তিনি, সুদীপ্তা সেনগুপ্ত। পেশায় জিওলজিস্ট। শখ ছিল মাউন্টেনিয়ারিং-এরও। সঙ্গ পেয়েছেন তেনজিং নোরগের। পৃথিবীর একাধিক পর্বতে অভিযান চালিয়েছেন। প্রথম বাঙালি মহিলা হিসেবে আন্টার্কটিকা অভিযানে গিয়েছিলেন তিনিই। রোমাঞ্চকর সেসব অভিজ্ঞতাই উঠে এল এই সাক্ষাৎকারে। কথোপকথনে সোহম দাস। আজ প্রথম পর্ব।
একেবারে গোড়া থেকেই শুরু করা যাক। আপনার সময়ে, খুব কম ছাত্রীই জিওলজি পড়তে আসতেন। আপনি হঠাৎ কেন আগ্রহী হলেন এই বিষয়টায়?
সুদীপ্তা - আমি হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছিলাম সিক্সটি টু-তে। সেবছরই বি. এসসি. পড়তে যাদবপুরে এলাম। তখন ছাত্রীসংখ্যা সত্যিই খুবই কম ছিল। আমি আসলে পড়তে এসেছিলাম ফিজিক্স। তারপরে যাদবপুরে ঢোকবার সময়ে ইন্টারভিউ হয়। সেই ইন্টারভিউতে আমায় জিজ্ঞাসা করা হয়, তোমার কী করতে সবচেয়ে ভালো লাগে? আমি বললাম, ঘুরে বেড়াতে। তখন একজন প্রফেসর বললেন, তাহলে তুমি ফিজিক্স পড়ছ কেন, জিওলজি পড়ো, কারণ জিওলজিতে অনেক ঘুরে বেড়াতে পারবে। তারপরই ফিজিক্স কেটে জিওলজি করে দিলাম।
আপনি তো বেশ অ্যাক্টিভও ছিলেন বরাবরই, খেলাধুলোও করতেন খুব। সেই অভিজ্ঞতা আপনাকে অভিযাত্রী হিসেবে কেমন প্রস্তুত করেছে?
সুদীপ্তা - খেলাধুলো বলতে মাউন্টেনিয়ারিং করেছি। হায়ার সেকেন্ডারির পরেই আমি রক ক্লাইম্বিং করি। হিমালয়ান অ্যাসোসিয়েশন বলে একটা সংস্থা আছে, তারা বাংলায় প্রথম রক ক্লাইম্বিং কোর্স চালু করে। সেটায় আমি যোগদান করি, এবং বেশ ভালো করি। তারপর অন্য আরেকটি সংস্থা, সম্ভবত ওয়েস্ট বেঙ্গল স্পোর্টস ফাউন্ডেশন বা এরকম কিছু নাম, তারা একটা স্কলারশিপ দিল দার্জিলিংএর হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে যাওয়ার। তখন আমি বি. এসসি. পড়ছি, তারপর সিক্সটি ফাইভে আমি বেসিক ট্রেনিং নিই ওখান থেকে। তারপর অ্যাডভান্স ট্রেনিংও নিই। এইভাবে মাউন্টেনিয়ারিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাই। দুটো এক্সপিডিশনও করি। নেহরু ইনস্টিটিউট অফ মাউন্টেনিয়ারিং থেকেও অ্যাডভান্স ট্রেনিং নিয়েছিলাম।
আরও পড়ুন
ঋত্বিকবাবু পরিচালনা করলে ‘অযান্ত্রিক’-এ অভিনয় করতে চাই
এইচ. এম. আই.-তে আপনার ট্রেনার ছিলেন তেনজিং নোরগে, ওনার শিক্ষার্থী হিসেবে অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
সুদীপ্তা - তেনজিং ছিলেন ফিল্ড ডিরেক্টর। আর ওনার ভাইপো, নোয়াং গোম্বু, যিনি প্রথম দুবার এভারেস্টে উঠেছিলেন, তিনি ছিলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট ফিল্ড ডিরেক্টর। এনারা দুজনে মিলে সামগ্রিক ট্রেনিংটা দেখতেন। বিভিন্ন পরামর্শ দিতেন। তেনজিং খুবই অমায়িক মানুষ ছিলেন। যখন কোনও ট্রেকিং হচ্ছে বেসক্যাম্পে পৌঁছনোর, সেটা যদি খুব কঠিন হত, সেক্ষেত্রে খুব গল্প বলে বলে আমাদের মোটিভেট করতেন। আমি এম. এসসি. করতে করতেই মাউন্টেনিয়ারিংটা চালিয়েছিলাম।
হিমালয় ছাড়া আর কোন কোন পর্বতে এক্সপিডিশন করেছেন?
