ইনিংসের শেষ পর্যন্ত ব্যাটিং করতে চাই আমি, 'শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই'-এর মতো

চলতি মরসুমে, রঞ্জি ট্রফিতে বাংলার হয়ে দুটি সেঞ্চুরি করেছেন তিনি। সেমিফাইনালে তাঁর অনবদ্য সেঞ্চুরির জোরে, কর্ণাটককে হারিয়ে বাংলা পৌঁছে গেছে ফাইনালে। তিনি, অনুষ্টুপ মজুমদার। বাংলার এই ক্রিকেটারের সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে এল খেলার নানা টেকনিক, মনঃসংযোগ, কোচের ভূমিকা ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ। প্রহরের পক্ষ থেকে, কথোপকথনে অনিতেশ চক্রবর্তী।

হাতে ব্যথা কমেছে?

অনুষ্টুপ- (হাসতে হাসতে) কীসের জন্য হাতে ব্যথা আবার?

সেকি! অমন ইনিংসের পর, অনুরাগীদের অটোগ্রাফ দিতে দিতে হাতে ব্যথা করেনি?

অনুষ্টুপ- আরে না না, সেসব কিছুই হয়নি তেমন।

চলতি রঞ্জি ট্রফির দুটো ইনিংস কি হঠাৎ করেই বদলে দিল তোমার চারপাশটা?

অনুষ্টুপ- দেখো, চারপাশ হয়তো বদলেছে, কিন্তু আমি নিজে বদলাইনি। হয়ত চারপাশে প্রশংসার ঝড় উঠেছে। এটা একটা অন্যরকম অনুভূতি। কিন্তু তাতেও এখনও কাজ শেষ হয়নি। যতটা সম্ভব নিজেকে সংযত রেখে শেষ ম্যাচটায় একটা মরিয়া চেষ্টা করতে হবে। যেরকম খেলছি সবাই, সেরকম একটা চেষ্টা করতে হবে পরবর্তী ম্যাচেও।

আরও পড়ুন
“আমি চাই, আমার সিনেমা দর্শককে বিব্রত করুক, অস্বস্তিতে ফেলুক”— ইন্দ্রাশিস আচার্যর সঙ্গে একটি আড্ডা

তুমি বাংলার একজন সিনিয়র ক্রিকেটার। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে ও সেমিফাইনালে এরকম খেলার পর একটা চাপ তো আছেই। প্রত্যাশাও। যেরকম শচিনকে সামলাতে হত বা বিরাটকে সামলাতে হয়। সেই চাপ তুমি কীভাবে সামলাচ্ছ?

অনুষ্টুপ – এতদিন ধরে খেলছি, প্রতিটা ম্যাচেই মিডল অর্ডারের চাপ থাকে। তাদের ম্যাচ বানাতে হয়। প্রেশার তো থাকবেই, সেটা স্বাভাবিক। প্রতিটা ম্যাচেই দুরন্ত কিছু করতে হবে, এরকম চিন্তাভাবনা আমার নেই। জাস্ট প্রসেসটা ফলো করি। সেটাই মেইন পার্ট। আমার কাছে সাফল্যের চাবিকাঠি প্ল্যান আর প্রসেস।

বাংলার নতুন কোচ হিসেবে অরুণ লালের ভূমিকা ঠিক কেমন বলে মনে হয় তোমার?

অনুষ্টুপ – অরুণ লাল পুরো টিমের পুরো আবহ বদলে দিয়েছেন। এমন একটা পরিবেশ টিমে তৈরি করে দিয়েছেন যে, প্রত্যেকে তাদের ন্যূনতম অবদান রাখার চেষ্টা করছে। কেউ ব্যাটিং ভালো না করলে হয়তো সে ফিল্ডিং খুব ভালো করছে। তাঁর মতো মেন্টর এ-মুহূর্তে বাংলায় কেউ নেই। টেকনিক নিয়ে খুবই কম কথা বলেন। তাঁর মতে, মনের জোরটাই বিশাল প্রায়োরিটি পায় এসব খেলায়। আমাদেরকে মনের জোর বাড়াতে তিনি মোটিভেটও করেছেন।

আরও পড়ুন
‘২১ ফেব্রুয়ারি নিয়ে আমরা গর্বিত, অথচ ছেলেমেয়েদের ভর্তি করি ইংরাজি মিডিয়ামে’

দুটো ইনিংসে, ইডেন এবং কটক - কোনটার পিচের অবস্থা বেশি খারাপ ছিল? পরিস্থিতি কোন ক্ষেত্রে কঠিন ছিল?

