লকডাউনের গপ্পো ৮

প্রথমেই বলে রাখি এটা একটা ভূতের গপ্পো। আপনারা সকলেই জানেন, ভূত নানা প্রকার। তা এই গপ্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র এক জন মেছোভূত। সে আবার মাথামোটা। অতএব এটা 'মাথামোটা মেছোভূতের গপ্পো'। এ বার আপনারা বলতেই পারেন, ইয়ার্কি হচ্ছে? লকডাউনের সাথে ভূতের কী সম্পক্ক? তাও আবার মাথামোটা মেছোভূতের?

আরে বাবা! সেটা বলব বলেই তো গপ্পো ফেঁদেছি। শুনুন মন দিয়ে।

আমাদের এই মেছো ভূতের নাম লটপ। আপনাদের জন্য একটা ছোট্ট ট্রিভিয়া, মানুষ মরে গেলে ভূত হয়ে যায় আর তখন তার মনুষ্যনাম উল্টে যায়। ফলে বুঝতেই পারছেন ভূত হওয়ার আগে লটপের মনুষ্যনাম কী ছিল? এ বার মরার পর কে কোন ক্যাটেগরিতে যাবে মানে কে মামদো হবে, কে শাঁকচুন্নি হবে, কে আলেয়াভূত হবে, কে মেছোভূত হবে এগুলো ডিসাইড করে ভূতেদের কোর কমিটি। কী ভাবে লটপ মেছোভূত হল সেটা আমার জানা নেই।

যাই হোক, আমাদের গপ্পের নায়ক লটপ ছোট থেকেই একটু মাটো মানে মাথায় খাটো। তার বয়সী অন্য ভূতবাচ্চারা যখন শূন্যে দোল খেতে শিখে গেল, হাওয়ায় সাঁইসাঁই উড়তে শিখে গেল, চোখের পলকে 'এই ছিল ফুটবল, এই হল লুডোর ছক্কা' মানে নানা রকম রূপ ধরতে শিখে গেল, তখনও লটপ মায়ের কোলে কোলে ঘুরছে আর জুলজুল করে সব দেখছে। বাকি ভূতবাচ্চারা তো লটপকে রীতিমতো প্যাঁক দিত। বক দেখাত।

আরও পড়ুন
লকডাউনের গপ্পো ৭

তা ধীরে ধীরে বয়েস বাড়ার সাথে সাথে লটপ ও সব ভৌতিক জাগলারি কমবেশি শিখে নিল কিন্তু কোনওটাতেই তেমন পারদর্শী হয়ে উঠতে পারল না। যেটার জন্য মেছোভূতেদের নামডাক অর্থাৎ চুরি করে, ভয় দেখিয়ে মাছ খাওয়া সেটাতেও লটপ নড়বড়ে হয়েই রইল। দশ বছর বয়েস হতে চলল লটপের, এর মধ্যে সে এক বারও নিখুঁত মাছচুরি করতে পারেনি। কোনও না কোনও গন্ডগোল ঠিক বাধিয়েছে। তাই লটপকে ঘরের বাইরে বেরতে দেয় না তার মা। আচ্ছা আরও একটা ট্রিভিয়া দিয়ে দিই। ভূতেরা কোথায় থাকে জানেন? ভূতেরা থাকে কাকের পরিত্যক্ত বাসায়। আর মেছোভূতেরা থাকে মাছরাঙার পরিত্যক্ত বাসায়। কিন্তু শহরাঞ্চলে মাছরাঙার বাসা আর কটা? তাই শহরের দিকে মেছোভূতেরা মাছের দোকানের প্লাস্টিকের ছাউনির খোপেখাপে থাকে আজকাল।