সুদীপ্তা - আমি পোস্ট-ডক্টরেট করতে যাই লন্ডনের এম্পিরিয়াল কলেজে। সেসময় আমি ফিল্ড করেছিলাম স্কটিশ হাইল্যান্ডসে। লন্ডনে তিনবছর কাটিয়ে আমি সুইডেনের উপসালা ইউনিভার্সিটিতে বছর দুয়েক গবেষণা করেছি। ইন্টারন্যাশনাল জিওডায়নামিক্স বলে একটি প্রোজেক্টে কাজ করছিলাম, তখন নরওয়ের ক্যালিডোনাইটসের উপর কাজ করেছিলাম ওখানকার পার্বত্য অঞ্চলে। সেগুলো সবই ফিল্ডওয়ার্কের উদ্দেশ্যে, ক্লাইম্ব করতে হয়েছিল কারণ পাহাড়ি অঞ্চল বলে। একটা সামার আমি সুইডিশ জিওলজিক্যাল সার্ভের হয়ে কাজ করি। সেসময় অরেস্কুতান বলে একটা দুর্গম পাহাড়ে কাজ করতে হয়েছিল। মোট দশজন ছিলাম ওখানে। বাকিরা সবাই সুইডিশ, আর সবাই ছেলে। একমাত্র আমি ভিনদেশি এবং মহিলা ছিলাম। কিন্তু আমার কোনো অসুবিধাই হয়নি কাজ করতে। মাঝে মাঝে একা একা কাজ করেছি। ইট ওয়াজ ভেরি টাফ। কখনও কখনও পাহাড়ের লেজে উঠে কাজ করেছি, যখন-তখন মেঘ এসে চারিদিক ঝাপসা করে দিয়ে গেল। সামনেও এগোনো যায় না, পিছনেও এগোনো যায় না। কঠিন ছিল, শারীরিক, মানসিক, উভয় দিক থেকেই, কিন্তু ভীষণ ইন্টারেস্টিং ছিল। তারপর ভারতে ফিরে এসে তিনবছর জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়াতে ছিলাম, তারপর তো যাদবপুরে যোগ দিই। সেই সূত্রে অনেক পর্বতে কাজ করেছি। আল্পসে গেছি, চিনের কিছু পাহাড়ে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তারপর ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় গেছি, তবে সবই ওই ফিল্ডওয়ার্কের সূত্রে।
আরও পড়ুন
খাদের পাশে একটা ঘর আর টুকারাম
কোন পাহাড়ে গিয়ে মনে হয়েছে, এখানে বারবার ফিরে আসা যায়?
