সময়টা চল্লিশের দশক। সমস্ত ভারতের সঙ্গে কলকাতাও ফুটছে স্বাধীনতা আন্দোলনের আগুনে। এরই মধ্যে বেড়ে উঠছিল একটি বছর চারেকের শিশু। হঠাৎ সে জানল, শহরের বুকে নাকি কারা বোম ফেলে উড়ে গেছে। চারিদিকটা অন্ধকার। সকালের সতেজ আলোতেও সবাই যেন আতঙ্কিত। শেষের শুরু কি এটা? বছর চারেকের ছেলেটা কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। সে দেখছে, উত্তর কলকাতায় তাদের অন্ধকার ঘরের মতো হয়ে গেছে কলকাতাটা। ভয়ে পাগল হয়ে গেছে সবাই।
আরও পড়ুন
চিত্রশিল্পীর স্মরণে মেলা, ব্যতিক্রমী উদ্যোগ বাংলাদেশের গ্রামে
এরপরেই ছেলেটা দেখল আরও ভয়ংকর দৃশ্য। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে ফ্যান চাওয়া কঙ্কালের দল। তারই মতো অভুক্ত শিশুদের দেহ পড়ে আছে পাশে। সেসব কি আর ‘দেহ’ আছে ততক্ষণ? এরপরই শুরু হবে ধর্মের নামে মানুষ নিধন যজ্ঞ। কলকাতা লাল হয়ে উঠবে। এইসবের মধ্যেই বেড়ে উঠছে ছেলেটি। উথাল পাথাল হয়ে যাচ্ছে সমস্তটা। এই আলো আসছে, পরক্ষণেই তার হাত ধরে উঠে আসছে অন্ধকার। ছেলেটা আঁকতে ভালোবাসে। যেভাবে তার চারপাশ ভাঙছে, সেভাবে পরবর্তীতে সেও ভেঙেছে। কিন্তু আঁকা ছাড়েনি সে। নিজের সমস্ত কথা, দেখা, যাপন সে বের করেছে সাদা ক্যানভাসে। সেখানে আলোও আছে, অন্ধকারও আছে; যেন একটা আয়না। ছোটো থেকে যেখানে নিজেকে দেখতেন গণেশ পাইন।
আরও পড়ুন
রবীন্দ্রনাথের বড়দা তিনি, অগোছালো, পাণ্ডুলিপির ছেঁড়া পাতা ছড়িয়ে থাকত জোড়াসাঁকোয়
“জীবন ও শিল্প-সংক্রান্ত আমার যাবতীয় স্মৃতি-স্বপ্ন, অভিজ্ঞতা সবই তার সংশ্লেষিত হয়েছে একটি বোধে। সেই সংশ্লেষের তাৎপর্য আমি সঠিক বুঝি না, শুধু তার ক্রিয়া অনুভব করতে পারি।” নিজের একটি সাক্ষাৎকারে এমনটাই বলেছিলেন তিনি। খ্যাতির পরোয়া করেননি কোনোদিনই। নিত্য নতুন সৃষ্টির আনন্দই যেন তাঁর সম্বল। পথ চলার শুরু সেই ছোট্ট থেকেই। বাড়িতে ছিল একটি বড়ো স্লেট। সেখানেই শুরু হয় রেখার খেলা। নিজের খেয়ালমতো আঁকতেন তিনি। রসদ পেটে একছুটে চলে যেতেন ঠাকুমার কাছে। রূপকথার গল্পগুলো কল্পনাকে শক্তি দিত। তাতে ভর করেই চলত তাঁর কলম্বাসের জাহাজ। অদ্ভুত অদ্ভুত সব কাজ করতেন। বাড়ির চৌবাচ্চায় ভাসাতেন কাগজের নৌকা। তাতে লাগিয়ে দিতেন পাল। তারপর যখন দিব্যি ভেসে থাকত নৌকাটি, তখন হঠাৎই নৌকার পালে আগুন লাগিয়ে দিতেন; আর দেখতেন। এভাবেই অভিজ্ঞতা জমাতে জমাতে এগোচ্ছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন
শিল্পই হোক শিল্পীর একমাত্র পরিচয়, ‘স্বশিক্ষিত’ ছবিওয়ালাদের প্রদর্শনীর সাক্ষী কলকাতা
