“আমাদের সমাজ তো পুরুষতান্ত্রিক। তাই যুগ যুগ ধরে পৌরোহিত্য ও শাস্ত্রীয় আচার পুরুষরাই করে আসছে। আমরাও সেটা মেনে এসেছি। তবে এখন মেয়েরা সংস্কৃত ভাষা, বিষয় নিয়ে চর্চা করছে। আমরাও করেছি। কাজেই মেয়েরা যে এই পৌরোহিত্যের কাজ করবে না, পারবে না; সেইরকম কোনো নিয়মে আবদ্ধ হতে চাইনি কেউ।”
আরও পড়ুন
জাতিভেদের বিরুদ্ধে লড়াই, ‘অস্ত্র’ মেয়েদের ফুটবল ক্লাবও – দিনবদলের স্বপ্ন বুনছেন প্রতিমা
প্রহরকে বলছিলেন নন্দিনী ভৌমিক। দীর্ঘ এক দশক ধরে নানা জায়গায় পুরোহিতের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। হ্যাঁ, তিনিই বাংলার অন্যতম মহিলা পুরোহিত। যে কাজে আমরা সবাই দেখে এসেছি ‘পুরুষ ব্রাহ্মণদের’, সেখানেই তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। সম্প্রতি নন্দিনী ভৌমিকদের এই কাজ নিয়েই মুক্তি পেতে চলেছে অরিত্র মুখোপাধ্যায়ের নতুন সিনেমা ‘ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি’। আরও বৃহৎ পরিসরে পৌঁছে যাবে তাঁদের এই উদ্যোগের কথা...
আরও পড়ুন
কবিতাই অস্ত্র তাঁর, বিশ্বের দরবারে আদিবাসী স্বর পৌঁছে দিচ্ছেন ঝাড়খণ্ডের তরুণ কবি
পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতায় বদল আনার কাজটা যে খুব সহজ ছিল, তা নয়। সংস্কৃত নিয়ে পড়াশোনা করেছেন লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে, পরে করেছেন অধ্যাপনাও। কলেজে পড়াকালীন শিক্ষিকা হিসেবে পেয়েছেন গৌরী ধর্মপালকে। তাঁর কাছ থেকেই বৈদিক বিবাহ ও মন্ত্রাদির রীতিনীতি শেখা। তবে পুরো ব্যাপারটাই হয়েছিল অদ্ভুতভাবে। তখন জীবনে প্রতিষ্ঠিত নন্দিনী দেবী। তাঁর সহপাঠীরাও একইভাবে কাজ করছেন অন্যান্য জায়গায়। সেই সময় আবার প্রিয় ‘দিদি’র সঙ্গে যোগাযোগ হয় তাঁদের। তখন গৌরী ধর্মপাল নিজেও এমন মেয়েদের খুঁজছিলেন, যাঁদের মাধ্যমে বৈদিক বিবাহের পৌরোহিত্যের যে কাজ শুরু করেছিলেন, সেটি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়।
আরও পড়ুন
স্বনির্ভরতাই যথেষ্ট নয়, উদ্যোগপতি হয়ে উঠুক গ্রামের মেয়েরা – অন্যরকম লড়াই শিবানীর
দিদির প্রস্তাব মনে ধরে নন্দিনীরও। নিজেও তো শাস্ত্র পড়েছেন মন দিয়ে। পুরুষরাই যে কেবলমাত্র পুরোহিত হতে পারে, মেয়েরা পারে না— এমন তো কোথাও বলা নেই! এই ভাবনা থেকেই পথ চলা শুরু তাঁদের। নন্দিনী পাশে পেলেন সহপাঠী রুমা রায়’কে। গৌরী ধর্মপালের কাছেই শিক্ষা শুরু। কিন্তু তথাকথিত বীজমন্ত্র দিয়ে শিক্ষা নয়, এ যেন আবার সেই কলেজের দিনগুলোয় ফিরে যাওয়া। ধরে ধরে সংস্কৃত মন্ত্রোচ্চারণ শেখানো; শুধু তাই নয়, সঠিক উচ্চারণে ও উচ্চগ্রামে সেটা পড়া— এইসবই ছিল শিক্ষার অংশ। মন্ত্র তো সবার, সেটা ঠিক করে উচ্চারণ করতে পারলে সেটার প্রয়োগে এত বাধা-নিষেধ কেন!
