“আমি চাই, আমার সিনেমা দর্শককে বিব্রত করুক, অস্বস্তিতে ফেলুক”— ইন্দ্রাশিস আচার্যর সঙ্গে একটি আড্ডা

বাইরে তখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নেমেছে। অকাল বৃষ্টি। এমন পরিবেশে বালিগঞ্জের ‘ট্রাইব ক্যাফে’-র ভিতরটা আরো মায়ালীন হয়ে ওঠে। হলুদ আলো, বই আর ধোঁয়া ওড়ানো ফ্রেঞ্চ প্রেস কফি… আড্ডাবাজ বাঙালির জিন অস্থির হয়ে ওঠে এমন দিনে। আর, সেই আড্ডার সঙ্গী যদি হন ইন্দ্রাশিস আচার্য-র মতো চিত্র পরিচালক, তাহলে তো কথাই নেই।

আরও পড়ুন
‘মনে কষ্ট নিয়ে সিনেমা বানিয়ে লাভ নেই’

‘বিলু রাক্ষস’, ‘পিউপা’ এবং ‘পার্সেল’। মাত্র তিনটি পূর্ণদৈর্ঘ্যের সিনেমাতেই বাংলা চলচ্চিত্রের আপাত শান্ত দুনিয়াটাকে ধরে বেশ ঝাঁকিয়ে দিয়েছেন ইন্দ্রাশিস। তাঁর চলচ্চিত্রের একটা নতুন ভাষা, আন্ডারটোন, কথনের ভঙ্গী—সবটাই আলোড়িত করে দর্শকদের, অস্বস্তিতে ফেলে, ভাবায়, সহজে ঘোর কাটতে দেয় না। প্রহরের পক্ষ থেকে যেদিন ঠিক হয়েছিল, এবার থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রের নানা বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে আড্ডা জমানো হবে, সেদিন আলোচনায় তাই প্রথম নামটি উঠে এসেছিল ইন্দ্রাশিস আচার্যর-ই। আর এমন মানুষের সঙ্গে মুখোমুখি বসার দিনেই অদ্ভুত মেঘের শামিয়ানা, বৃষ্টি। ট্রাইব ক্যাফের ভিতরে তখন একটা বিভ্রমের রাজত্ব যেন বাসা বেঁধেছে। বলা ভালো ‘কাকতালীয় সেটিং’…

আরও পড়ুন
‘এই পাটুলির মোড়ে দাঁড়িয়ে আমার কথাই বলছেন লালন’

আড্ডা কিংবা কথোপকথন। ভারী শব্দে কেউ অবশ্য বলতে পারেন ‘সাক্ষাৎকার’। প্রহরের পক্ষ থেকে কথা চালানোর দায়িত্বে ছিলেন অনিতেশ চক্রবর্তী। আমরা জানতাম, ইন্দ্রাশিস আচার্য-র সঙ্গে আলোচনা নেহাত হালকা চালের হবে না। হয়ওনি। কথায় কথায় উঠে এল একটা অসুস্থ সময়, খণ্ডে খণ্ডে ভেঙে যাওয়া ব্যক্তিরা, দুদ্দাড় বদলাতে থাকা সময়, তার ভিতরের অস্তিত্বহীনতার কথা। বিলু কেন রাক্ষস হয়ে ওঠে কিংবা তাঁর সিনেমার কেন্দ্রে থাকা রূপান্তরের রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে বলতেই কফিতে চুমুক দিচ্ছিলেন ইন্দ্রাশিস। অনিতেশ ‘বিলু রাক্ষস’ সিনেমার সঙ্গে দর্শনগত মিল খুঁজে পেয়েছিলেন ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্প এবং ‘জলসাঘর’ ছবির। ইন্দ্রাশিস বলছিলেন, ছবি বানানোর সময় এই দুটি রেফারেন্সের কথা তাঁর ভাবনায় আসেনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়াটা সার্থক। আর দর্শকের এই অন্য ভুবন আবিষ্কারের জায়গা থেকেই তো সিনেমারও সার্থকতা।