জীবন তো এক আলো-আঁধারির খেলা। সেখানে শুধু কল্পনার তাণ্ডব নয়, আসে বাস্তবের কঠোর অভিঘাতও। ১৯৪৬-এর কলকাতা দাঙ্গার কিছুকাল আগেই মারা গেছেন বাবা। তারপরও সংসার চলেছে কোনোরকমে। উত্তর কলকাতার তথাকথিত মধ্যবিত্ত ঘরগুলির থেকে কিছুমাত্র আলাদা ছিল না। সিটি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর গণেশ পাইন ঠিক করলেন, আর পড়বেন না। সংসারের অবস্থা পড়ন্ত। বাড়িতে একা মা, আর পাঁচ পাঁচটি ভাইবোন। অল্প বয়সেই চাকরিতে ঢুকে যাচ্ছিলেন তিনি। বাধা দিলেন কাকারা। ততদিনে আর কেউ দেখুক না দেখুক, ভাইপোর আঁকার প্রতি ঝোঁক তাঁরা ঠিকই দেখেছিলেন। ভাগ্যিস দেখেছিলেন! শুরু হল চিত্রশিল্পী হয়ে ওঠার প্রথাগত যাত্রা। ১৯৫৫ সালে গণেশ পাইন যোগ দিলেন আর্ট কলেজে।
আরও পড়ুন
মাটির কাছে বাস, রুজিও মাটির তালেই – রূপকথার যে গ্রাম আসলে এক পরিবার
অবনীন্দ্রনাথ, রেমব্র্যান্ট, চিন্তামণি কর— একের পর এক শিল্পীর আঁকা দেখতে দেখতে এগোচ্ছিলেন। সেই যাত্রাই তাঁকে ক্রমশ অশান্ত করেছে, নিজের ভেতর ছিলেন একলা। আর অর্থ? প্রভূত নাম হওয়ার পরও সেটা ভালো পরিমাণে আসেনি তাঁর জীবনে। বেকারত্ব কী, যৌবনের প্রতিটা পদক্ষেপে বুঝেছেন সেটা। আবারও অন্ধকারে ডুব দেওয়া। কলেজ স্ট্রিটের গলিতে গলিতে ঘুরে বইয়ের ইলাস্ট্রেশনের ফরমায়েশি কাজ করতেন। মাঝে মধ্যে বিজ্ঞাপনে ছবি আঁকা। কিছুতেই অবস্থার উন্নতি নেই। বাড়িতে অভাব; তার ওপর নিজের মতো কাজগুলোও করতে পারছেন না। এমন সময় একটি স্টুডিওতে অ্যানিমেটর হিসেবে যোগ দিলেন গণেশ পাইন। সেই সময় গেছে অমানুষিক সব মুহূর্ত। স্টুডিও’র প্রচণ্ড খাটনি, কলেজ স্ট্রিটের ফরমায়েশি কাজ, সব সেরে বাড়িতে ঢোকা। সব যেন শূন্য মনে হত তখন। সেই শূন্যতাই হয়ে উঠেছিল ক্যানভাস।
আরও পড়ুন
জেমস বন্ডের জন্য ‘তাস’ এঁকেছিলেন সালভাদর দালি, এল প্রকাশ্যে
সবার আঁকাই দেখতেন। কিন্তু চলতেন নিজের মতো। নিজেই নিজের দুনিয়া তৈরি করে নিয়েছিলেন। যেখানে ঢেলে দিয়েছিলেন সবটা। তাঁর ছবি যেন তুলে ধরেছিল একটা সময়কে, যার ভাষা ছিল আধুনিক। একবার ভাবুন গণেশ পাইনের আঁকা ‘ঘাতক’, ‘হর্স অ্যান্ড হেড’, ‘ব্ল্যাক মুন’ ছবিগুলোর কথা। কালো চাঁদের সামনে কঙ্কালসার এক হরিণের ছবি। তার পাঁজর সেজে উঠছে নতুন আলোয়। একটা আশাবাদ ফুটে ওঠে ছবিতে, যে আশা তিনি নিজেও দেখে গেছেন বারবার। চারিদিকে অন্ধকার, কিন্তু ওই যে পাঁজরে লেগে আছে জ্যোৎস্না! সেটাই বা কম কী! বা মনে করুন গণেশ পাইনের আঁকা ওই পাখিটার কথা। তির তাগ করা আছে পাখিটার দিকে, এদিকে গাছ থেকে ঝুলে আছে একটিমাত্র ফল। পাখিটা ডাকছে; ও বাঁচতে চাইছে। এই বাঁচতে চাওয়ার চিৎকার নিশ্চিত শুনেছেন তিনি; তা না হলে কেমন করে আঁকলেন এটা…
