খাদের পাশে একটা ঘর আর টুকারাম

দ্বিতীয় পর্ব

রুংচুং-পর্ব শেষ করে চললাম কালিম্পং। লোহাপুল থেকে শেয়ারে দেড় ঘণ্টার রাস্তা। প্রথমেই যাব বার্মেক-এর কাছে একটা গ্রামে।

প্রথম পর্ব
ছোট্ট রুংচুং আর রেনি নদীর গল্প

সাড়ে দশটায় কালিম্পং ঢুকে জানতে পারলাম, বার্মেক-এর শেয়ার ছাড়বে দুপুর একটায়। অগত্যা ঘুরতে বেরলাম কালিম্পং শহর। ব্যস্ত, গায়েগায়ে থাকা বাড়ি, বাজার, দোকানপাট। পাশাপাশি ৫০-৬০ কিমি সার্কেলের একমাত্র বাজার। ঘুরে দেখলাম, খেলাম, কেনাকাটা করলাম টুকটাক। ১টার জিপ স্টার্ট নিল ২টোর পরে। আগামী দু’দিনের আস্তানা যেখানে, সেখানের প্রিয়া আর তার কাকিমাও এসেছে বাজার করতে কালিম্পং, চললাম একসঙ্গেই। গাড়ি স্টার্ট নিতেই বৃষ্টি শুরু হল। কালিম্পং শহর ছাড়তেই পুরো প্রকৃতি তার বর্ষার রূপের ডালি সাজিয়ে বসল আমার সামনে। বর্ষায় পাহাড়ের রূপ খোলতাই হয় আরও। মাঝেমাঝেই বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগছিল চোখে-মুখে। মেঘ-বৃষ্টি দাবা খেলছিল গোটা রাস্তা জুড়ে।

গাড়ি থেকে নেমে, নিচের দিকে রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলাম। ঘরের সামনে এসে তো ‘চক্ষু চড়কগাছ’। আমার ঘরের ঠিক সামনেই খাদ। অনেকটা নিচে লোয়ার বার্মেক গ্রাম, চারিদিকে দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড়। আর নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে তিস্তা, তার প্রতিটা বাঁক স্পষ্ট! আমি হাঁ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। প্রাণু এসে ঘর খুলে দিল। একটা পাঁচ বেডের রুম, পুরোটাই আমার! ইনফ্যাক্ট গোটা প্রপার্টিতে আমিই একমাত্র গেস্ট। দাঁড়িয়ে আছি রেলিং ধরে, ফের বৃষ্টি নামল ঝমঝমিয়ে। আর আকাশে তখনো রোদ। সব মিলিয়ে পাগল হয়ে যাওয়ার অবস্থা!

দুপুরে (বিকেল বলাই শ্রেয়) খাওয়া দাওয়ার পর রাজীবদার স্কুটিতে চেপে বেড়িয়ে পরলাম। রাজীবদা ওখানকার একমাত্র প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। প্রথম যখন ফোন করেছিলাম একা আসব, রাজীবদা বিশ্বাস করতেই চাইছিল না! যাহোক, অনেকটা নিচে এসে রাজীব দা ইংরেজি ইউ আকৃতির একটা জায়গায় স্কুটিটা থামিয়ে দিল। সামনে খাদ, নিচে তিস্তা, যতদূর চোখ যায় পাহাড়, আর বৃষ্টির পরের মায়ামাখা আকাশ। খাদে পা ঝুলিয়ে বসতেই সন্ধে নেমে এল।

ভোরের দিকে ঘুমটা ভেঙে গেল হঠাৎ। জানলা দিয়ে একটা আলো আসছে হালকা। কী মনে হল, বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম, আর ঘরে ফেরা হল না। সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলাম নিচের ভিউ পয়েন্টে টিনটিন আর কালু-র সঙ্গে। সারা আকাশে তখন রঙ-এর খেলা চলছে। আস্তে আস্তে আলো এসে পড়ল কাঞ্চনজঙ্ঘার মাথায়। চোখ ভরে দেখলাম ‘প্রথম আলো’।