এত দিন লটপ ঘরের বাইরে বেরত না কিন্তু লকডাউনের বাজারে তার পোয়াবারো। লকডাউন হওয়াতে যেমন বিভিন্ন জায়গায় রাস্তায় হরিণের দল চরে বেড়াচ্ছে, ভামবেড়াল খেলে বেড়াচ্ছে, ময়ূর নেচে বেড়াচ্ছে তেমনই ভূতেরাও বেরিয়ে পড়েছে ঘুরতে৷ অন্য সময় মানুষের ভিড়ে ভূতেদেরও দমবন্ধ হবার জোগাড়। চলুন আরও একটা ইন্টারেস্টিং ট্রিভিয়া আপনাদের জন্য। আপনারা যে ভাবেন ভূত মানুষকে ভয় দেখায় সেটা একেবারে ভুল ধারণা৷ বরং ভূতেরা মানুষের আশেপাশেই যেতে চায় না। মানুষের গায়ের গন্ধে তাদের বমি পায়। তাই কোনও মানুষ বেশি কাছে চলে এলে বমি আটকাতে ভূতেরা ছুটে পালায় আর তাতেই বাতাসটাতাস কেঁপে মানুষ ভয় পেয়ে অস্থির। সাপ যেমন ভয় পেলে কামড়ায় অনেকটা সে রকম।

যাক গে, গপ্পে ফেরা যাক। তা এই লকডাউনে লটপ দিব্যি ঘুরেটুরে দেখছিল চারপাশটা। হঠাৎ এক দিন বাবা তার কান পাকড়ে বলল, কদ্দিন আর মানুষের বাচ্চার মতো গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরবি? এ বার একটু ভূত হ। তোর জন্য তো আমাদের মানসম্মান থাকবে না৷ এত বড় হলি আজও নিখুঁত মাছচুরি করতে পারলি না। এই লকডাউনে লোকজন সব ঘরে বসে আছে, যা সুন্দর করে খানিকটা মাছচুরি করে নিয়ে আয় তো দেখি। যদি না পারিস আর মুখ দেখাবি না।

লটপের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। মাছচুরি করা খুবই কঠিন কাজ। কিন্তু বাবা যখন বলেছে কাজটা না করে উপায় নেই। মনমরা হয়ে লটপ প্রথমে একটা পালকের রূপ ধারণ করল তার পর ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলল মাছের সন্ধানে।

আরও পড়ুন
লকডাউন এর গপ্পো ৬

রাত ভালই হয়েছে। চারদিক শুনশান। মাঝে মাঝে দু একটা পুলিশের গাড়ি বাঁশি বাজিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শহর থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছে লটপ। আচমকাই মাছভাজার গন্ধে চনমন করে উঠল লটপের সবকটা ইন্দ্রিয়। আবার একটা ট্রিভিয়া। বলুন তো ভূতেদের কটা ইন্দ্রিয়? চারটে। চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা আর জিহবা। ভূতেদের ত্বক থাকে না। কারণ তারা হাওয়া দিয়ে তৈরি।

লটপ মাছচুরি করতে পারুক আর না পারুক মাছ খেতে খুবই ভালবাসে। তাই গন্ধ অনুসরণ করে সে হাজির হল একটা বাড়ির সামনে। বাড়িটা বেশ বড়। চারদিকে অনেক গাছপালা। পেছনে বড় একটা পুকুর। লটপ একটু দ্বিধায় পড়ে গেল। মাছটা সে কোথা থেকে চুরি করবে? পুকুর থেকে না কি রান্নাঘর থেকে? শেষমেশ রান্নাঘর থেকে চুরি করাটাই ফাইনাল করল লটপ কারণ পুকুর থেকে মাছচুরি করার অভিজ্ঞতা তার মোটেই সুখকর নয়। এক বার একটা কই মাছ কাঁটা মেরে দিয়েছিল তাকে। সেই নিয়ে হাসাহাসিও হয়েছিল খুব।

একটা টিকটিকির রূপ ধরে লটপ রেনওয়াটার পাইপ বেয়ে গুটিগুটি উঠতে শুরু করল। কিন্তু ভুল তো কিছু না কিছু একটা সে করবেই আর তাই এ বারও সে এক বারে পৌঁছতে পারল না রান্নাঘরে। বোকার মতো হাজির হল বসার ঘরে। বসার ঘরের সোফায় তিন জন লোক আর তিন জন মহিলা। তারা খুব উত্তেজিত হয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। এক জন মহিলা দরদর করে ঘামছে আর সাপের মতো ফোঁসফোঁস করে শ্বাস নিচ্ছে। সে বলল, আরে বোজাবে যে বলছ এই লকডাউনে লোক পাবে?