আরও পড়ুন
ঋত্বিকবাবু পরিচালনা করলে ‘অযান্ত্রিক’-এ অভিনয় করতে চাই

‘পিউপা’-র সাফল্যে একটু হলেও যেন ঢাকা পড়ে গেছে ‘বিলু রাক্ষস’ নিয়ে চর্চা। অথচ, এই সিনেমার স্তরে স্তরে নানা উপাদান, অন্তর্ঘাত। এরপর, ‘পার্সেল’-ও স্বীকৃতি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক দর্শকদের কাছেও উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে তাঁর সিনেমা। তবু, ইন্দ্রাশিস যেন কিঞ্চিৎ অভিমানী। ‘বিলু রাক্ষস’-এর হয়তো আরো খানিক চর্চা পাওনা ছিল। পরিচালক হিসেবে নিত্যনতুন প্রাপ্তির মধ্যেও এই না-পাওয়াটাকুও যেন ঘন হয়ে আছে।

আরও পড়ুন
আমার ছবিকে প্রভাবিত করেছে পিঙ্ক ফ্লয়েড, বিটলস, রবীন্দ্রনাথের গান

কথার মাঝখানেই ঢুকে পড়ছিল কফি-মেশিনের শব্দ। মাঝেমাঝেই পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন ক্যাফেতে ঢুঁ মারা যুবক-যুবতী। অনেকেই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় দাঁড়িয়ে পড়ছিলেন টেবিলের সামনে। এবং তারই মধ্যে কথা চলছিল। ইন্দ্রাশিস বলছিলেন, তিনি দর্শকদের নিছক বিনোদন দিতে চান না। তিনি চান, তাঁর চলচ্চিত্র দর্শকদের অস্বস্তিতে ফেলুক, সিনেমা দেখার নিরাপদ অভ্যেসের বাইরে টেনে আনুক। তাঁর সিনেমায় বহমান ভয়, স্মৃতি এবং রূপান্তরের ভিতরে আসলে বোনা হয়ে যায় এই পুঁজিলীন সময়ের রাজনৈতিকতা। রাজনীতি মানে শুধু পতাকা, স্লোগান বা মিছিল নয়, সিনেমার ভিতরে রাজনীতির ভাষা অন্যরকমও হতে পারে, বলছিলেন ইন্দ্রাশিস।

আরও পড়ুন
‘যে-কোনো প্রশ্ন করাকেই বন্ধ করতে চায় রাজনৈতিক দলগুলি’ – বলছেন সিএটি-তে প্রথম স্থানাধিকারী দেবর্ষি

কথা এগোচ্ছিল সিনেমার বাণিজ্য নিয়েও। তথাকথিত ‘মেইনস্ট্রিমের’ বাইরে থাকা চলচ্চিত্রগুলি কীভাবে দর্শক খুঁজে নেবে, তার জন্য কি সংগঠিত হওয়ার প্রয়োজন আছে—প্রশ্ন রেখেছিলেন অনিতেশ। ইন্দ্রাশিস একটা স্বপ্নের কথা বলছিলেন, বলছিলেন অসহায়তার কথাও। তাঁর পরবর্তী সিনেমা ‘মায়াভয়’-এর প্রেক্ষাপটেও একটা অসুস্থ অতীতের স্মৃতি। “অন্য জঁর-এর সিনেমা করবেন না?” ইন্দ্রাশিস মুচকি হেসে জবাব দিলেন, “অবশ্যই”। ‘মায়াভয়’-এর পরের ছবিটাই হয়তো হবে “একটি রুরাল পলিটিকাল থ্রিলার"।

আরও পড়ুন
‘২১ ফেব্রুয়ারি নিয়ে আমরা গর্বিত, অথচ ছেলেমেয়েদের ভর্তি করি ইংরাজি মিডিয়ামে’

অতঃপর আড্ডার নটে গাছ মুড়োল। এই গোটা কথোপকথনটাই আমরা ধরে রেখেছি ক্যামেরায়। পাঠকরা চাইলে গোটা আলোচনাই শুনতে পারবেন। প্রশ্নে, ক্যামেরার কাজে নানা খুঁত নিশ্চিতভাবেই আছে। প্রথমবার তো… তবে, সেই খুঁত হয়তো ঢেকে দেবে ইন্দ্রাশিস আচার্যর কথা থেকে গড়িয়ে আসা মোহরগুলো। এই আলোচনার জন্য ট্রাইব ক্যাফের অন্যতম কর্ণধার শিল্পা চক্রবর্তীকে অনেকখানি বিব্রত করেছি আমরা। তিনি অকাতরে প্রশয় দিয়েছেন। কতখানি ধন্যবাদ দিলে আসলে সেই ঋণ চোকানো যাবে, জানা নেই।

ছবি: সঞ্জীব চক্রবর্তী, তর্পিনী ভুঁইঞা