সুদীপ্তা - আসলে, সব জায়গাই ভালো লাগে। প্রত্যেক জায়গার আলাদা সৌন্দর্য থাকে। গিয়ে মনে হয়, বাঃ, কী দারুণ! নরওয়ের পাহাড় খুব সুন্দর। আমরা যখন ফিল্ড করছিলাম, তখন যখন আমাদের কাজ শেষ হয়েছিল, তখন নর্থ ক্যাপ অবধি গিয়েছিলাম। বিউটফুল! তখন সামার ছিল, ফলে মিডনাইট সান দেখার সুযোগ হল। তখনও আন্টার্কটিকায় যাওয়া হয়নি। ওখানেই মিডনাইট সান প্রথম দেখলাম।
আন্টার্কটিকায় যাওয়া নিয়ে উৎসাহী হলেন কীভাবে? প্রথম বাঙালি মহিলা হিসেবে আন্টার্কটিকায় হাজির হওয়ার অভিজ্ঞতাই বা কেমন?
সুদীপ্তা - আমি ছিলাম একজন ট্রেনড মাউন্টেনিয়ার। অ্যাট দ্য সেম টাইম আই হ্যাড দ্য এক্সপেরিয়েন্স টু ওয়াক ইন দি আর্কটিক সার্কল রিজিওন। তার মধ্যে ওই ক্যালিডোনাইটস মাউন্টেনটা খুবই দুরূহ এবং দুর্গম ছিল। এইসব ভেবেই আমার আন্টার্কটিকায় যাওয়ার ইচ্ছেটা জাগে। তখন আমি আমার প্রফেসর মানে, সুবীরবাবুর (ডঃ সুবীর কুমার ঘোষ) পরামর্শে আমার বায়োডেটা অ্যাটাচ করে, ডিপার্টমেন্ট অফ ওশান ডেভেলপমেন্টের ডঃ কাশিমের (ডিপার্টমেন্টের তৎকালীন সেক্রেটারি ডঃ সৈয়দ জহুর কাশিম) কাছে অ্যাপ্লাই করলাম। তখন আমাকে প্রথম জানানো হয়েছিল যে, মেয়েদের আমরা নিচ্ছি না। সেটা ’৮২, সেকেন্ড এক্সপিডিশনের সময়ে। তারপর থার্ড এক্সপিডিশনের আগে আমাকে টেলিগ্রাম করে জানানো হল, যে, কাম ফর অ্যান ইন্টারভিউ। তখন আমি থার্ড এক্সপিডিশনে, ১৯৮৩ সালে সিলেক্টেড হয়ে গেলাম। আর অভিজ্ঞতা তো ‘আন্টার্কটিকা’ বইতেই আমি পুরো বিস্তারিত লিখেছি। সেখানকার সবকিছুই অসাধারণ লেগেছিল। বিশেষ অভিজ্ঞতা ওভাবে বলাটা তাই কঠিন। প্রস্তুতি পর্ব থেকেই তো একটা দারুণ উত্তেজনার ব্যাপার ছিল। তারপর সেখানে গিয়ে ওই বিস্তৃত একটা বরফের চাদরে মোড়া জায়গা, চারদিকে সীমা দেখা যায় না, তারপর পেঙ্গুইন-সীলদের দল, জাহাজের সামনে দেখতে পাচ্ছি আইসবার্গ দাঁড়িয়ে আছে – সবকিছুই প্রথমবার দেখছি তো, সে এক অনন্য অভিজ্ঞতা। আমাদের দলের মূল উদ্দেশ্য ছিল একটা স্থায়ী রিসার্চ স্টেশন তৈরি করা। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই ‘দক্ষিণ গঙ্গোত্রী’ চালু হয়েছিল। এখন তো ওটা তুষারঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন দুটো স্টেশন, ‘মৈত্রী’ আর ‘ভারতী’।
আরও পড়ুন
‘এই পাটুলির মোড়ে দাঁড়িয়ে আমার কথাই বলছেন লালন’
আপনি তো আরও একবার গিয়েছিলেন। দ্বিতীয়বারের অভিজ্ঞতা কেমন?