আরও পড়ুন
লকডাউনের গপ্পো ৫

একটা চিমড়ে মতো টেকো লোক বলল, পাব না মানে? ভাত ছড়ালে আবার কাকের অভাব? লকডাউনের বাজারে লোকের হাতে এমনিতেই কাজ নেই৷ কাজ পেলে লাফ দিয়ে চলে আসবে।

আর এক জন, যার মুখটা বেঁকাপারা, সে বলল, কিন্তু এখন তো গ্যাদারিং করা বারণ। কাজ করালে পুলিশ ধরবে না তো?

বেঁটে ধুরন্ধর চামচিকের মতো একটা লোক চিমড়ে টেকোটাকে বলল, এই মেজদা, তোর বন্ধু তো পুলিশ। ম্যানেজ করতে পারবি না? বাবা নেই, লকডাউন ওঠার আগে আসতেও পারবে না। এমন সুযোগ কিন্তু আর পাব না আমরা৷

চিমড়ে টেকো বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ। আমি সব ম্যানেজ করে নেব। কালকেই কাজটা হবে। আমার সবাইকে বলে দেওয়া আছে। সকাল হতেই গাড়ি চলে আসবে। আর ওরা তো কেউ আমাদের ঘরে ঢুকছে না। বাইরে থেকে কাজ করে ফিরে যাবে। ভাইরাসেরও ভয় নেই, মাঝখান থেকে কাজটা হয়ে যাবে।

লটপ বুঝতে পারল, এরা এদের বাবাকে লুকিয়ে কিছু একটা করতে চাইছে। করুকগে। তার কী? সে মাছচুরি করতে এসেছে। আড্ডা মারতে না। মাছচুরি করা হয়ে গেলে চলে যাবে।

আরও পড়ুন
লকডাউনের গপ্পো ৪

রান্নাঘরের দিকে এগলো লটপ কিন্তু ওদের কথা শুনতে শুনতে এতটাই অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল যে এ বারও রান্নাঘরে ঢুকতে পারল না। অন্য একটা ঘরে ঢুকে পড়ল সে। কিন্তু এ ঘরে ঢুকেই লটপ খুব অবাক হয়ে গেল। দুটো ছোট ছোট ছেলেমেয়ে খাটের ওপর বসে খুব কাঁদছে। দিদিটা ভাইয়ের চোখ মুছিয়ে দিচ্ছে কিন্তু তার চোখ থেকেও জল গড়াচ্ছে অনবরত। ভাইটা বলছে, পুকুরটা বোজাতে দিস না দিদি। দাদুভাই এসে যখন দেখবে বাবারা পুকুর বুজিয়ে দিয়েছে তখন খুব কষ্ট পাবে।

দিদিটা বলে, ইশ! কেন যে দাদুভাই এ সময় পিসির বাড়ি যেতে গেল কে জানে! দাদুভাই থাকলে ওরা এটা করতেই পারত না।

পুকুর বুঝিয়ে ছোটকা ওখানে বিল্ডিং তুলবে না রে দিদি?

আরও পড়ুন
লকডাউনের গপ্পো ৩

হ্যাঁ। তাই তো বলাবলি করছিল। কত মাছ আমাদের পুকুরে। সবাই মরে যাবে।

আর শুধু মাছ না। দাদুভাই তো বলে, পুকুরটা আছে বলেই আমাদের বাড়িতে এখনও কত পাখি আসে। কত রকমের পোকামাকড়, জোনাকি জ্বলে রাতের বেলা। সবাই তো আমাদের বন্ধু। পুকুর বুজিয়ে দিলে যে নেচারের ব্যালেন্স নষ্ট হয়ে যায়। বাবারা কি এটুকুও বোঝে না?