অনুষ্টুপ- দুটো ম্যাচেই যে কন্ডিশনে ব্যাট করতে গেছি, উইকেটের অবস্থা একই ছিল। তখন বল বেশ ভালো মুভ করছিল । সকালদিকে উইকেটে ভালো বল মুভ করে, কিন্তু সেই সেশনটা কাটিয়ে ফেলাটাই শ্রেয়। আমার ক্ষেত্রে একটা সুবিধা, আমি পরে ব্যাট করতে যাই কিন্তু দুটো ম্যাচেই উইকেট পড়ে যাওয়ায় তাড়াতাড়ি ব্যাট করতে যেতে হয়েছিল। সেক্ষেত্রে এ-ধরণের প্রস্তুতি খুব জরুরি ছিল আমার ক্ষেত্রে।

অরুণলাল আসার পর প্রি ট্রেনিং সেশন দীর্ঘায়িত হয়েছে, তোমাদের ফিটনেস নিয়েও অরুণলালকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে্। সেই ফিটনেসের ট্রেনিং করে তোমার কতখানি উপকার হয়েছে?

অনুষ্টুপ- আমার ফিটনেস তো কুড়ি-বাইশ বছরের ছেলেদের মতো নয়, তাই এক্সট্রা ফিটনেসের খেয়াল করতে হত। ৫ জুলাই থেকে অরুণলাল খুব দৌড় করাতেন আর বলতেন, তুমি দৌড়াবে। কিন্তু দৌড়াতে দৌড়াতে ভাববে তুমি ম্যাচ জেতাচ্ছ, তুমি একশো করছ। সেরকমটাই আমরা ভাবতাম সবাই, সে কারণেই হয়তো প্রস্তুতি এমন হয়েছিল বলে আমার মনে হয়।

আরও পড়ুন
‘যে-কোনো প্রশ্ন করাকেই বন্ধ করতে চায় রাজনৈতিক দলগুলি’ – বলছেন সিএটি-তে প্রথম স্থানাধিকারী দেবর্ষি

বাংলা সার্কিটে অনেকেই বলে, ব্যাটিং স্টাইল, টেকনিকে তুমি তোমাদের ব্যাচে সবচেয়ে প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান ছিলে। কেরিয়ারের লাস্ট ল্যাপে এসে দাঁড়িয়ে, তোমার কি মনে হয়, যেটা অ্যাচিভ করার ছিল সেটা করতে পারোনি? নাকি তুমি ওভাবে ভাবোই না?

অনুষ্টুপ - না, একেবারে ওভাবে ভাবিই না কারণ গত এক দুই বছর ধরে বর্তমান নিয়ে ভাবতেই চেষ্টা করি। এখন আর দুঃখ করে লাভ নেই, ভাবলেই মন খারাপ হবে। ভবিষ্যতের কথাও ভাবি না, কী হবে কেউ জানে না। দুটো ম্যাচ আগে কী হত আর দুটো ম্যাচ পরেই বা কী হত, সেটাও কেউ জানে না। টিমকে জেতানোর জন্য যদি আমার একটুও অবদান থাকে, সেটাই ভালো লাগে।

তুমি লেগস্পিনটা কি একেবারে ছেড়েই দিলে?

এইরে! ছেড়ে দিলাম না। লেগস্পিনটা এ-বছর সবচেয়ে বেশি প্র্যাকটিস করেছিলাম, কিন্তু দেখছি ক্যাপ্টেনের কোনো ভরসা নেই। (হেসে)

আরও পড়ুন
আমার ছবিকে প্রভাবিত করেছে পিঙ্ক ফ্লয়েড, বিটলস, রবীন্দ্রনাথের গান

এমনি লেগস্পিনাররা পার্ট টাইম হয়ে গেলে ক্যাপ্টেনরা ভরসা করে না!