সুদীপ্তা - হ্যাঁ, এইট্টি নাইন-নায়েন্টিতে। সেটা ছিল নাইন্থ এক্সপিডিশন। সেই একইরকম ভাবেই সব প্রস্তুতি নেওয়া, একইভাবে যাত্রা। স্বাভাবিকভাবেই প্রথমবারের তুলনায় দ্বিতীয়বারের উত্তেজনা বেশ কমই ছিল। কারণ, আমি তো জানি, আমার কাজের জায়গা কীরকম, সেখানে কী পেতে পারি। আমার শির্মাকার পাহাড়ে স্ট্রাকচারাল জিওলজির কাজ ছিল। তাই দ্বিতীয়বারের ব্যাপারটা ছিল অনেকটাই ওই অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করা।
এখন তো অনেকেই যাচ্ছেন, অনেক রিসার্চ স্কলারও রিসার্চ করতে করতেই যাচ্ছেন। এই যে আপনাদের তৈরি করা লিগ্যাসিটা এভাবে এঁরা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, সেটা দেখে কীরকম অনুভূতি হয়?
সুদীপ্তা - হ্যাঁ, খুবই ভালো লাগে দেখলে। আমারই যাদবপুরের এক ছাত্রী নীলাঞ্জনা (সরকার), এবছরই গেল। ও যাদবপুরেই জিওলজি পড়েছে। চাকরি করছে ত্রিবান্দ্রমে। তারপর ও আবেদন করে, ওদের ইনস্টিটিউট থেকেই গেছে। ও এসে বলছিল, শেষপর্যন্ত আমার স্বপ্নটা সত্যি হল। আমি বললাম, তোমার সঙ্গে সঙ্গে আমারও খুব ভালো লাগছে।
আরও পড়ুন
ধ্বংসের মুখে পাহাড়-প্রকৃতি, ট্রেকিং কি নিছক হুজুগে পরিণত হচ্ছে ক্রমশ?
আন্টার্কটিকার ওয়াইল্ডলাইফের দারুণ সব ফোটোগ্রাফ আপনি বইতে দিয়েছেন। আপনার চোখে কীভাবে ধরা দিয়েছিল সেখানকার প্রাণীজগৎ?
সুদীপ্তা - ফোটোগ্রাফির শখটা আমার জিওলজির জন্যেই। সুবীরবাবুও খুব ভালো ছবি তুলতেন। ওয়াইল্ডলাইফ ফোটোগ্রাফিটাও হয়ে গেছে ওই ফিল্ডওয়ার্ক করতে করতেই। তার উপর মাউন্টেনিয়ারিং করতাম। আন্ডারগ্র্যাজুয়েটের সময়ে আমি একটা আকফা ফোল্ডিং ক্যামেরা কিনেছিলাম। তাতে বেশ ভাল ছবি উঠত। পরে একটা পুরনো নিকন ক্যামেরা কিনেছিলাম, যখন আমি জি. এস. আই.-তে ছিলাম। আন্টার্কটিকার ছবিগুলো সব আসাহি পেন্ট্যাক্স ক্যামেরায় তুলেছিলাম আর কানাডা থেকে ডেভেলপমেন্ট করিয়ে এনেছিলাম, কারণ তখন এদেশে এত ভাল কালার প্রিন্ট হত না। আন্টার্কটিকার ওয়াইল্ডলাইফ বলতে তো মূলত পেঙ্গুইনই দেখা যায় বেশি। এমনিতে মানুষ দেখলে প্রথম দর্শনে পালিয়ে যাবে, কিন্তু তুমি যদি চুপচাপ বসে থাকো, ওরা আস্তে আস্তে তোমার কাছে আসবে। আর যে দুটো পাখি দেখেছিলাম, সে দুটো স্কুয়া আর পেট্রেল। স্কুয়া শিকারী পাখি, আন্টার্কটিকার বাজপাখি বলে। আমি একদিন শির্মাকারে ফিল্ডওয়ার্ক করছি, তখন একটা স্কুয়ার বাচ্চাকে দেখতে পেয়ে ফোটো তুলতে গেছি, আমাকে বাকিরা বারণ করল কারণ, বাচ্চার কাছাকাছি গেলে মা স্কুয়া যে, সে অ্যাটাক করে। মা স্কুয়াটা ঘুরছিল মাথার উপরেই, তবু আমি তুলে এনেছিলাম ছবি।
আপনি আন্টার্কটিকা থেকে স্টর্ম পেট্রেলের একটা মমি এনেছিলেন, সেটা এখনও আছে?