ঘরে এসে মোমো খেয়ে বেড়িয়ে পড়লাম দু’পায়ের ভরসায়। গতকাল শেয়ারে আসার সময় ইচ্ছেগাঁও গ্রামের মহেন্দ্রদার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। গ্রাম ঘুরতে যাওয়ার আর চা-এর নিমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। সেদিকেই পা বাড়ালাম। পথে আলাপ হল লামা ভাই-এর সঙ্গে। উনি টেম্পো নিয়ে যাচ্ছিলেন কালিম্পং। আমায় নামিয়ে দিলেন ইচ্ছেগাঁও ওঠার রাস্তায়। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম ইচ্ছেগাঁও। পৌঁছে ফোন করলাম মহেন্দ্রদাকে। ওদের বড়িতে গিয়ে খানিক আড্ডা দিয়ে, চা খেয়ে, মহেন্দ্রদার সঙ্গে গেলাম এলাচ চাষ দেখতে। সেখানে কিছুটা সময় কাটিয়ে চললাম সিলেরিগাঁও-এর জঙ্গলের দিকে। বেশ ঘন জঙ্গল। ইচ্ছে ছিল সিলেরিগাঁও গ্রামটাও ঘুরে আসবো। কিন্তু জঙ্গলে পাখিদের সঙ্গে সময় কাটাতেই বেলা বয়ে গেল। রাস্তাও হারিয়ে ফেলেছিলাম! শেষে সিতাং রক্ষাকর্তা হয়ে উদয় হল, ও গেছিল আরো গভীর জঙ্গলে কাঠ কুড়াতে। আসার পথে পা চালালাম। আকাশে তখন মেঘ জমেছে। মেন রোডের কাছাকাছি এসে ফোন দিলাম লামা ভাইকে। লামা ভাই সেই সময়ে ওখান দিয়েই ফিরছিল। কিন্তু তার গাড়িতে জায়গা ছিল না। আমি উঠলাম উজ্বলের বাইকে। উজ্বল ক্লাস টুয়েলভে পরে, কালিম্পং-এ থাকে। ছুটিতে বাড়ি এসেছে। ও ছেড়ে দিল আমায় হোমস্টের সামনে। প্ল্যান হল দুজনে বিকালে ঘুরতে যাব।

উজ্জ্বলের সঙ্গেই চললাম পাহাড়ে চড়তে, উদ্দেশ্যহীনভাবে। ও নিয়ে গেল জলসা বাংলো। খানিক সময় কাটিয়ে আমরা চললাম রংপোর দিকে। পথেই ঝরনা দেখলাম অনেকগুলো… সন্ধে নামছে আকাশে, আমরা ফেরার পথ ধরলাম। বাইক এসে থামল হোমস্টের রাস্তাটায় আর বৃষ্টি নামলো ঝমঝমিয়ে। যেন আমার মতোই মনখারাপ আকাশের। এত অঝোরে বৃষ্টি আমি কখনো দেখিনি।

সারারাত বৃষ্টি থামেনি আর। আমারো অনেক রাত অবধি ঘরে ঢোকা হয়নি। অনেক রাত অবধি আদর করেছি টিকারামকে। নিজেকে অনুভব করেছি, পাহাড়কে অনুভব করেছি। একের পর এক ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান যখন ক্যানসেল হচ্ছিল, তখন একাই যাব ঠিক করি। বাড়ি থেকে জীবনে প্রথম একা বেড়াতে বেরোলাম সাড়ে তিন বছর পর পাহাড়ে। ফাঁকা হয়ে, হাজার মনখারাপ থেকে পালিয়ে, লুকিয়ে তার বুকে মাথা রাখতে। গত চারদিনের প্রতিটা মুহূর্তে জীবনে বেঁচে থাকার রসদ কুড়িয়েছি, নিজেকে খুঁজে পেয়েছি নতুন করে। শিখেছি পাহাড়ের সামনে মাথা নত করে জীবনের পিছুটান ঝেড়ে ফেলে নতুন করে হাঁটা শুরু করতে। সে আমায় আজ ফিরত পাঠাচ্ছে সব কিছু পূর্ণ করে।

পরের দিন সকালে যখন ফেরার শেয়ার ধরছি, পিছনে পড়ে থাকছে টিকারামের ছলছলে দুটো চোখ, খাদের পাশে আমার সেই বিরাট ঘর আর…

(চলবে)