অনুষ্টুপ- সেটাই।

এবার কয়েকটা অন্য কথা বলি, অন্য প্রসঙ্গে, কিছুটা ব্যক্তিগত, দেখো সবারই একটা ব্যক্তিগত জীবন থাকে, তুমি তো কবীর সুমনের খুব ভক্ত, এখনও গিটার নিয়ে সময় পেলেই হয়ত বসে পড়ো, এই যে ক্রিকেটের বাইরে জীবন, একটা অন্যরকম দেখা, ক্রিকেটার অনুষ্টুপ মজুমদারকে এই জীবন ক্রিকেটকে দেখতে কীভাবে সাহায্য করেছে?

অনুষ্টুপ- খুবই, তুমি যদি একটা জিনিসেই ভাবতে থাকো বা ঐ নিয়ে চিন্তা করতে থাকো তাহলে অসুবিধে হয়। কারণ সেটা থেকেও ডিটাচমেন্ট দরকার। প্রত্যেকটা বল খেলার জন্য কনসেন্ট্রেট করতে হয়। বাকি খেলা হয়ে যাওয়ার পরও তুমি যদি ওই নিয়ে চিন্তা করতে থাকো, তাহলে নিজে রিল্যাক্স করতে পারবে না। রিল্যাক্স করাটা খুব দরকার। তুমি যে জিনিসটা পছন্দ করো, সেই জিনিসটায় রিল্যাক্স করা উচিৎ। অনেকে লাউড মিউজিক শোনে, অনেকে সেসব জায়গায় যায়। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে গান, সিনেমা দেখা, খেলা এগুলোই রিল্যাক্স।

আরও পড়ুন
ঋত্বিকবাবু পরিচালনা করলে ‘অযান্ত্রিক’-এ অভিনয় করতে চাই

এই পারফর্ম্যান্সের দুনিয়ায়, বিরাট কোহলি রানমেশিনে পরিণত হন, যেখানে দুটো ম্যাচ বাজে খেললেই গেল গেল রব ওঠে, সেখানে এই যে সাবেকি শিল্পবোধ নিয়ে ব্যাট করতে নামা… পারফর্ম্যান্স গুরুত্বপূর্ণ ঠিকই, কিন্তু ক্রিকেট খেলাটা যে সৌন্দর্য দিয়ে খেলতে হবে, সেটা কি তোমারও প্রায়োরিটি?

অনুষ্টুপ- দেখো, আগে খেলতে নামলে কিছু শট মারলে লোকে বাহবা দেবে বা চিত্তাকর্ষক কিছু শট খেলব, এসব ভাবতাম। কারণ ছোটো থেকে আমি যার ফ্যান, মার্ক ওয়, তাঁর ব্যাটিং দেখে মনে হত ক্রিকেট খেলাটা এত সহজ! ১৪০ কিমির বল এত সহজে খেলে দিচ্ছে! সেটা মনের মধ্যে ছিল। অবাক হতাম। সেসব দেখে খেলার চেষ্টা করতাম। কিন্তু এখন আর লোকে শট দেখে হাততালি দেবে বা বাহবা দেবে সেটা মাথায় থাকে না। হ্যাঁ, আমার খেলার স্টাইলটা হয়তো ওরকম। তুমি বলবে রোহিত শর্মার মত গা এলিয়ে অনায়াসে খেলার কথা। যে বলটা পূজারা চার মারবে, রোহিতও হয়তো সেটা চার মারবে। কিন্তু রোহিতের শটটা দেখতে হয়তো আরও বেশি ভালো লাগবে। একেকজনের খেলার নেচার একেকরকম।

আরও পড়ুন
‘এই পাটুলির মোড়ে দাঁড়িয়ে আমার কথাই বলছেন লালন’

রানটা গুরুত্বপূর্ণ, না সুন্দর ইনিংসটা জরুরি?

অনুষ্টুপ- বাইশ রানের ইনিংসে চারটে সুন্দর শট মারলেও, রান না করলে সেই ইনিংসটা দাম পাবে না। আমার ক্ষেত্রেও এরকম হয়েছে। ভি ভি এস লক্ষ্মণ আমাকে বলতেন, তোমার খেলার স্টাইলটা আমার মতো, ছোটো পায়ে খেলো।

তুমি কী এই কারণেই পরবর্তীতে স্টান্স চেঞ্জ করেছ?