সুদীপ্তা - নাঃ, ওটা আর নেই। ওটা আমাদের ৫২, বালিগঞ্জ প্লেসের বাড়িতে ছিল। তারপরে শিফটিংয়ের সময় কোথায় হারিয়ে গেল।
আরও পড়ুন
আমার ছবিকে প্রভাবিত করেছে পিঙ্ক ফ্লয়েড, বিটলস, রবীন্দ্রনাথের গান
আপনার দেখে আসা আন্টার্কটিকাও তো আজকে ভয়ঙ্করভাবে ক্ষতিগ্রস্ত…
সুদীপ্তা - প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। রোজই তো খবরে দেখছি, এই গলেছে, ওই গলেছে, ক্রিভাস তৈরি হয়েছে, টেম্পারেচার বেড়ে গেছে, কারণ, একবার যদি বিষয়টা হতে শুরু করে, দ্য প্রোগ্রেশন বিকাম’স ভেরি ফাস্ট। এতদিন অবধি আর্কটিকটা বেশি অ্যাফেক্টেড হচ্ছিল, কারণ, আর্কটিক ইজ ক্লোজার টু হিউম্যান অ্যাক্টিভিটিজ। আন্টার্কটিকা অনেক দূরে ছিল। কিন্তু এখন তো আন্টার্কটিকাও প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শেষ দু’বছরে ভয়ানক হারে মেল্টিং শুরু হয়েছে।
‘দেশ’ পত্রিকায় একসময় ধারাবাহিক ভাবে বেরিয়েছে আপনার আন্টার্কটিকা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। যোগাযোগ ও লেখার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
সুদীপ্তা – তখন ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষ। তিনি নিজে থেকেই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। উনিই উৎসাহ দিয়ে বলেন লিখতে। আমি ওঁকে বলি যে, আমি ওরকম ধারাবাহিকভাবে কিস্তিতে কিস্তিতে লিখতে পারব না। আমি আগে লিখে দেখি যে ওটা দাঁড়াবে কিনা, তারপর আপনাকে বলব। আমি একসঙ্গে সমস্তটা লিখি, লিখে পুরোটাই সাগরদাকে দিলাম। উনি খুব স্নেহ করতেন, যার জন্যই লিখতে পেরেছিলাম। উনি ফোন করে করে তাগাদা দিতেন, কতদূর হল। তারপর আমি পুরোটা হতে ওঁর কাছে নিয়ে গিয়ে বললাম, আপনি পরিমার্জনা করে দিন। কিন্তু উনি বললেন, আমি কিচ্ছু করব না, দু-একটা জায়গায় চ্যাপ্টার ভাগ করে দেওয়ার কথা বললেন। এরকম কিছু পরামর্শ দিলেন। আর সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ওয়ার্কিং এডিটর। তিনি দারুণ মানুষ ছিলেন। এত ভদ্রলোক, আমি তো প্রথমে বুঝতেই পারিনি যে উনি ওই সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। আমি রাফ ছবিগুলো এঁকে দিতাম ড্রাফটসম্যানকে দেওয়ার আগে, উনি সেগুলো সমস্ত নিজে হাতে করতেন। চমৎকার ওঁর হাতের লেখা, আর চমৎকার ড্রাফটসম্যানশিপ। ইন