আরও পড়ুন
ফুটপাতই আর্টগ্যালারি, কলকাতা তিলোত্তমার নতুন সাজ
নিজের চারিপাশ থেকেই নিজের ‘সাবজেক্ট’ পেতেন গণেশ পাইন। সেটাকে যতরকম ভাবে বিশ্লেষণ করতে পারা যায়, সেটা করতেন। বিশেষ করে সত্তর ও আশির দশকের পরিস্থিতি তাঁর ছবিতে বারবার ধরা দিয়েছে। সেই সঙ্গে রঙে, রেখায় ধরা দিয়েছে আরও একটা জিনিস— মৃত্যু। বাবার পর একে একে কাছের সবাইকেই চলে যেতে দেখেছেন তিনি। একা মানুষটি যেন আরও একা তখন। মৃত্যুই যে একমাত্র চালিকাসূত্র, সেটাই মনে হতে লাগল বারবার। কোনো প্রতিযোগিতা নয়, খ্যাতি নয়, নিজের ঢক্কানিনাদ নয়, শিল্পের জন্য লড়ে যাওয়াই ছিল একমাত্র উদ্দেশ্য। তাঁর কথায়, “আমাদের প্রজন্মের শিল্পীরা আঁকতেন শিল্পকে ভালোবাসতেন বলে। আমি মনে করি সৃজনশীলতার সঙ্গে একটি অবিচল প্রেমের সম্পর্ক থাকা উচিত। অন্যথায় আপনি জোয়ার দ্বারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন।” এই জোয়ার থেকেই দূরে সরে থাকতেন তিনি।
আরও পড়ুন
রান্নাঘর থেকে উদ্ধার ৭০০ বছরের প্রাচীন ছবি, বিক্রি ২৪ মিলিয়ন ইউরোয়
একটা সময় ‘দেশ’ পত্রিকার পূজাবার্ষিকীর প্রচ্ছদ বলতে অবধারিতভাবে থাকবেন গণেশ পাইন। তাঁর রেখাতেই সেজেছে পত্রিকার কভার। কিন্তু আর যেন শরীরও দিচ্ছিল না। আর অর্থের অবস্থা তো খুব ভালো ছিল না কোনোদিনই। সেই লোভও ছিল না। ‘দেশ’-এ তাঁর শেষ কাজ ২০১৩ সালে; স্বামী বিবেকানন্দের সার্ধশতবর্ষের বিশেষ সংখ্যায়। ১৯৮৮ সালে পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত তাঁকে নিয়ে ছবিও করেন একটি, ‘আ পেইন্টার অফ ইলোকেন্ট সাইলেন্স’। ২০১১ সালে কেরালা সরকারের তরফ থেকে পান ‘রাজা রবি বর্মা পুরস্কার’।
আরও পড়ুন
এবার থেকে দৃষ্টিহীনরাও উপভোগ করবেন মোনালিসার ছবি
এদিকে মৃত্যু বারবার উঁকি দিয়ে যাচ্ছে। নিজের আত্মজীবনীর কাজ করছিলেন। কিন্তু লিখতে যে আর ইচ্ছা করছে না। যতটুকু আয়ু আছে, পুরোটাই ক্যানভাসে দিয়ে যেতে চান। সাল ২০১৩, দিনটি ১২ মার্চ। হঠাৎই ভেসে এল মৃত্যুসংবাদ। ৭৫ বছর বয়সে চলে গেলেন গণেশ পাইন। যাকে এতদিন তিনি সাদা পাতায় ধরার চেষ্টা করেছেন, আজ যেন নিজেই সেই পথের শরিক হলেন। কিন্তু, আপোষ করেননি এখানেও। সেইরকম মানুষই যে ছিলেন না তিনি…
ঋণ-
১) আনন্দবাজার পত্রিকা
২) কালি ও কলম
Powered by Froala Editor