে যাননি তিনি। বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলতেন সিলেটি ভাষায়। ভোলেননি, তাঁর বাবা ও কাকা শিলচরে সঙ্গীতচর্চায় কী অসামান্য ভূমিকা রেখেছিলেন। কাকা অনন্ত ভট্টাচার্য ছিলেন লোকসঙ্গীতের সংগ্রাহকও। আর যাঁর কথা এতক্ষণ বলছি, তিনি কালিকাপ্রসাদ।

কালিকাপ্রসাদের মৃত্যুর বছরখানেক পরে কথা। তিনি যাঁকে 'মুর্শিদ' বলে মানতেন, সেই শাহ আবদুল করিমের আখড়ায় গিয়ে হাজির হয়েছিলাম। বাংলাদেশের সুনামগঞ্জে। আব্দুল করিম একসময় লিখেছিলেন - 'গাঁয়েরই নওজোয়ান/হিন্দু-মুসলমান/মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গান গাইতাম।' তাঁর ছেলে শাহ নূরজালাল আমায় বললেন - 'গানের তো কোনো দেশ নাই।'

হিসেব করে দেখেছিলাম, রাধারমণ দত্ত মারা গেলেন যে-বছর, তার পরের বছরই জন্ম নিলেন শাহ আবদুল করিম। সিলেটের লোকগানের ঐতিহ্য হস্তান্তরিত হল যেন। কালিকাপ্রসাদেরও পূর্বপুরুষও তো সিলেটেরই। দোহারের একটি বন্দনাগানে কালিকাপ্রসাদ বলেছিলেন -

'পূর্বেতে বন্দনা করি সূর্যের এই ঘর।
আইসো বাবা গুরু মুর্শিদ গানের এই আসর।।
উত্তরে বন্দনা করি পাহাড় পর্বত।
আইসো গো মা সরস্বতী কণ্ঠে করো ভর।।
পশ্চিমে বন্দনা করি মক্কা-বালুস্তান।
চারিদিকে সুধীজনে জানাই সালাম।।
দক্ষিণে বন্দনা করি সমুদ্দুরের খেলা।
সবে মিলি চলো যাই চড়কের মেলা।।'

আজ জীবিত থাকলে, আসামে এনআরসি-তে কি নাগরিকত্ব হারাতেন কালিকাপ্রসাদও? কিংবা তাঁর পরিবার? এই প্রশ্ন আমায় ভাবাচ্ছে। ১৯৮৫ সালে বিতর্কিত ‘আসাম চুক্তি’ সম্পাদিত হয়। এর মূল কথা, বিদেশি নাগরিকদের(যাঁরা মূলত বাংলাদেশ থেকে আগত বাঙালি) তাড়াতে হবে আসাম থেকে। এই চুক্তিরই ফলশ্রুতি হিসেবে ১৯৮৭ সালে এনআরসি আইন তৈরি হয়।

আসাম চুক্তির ফলে তোলপাড় আসাম। সংকটে সেখানকার বাঙালিরা। তাড়িয়ে দিলে কোথায় যাবেন তাঁরা? অস্থিরতা সর্বত্র। কালিকাপ্রসাদ তখন স্কুলছাত্র। কিন্তু সেই সংকটের ছাপ পড়েছিল তাঁর মনেও। লিখেছিলেন কবিতা – ‘দেশজুড়ে আজ বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর ধ্বনি, বৃষ্টি তো নয় রক্তপাতের শব্দ আমি শুনি।’ পরবর্তীকালে সেই কবিতা পুনর্লিখিত হয় গান হিসেবে। সেই গানের শেষ লাইন ছিল – ‘হে মোর চিত্ত পুণ্য তীর্থে বিদেশ বসুন্ধরা।’

কালিকাপ্রসাদ সবসময় বিশ্বাস রেখেছেন ধর্মীয় ঐক্যে। কিন্তু আসামের সমস্যা যত না ধর্মীয়, তার থেকে বেশি জাতিগত। নব্বইয়ের দশকে কালিকাপ্রসাদ লিখলেন – ‘এপার বাংলা ওপার বাংলা মধ্যে জলধি নদী/নির্বাসিতা নদীর বুকে বাংলায় গান বাঁধি।’ পরবর্তীকালে এই লেখায় সুর দিয়ে গেয়েছিলেন শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার।

ওই গানেই তিনি লিখেছিলেন, ‘বাংলা কখন ফতেমা বিবি, বাংলা কখনও রাধা।’ কিংবা, ‘ছিন্ন বাস্তু নির্বাসিত এপার-ওপার গেছে/মার দুধটুকু তবুও আমায় বাংলাই শিখিয়েছে।’ তিনি দু’বাংলার ভাগ মানেননি। সুর দিয়ে, গান দিয়ে আরও জড়িয়ে রাখতে চেয়েছিলেন বাঙালির আবহমান সংস্কৃতি। বারবার ছুটে গেছেন ওপার বাংলায়। কখনও সুনামগঞ্জ, কখনও কুষ্টিয়ার লালন সাঁই-এর মেলায়।

সিলেটের লোকসঙ্গীত গবেষক সুমনকুমার দাশ, প্রবীণ সঙ্গীতশিল্পী সুষমা দাশ আমায় জানিয়েছিলেন কালিকাপ্রসাদ নিয়ে তাঁদের মুগ্ধতার কথা। শাহ নূরজালালও বলেছিলেন – ‘আপনি কলকাতা থেকে এলেন, আপনার মাধ্যমেই জানাই, কালিকাপ্রসাদ নেই শুনে আমি খুবই কষ্ট পেয়েছি।’

মাঝেমধ্যে মনে হয়, আজ ভারতের এই পরিস্থিতি দেখলে কী করতেন কালিকাপ্রসাদ? তাঁর জন্মভূমি আসামের বাঙালিদের এই সংকট দেখলে ভেতরটা কি যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যেত না তাঁর? কৈশোরে আসাম চুক্তির বিরুদ্ধে যে কবিতা লিখেছিলেন, তা আরও সত্যি হয়ে উঠছে আজ। বাংলাদেশ থেকে মানুষ ভয় পাচ্ছে ভারতে আসতে। আসামের বাঙালিরা ধুঁকে মরছে ডিটেনশন ক্যাম্পে। পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি-আতঙ্কে আত্মহত্যা করছে সাধারণ মানুষ। আপনি থাকলে হয়তো গান দিয়ে বাঁধতে পারতেন। সংস্কৃতিকে হাতিয়ার করে প্রতিবাদ করতে পারতেন রাষ্ট্রের এই অনাচারের।

অথচ আপনি এসবের কিছু জানতেও পারলেন না, কালিকাপ্রসাদ!

(ঋণ - সঙ্গে কালিকা, সম্পাদনা - সুতীর্থ দাশ)