ফ্যাক্ট, ড্রাফটসম্যানের থেকে ওঁর হাতের আঁকা বেশি পছন্দ হত আমার। আমি বলেছিলাম, যে আপনার আঁকাগুলোই রেখে দিন, ওগুলো দিতে হবে না। কিন্তু পেশাদারিত্বের কারণে উনি সেটা করতে রাজি হলেন না। সাগরদা পরেও আমাকে বলেছিলেন, এই যে সারা পৃথিবীর নানা জায়গায় ফিল্ডওয়ার্কের যে অভিজ্ঞতা, তাই নিয়ে লেখো। একটা হয়েছে, এখন ভাল ফ্লো এসে গেছে, সময় থাকতে থাকতে লিখে ফ্যালো। তারপর অনেকবার ফোন করেছেন, আমি ফোন তুলেই বলতাম, আমি খুব লজ্জিত, আর লজ্জা দেবেন না। লেখা হচ্ছে না আমার। উনি বলতেন, তুমি তো দেখছি আমাকে ‘চাঁদা চাহিয়া লজ্জা দিবেন না’-র মতো করে বলছ ‘লেখা চাহিয়া লজ্জা দিবেন না’। খুবই রসিক মানুষ ছিলেন। উনি না থাকলে আমার লেখা হতই না। আমার মাথাতেই আসত না যে, এত বড় একটা বই আমি লিখতে পারি।
আরও পড়ুন
ছোট্ট রুংচুং আর রেনি নদীর গল্প
সারাজীবন ধরে এত জায়গায় গেছেন, এত কাজ করেছেন, মহিলা হিসেবে কখনও বৈষম্যের মুখোমুখি হতে হয়নি?
সুদীপ্তা - হ্যাঁ, তা তো হয়েইছে। একটা মেল-ডমিনেটেড ওয়ার্ল্ডে তুমি যদি আসো, সে তো হবেই। ইউ হ্যাভ টু বি মেন্টালি স্ট্রং। ধরেই নিতে হবে, যে তোমাকে বৈষম্যের শিকার হতেই হবে, সেইমতোই লড়াই করতে হবে। একটা জিনিস আমি বুঝেছিলাম, পড়াশোনায় যদি ভালো হও, নিজের জায়গায় যদি ভালো হও, তখন এমনিই অনেক বাধা সরে যায়। তবে ইউনিভার্সিটিতে ততটা এসবের মুখোমুখি হতে হয়নি। আমি ক্লাসে ফার্স্ট হতাম বলে প্রফেসররা সকলেই খুব ভালবাসতেন। আসল লড়াইটা শুরু হল যখন ইউনিভার্সিটি যখন ছাড়লাম। জিএসআই-তে এসব প্রচুর হয়েছে। শেষপর্যন্ত আমি যে নানা কারণে জিএসআই ছাড়লাম, তার অন্যতম হচ্ছে, আই ওয়াজ ফিলিং ডিস্ক্রিমিনেটেড। তখন তো এমন ছিল যে, জিএসআই-তে দু’হাজার জিওলজিস্টের মধ্যে আমরা তিনজন মাত্র মহিলা ছিলাম। আমি ছিলাম জিএসআই-তে তৃতীয় মহিলা জিওলজিস্ট। তারপর আমি ছাড়ার অনেকদিন পর থেকে শুনি যে মহিলাদের সংখ্যা বেড়েছে। এখন তো ৪০ শতাংশ-ই মহিলা। ইকুয়াল না হলেও আমি অন্তত সেইসময় এমনটা কল্পনা করতেই পারিনি। আন্টার্কটিকা যাওয়ার সময় যখন প্রস্তুতি চলছে, তখন মেজর আউজলা তো ভাবতেই পারেননি যে, আমি মাউন্টেনিয়ারিং করেছি। যখন আন্টার্কটিকায় গেছি, তখনও অনেকেই ভেবেছে, আমরা ডেকরেশন। মেয়ে বলে নাম-কা-ওয়াস্তে সুযোগ পেয়েছি, ঘুরতে পাঠিয়েছে।
(ক্রমশ)