জানি না রে। দেখ না, আমাদের কাছে ফোনটাও রাখতে দেয়নি। ঠিক জানে, ফোন থাকলেই আমরা দাদুভাইকে বলে দেব। পুকুর বুজিয়ে ফেললে দাদুভাই আর বাঁচবে না।

অঝোরে কাঁদতে থাকে দুই ভাইবোন। কে জানে কেন এই কান্না দেখে বড় মন খারাপ হয় লটপের। মাছচুরির কথা সে ভুলে যায় বেমালুম।

দুই…
পর দিন সকাল হতেই ছটা মাটি ভর্তি ট্রাক এসে ঢুকল বাড়িটায় আর ঢুকল কিছু লোক। তাদের সবার হাতে কোদাল কিংবা বেলচা। দুই ভাইবোনকে আজ ঘরেই আটকে রেখেছে তাদের বাবা মায়েরা। তাদের কান্নায় পাত্তা না দিয়েই মাটি ফেলা শুরু হল পুকুরে।

ঝপাঝপ মাটি ফেলা হচ্ছে। চিমড়ে টেকোটা বলছে, কী মনে হচ্ছে? ছ লরিতে হবে না কি আরও দু লরি মাটি আনাব?

আরও পড়ুন
লকডাউনের গপ্পো ২

মাটিফেলার দলের যে নেতা সে বলছে, দেখি না। লাগলে আপনাকে বলব। আরে একটু ধারে গিয়ে মাটি দে না বাবা। অত দূর থেকে ছুড়লে অর্ধেক তো জলেই পড়ছে না।

আচমকা পুকুরের ঠিক মাঝখানে জলটা ভুস করে উঠল। খুব বড় মাছে ঘাই দিলে যেমন হয়, ঠিক তেমন। থমকে গেল সকলে। বেঁটে ধুরন্ধর চামচিকেটা বলল, ওটা কী হল? জলটা অমন কেঁপে উঠল কেন মেজদা?

বলতে না বলতেই তোলপাড় শুরু হল পুকুরের মধ্যে। কেউ যেন প্রচণ্ড রাগে তছনছ করে দিতে চাইছে গোটা পুকুরটা। সকলে ভয়ে পিছিয়ে গেল কয়েক পা। তার পরেই এক জন আর্তনাদ করে উঠল, বাবু ওই দেখেন।

সকলে ভয়ে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে দেখল, পুকুরের মাঝখানে গোল হয়ে চক্কর কাটছে বিশালাকার এক হাঙর। মাঝে মাঝে মাথা তুলে কী যেন দেখছে ওপরের দিকে আর সূর্যের আলোয় ঝকঝক করছে তার তীক্ষ্ণ দাঁতের সারি। মুহুর্তে একটা হইহই পড়ে গেল, পালাও পালাও। এ কী কাণ্ড! পুকুরের জলে হাঙর? বনদপ্তরে খবর দাও। বাঁচাও… ইত্যাদি। কোদাল বেলচা ফেলে রেখেই লোকে পালাল। বেঁটে ধুরন্ধর চামচিকেটা চিমড়ে টেকোকে নিয়ে উল্টে পড়ল ঝুরো মাটির মধ্যে। যার মুখটা বেঁকাপারা সে ওদের না তুলেই দৌড় দিল বাড়ির দিকে আর কিছুটা যেতেই বিরাট আছাড় খেয়ে হাঁ করে রইল। ভেস্তে গেল পুকুর বোজানোর কাজ।

আরও পড়ুন
লকডাউনের গপ্পো ১

তিন.
লটপকে তখন বেদম পেটাচ্ছে তার বাবা আর চিতকার করছে, তুই মেছোভূত, মাছ তোর খাদ্য, সেই তুই কি না মাছ সেজে মানুষকে ভয় দেখালি? ছি ছি ছি। অন্য কিছু সাজতে পারলি না? সাধে কি ভূতে তোকে মাথামোটা বলে? ভূত সমাজে তোর আর জায়গা হবে না। তুই যা গিয়ে মানুষের মতো পলিটিক্স কর।

মার খেতে খেতে লটপ ভাবে, সত্যিই তো। মাছ না সাজলেই ভাল হতো। কিন্তু যা হয়ে গেছে তাকে তো আর ফেরানো যাবে না। অন্য সময় হলে এই অপমানে সে খুবই কাতর হয়ে পড়ত কিন্তু আজ ততটাও খারাপ লাগল না লটপের। কারণ আসার সময় সে দেখে এসেছে, পুকুর বোজানো ভেস্তে যাওয়ায় ওই দুই ভাইবোন আনন্দে লাফাচ্ছে।