অনুষ্টুপ- না। খুব সুন্দর শট মারতে হবে বা পাঁচবার ভিডিওতে শটটা দেখাবে এটা আর এখন আমি ভাবি না। পুরোটাই খেলতে হবে, শেষ পর্যন্ত আমাকেই ব্যাটিং করতে হবে। ‘শেষ পর্যন্ত তোমাকেই চাই’।

আরও পড়ুন
‘মনে কষ্ট নিয়ে সিনেমা বানিয়ে লাভ নেই’

সেমিফাইনালে যখন ৬৭ রানে ৬ উইকেট পড়ে গেল, শাহবাজ যখন ক্রিজে এল, তখন তোমার মাথায় কী কাজ করছিল? সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ জুনিয়র ক্রিকেটারদের কাছে।

অনুষ্টুপ- ঘাবড়ে গেলেই তুমি পিছিয়ে পড়লে। ঘাবড়ে যাওয়ার তো কিছুই নেই, যেখানে তোমার থেকে টিম আশা করছে তুমি টিমকে একটা ভালো জায়গায় তুলে আনবে রান করে তখন এত কিছু মাথাতেও থাকে না। প্রত্যেকটা বল প্রপার খেলতে পারছি কিনা, আমি সেটাতেই ফোকাস করছিলাম। এত রান করতে হবে বা এরকম শট মারব - আগে থেকে এসব ভাবতাম না। বলটা যেরকম আসবে তোমাকে সেরকমই খেলতে হবে। প্রত্যেকটা বল ঠিকমতো খেলার চেষ্টা করতে হবে।

এখনকার ক্রিকেটে অদ্ভুত কিছু অ্যাকশনে বল করলে বা দুটো সুইচ হিট মারতে পারলে কোটি টাকা দর পেয়ে যায় আইপিএল-এ, সেখানে তুমি মাত্র একটা আইপিএল খেললে পুণের হয়ে। তখন দাদি ক্যাপ্টেন ছিল। তারপর থেকে তুমি আইপিএল খেলতে পারলে না। তোমার মত প্রতিভা আর আইপিএল-এ খেলতে পারল না, এটা কি এখনও তোমাকে ভাবায়?

অনুষ্টুপ- না, আমি এখন ভালো আছি। টিমে যতদূর সুযোগ পেয়েছি, আমার মনে হয় আরও ভালো খেলার দরকার ছিল। টি টোয়েন্টির পার্ফম্যান্স আমার ততটা ভালো নয়। সেক্ষেত্রে কী হল বা কী হল না সেটা ভাবি না। আইপিএল-এ চান্স পাওয়াটা হঠাৎ করেই, অকশনেও ছিলাম না। হঠাৎ করে এই যে সুযোগ, এটাও তো একটা বড়ড়ো পাওয়া।

আরও পড়ুন
বড়ো চাকরি ছেড়ে ক্রিকেট, ভালোবাসেন গিটার ও সুমনের গান, অনুষ্টুপের জীবন তাঁর ব্যাটিং-এর মতোই ধ্রুপদী

রানের খিদে তো আছে এখনও মোটামুটি? আগামী বছর দুই-তিন তুমি কীভাবে এগোবে? তোমার প্ল্যানিংটা কী?

অনুষ্টুপ- হ্যাঁ আমার ভাবনাটা হল যে ফিটনেসের ওপর আরও জোর দেব। যদি ফিট থাকি, তাহলে আরও দুই তিন বছর টিমে খেলতে পারব।

টিমটাকে পেয়ে কী মনে হয়, চ্যাম্পিয়ন হতে পারবে?

অনুষ্টুপ- সবরকম রসদই তো আছে টিমে। এরকম কম্বিনেশন আমি লাস্ট কবে দেখেছি মনে পড়ছে না। পুরো টিমে স্পিনাররা যেমন বল করতে পারে, ততোধিক ভালো ব্যাট করতে পারে। যেমন আকাশ বোলিংটাও ভালো করে, ব্যাটিংটাও ভালো করতে পারে। মুকেশ আউটস্ট্যান্ডিং। খেলায় সবই অনিশ্চিত। অনিশ্চিত খেলাগুলোর মধ্যে ক্রিকেট অন্যতম।