আরও পড়ুন
ধর্মের ভিতর থেকে গোঁড়ামির বিরোধিতা, শাহিনা জাভেদ এক অন্যস্বরের নাম
২০০৯ সাল থেকে প্রথম বিয়ের পৌরোহিত্য করা শুরু করেন নন্দিনী ভৌমিক। চলার পথটি যে সুখের ছিল, তা নয়। একজন ‘মহিলা পুরোহিত’ বিয়ে দেবেন, এই ব্যাপারটাই বেশ আশ্চর্যের। মানতেও পারেন না অনেকে। মেয়েরা আবার এসব করে নাকি! কিন্তু সেসব শুনলে তো আসল কাজ হবে না। “সমাজের ধারণা, পুরোহিত মানেই পুরুষ। এই ধারণাই এতদিন চলে এসেছে। এটায় বদল আনতে গেলে তো একটু ধৈর্য ধরতে হবে। সময় দরকার। আমরা সেটাই করার চেষ্টা করেছি। আমাদের কোনো লড়াই নেই। বরং যখনই প্রয়োজন হয়েছে, যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছি সবটা”, বলছিলেন নন্দিনী। কথাগুলো বলার সময় তাঁর গলায় ছিল একটা অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস। এই বিশ্বাসই যে পাথেয় আমাদের। সমাজের তথাকথিত ‘বাঁধা নিয়ম’-এর বাইরে এই পদক্ষেপে সেটা যে খুবই প্রয়োজনীয়…
আরও পড়ুন
গোটা দেশে, এমনকি কলকাতায় আজো প্রকাশ্যে বিকোচ্ছে অ্যাসিড, লড়াই থামেনি, বলছেন লক্ষ্মী আগরওয়াল
বিয়ের অনুষ্ঠান দিয়ে শুরু করলেও তাতেই থেমে থাকেনি সবটা। বিগত তিন-চার বছরে অন্যান্য অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নিতেও শুরু করেছেন। নিজেরাও পড়াশোনা করেছেন এই নিয়ে। একটা সময় সেরকম ডাক না আসলেও, আজ নানা জায়গা থেকে ডাক আসে নন্দিনী-রুমার। পারলৌকিক কাজও করেন তাঁরা। সম্প্রতি নবনীতা দেবসেনের পারলৌকিক কাজও তাঁরা সম্পন্ন করেছেন। তবে উপনয়নের কাজ করেন না। “উপনয়নের যে প্রয়োজনীয়তা বা মাহাত্ম্য, সেটার সঠিক বোধ আমাদের মধ্যে নেই। এর ভেতরের তাত্ত্বিক ব্যাপারটুকু আমরা অনুধাবন করতে পারি না। সেটা না বুঝিয়েই অনুষ্ঠান করা হয়। অন্যান্য অনুষ্ঠানবাড়ির মতোই যেন এটা, লোকে আসবে খাবে, ছেলে উপহার পাবে। কিন্তু এর গভীরতা বোঝার বড় অভাব”, জানান নন্দিনী।
আরও পড়ুন
১৪৩ বছর আগে ফরাসি ভাষায় সাহিত্যচর্চা বাঙালি তরুণীর, অকালপ্রয়াণে থেমেছিল সব
আজ নন্দিনী ভৌমিক, রুমা রায়রা পরিচিত হয়েছেন বাংলায়। তাঁদের দলও দুই থেকে বেড়ে হয়েছে চার। যোগ দিয়েছেন দুই রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী, সেমন্তী ও পৌলমী। হ্যাঁ, ‘পুরোহিত’ নন্দিনী দেবীর যাবতীয় অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন এই এঁরাও। বিয়ের আসরে বৈদিক মন্ত্রের সঙ্গে গীত হন রবীন্দ্রনাথ। এমনটা কেন? নন্দিনী জানান, “রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিস্তৃতি অনেক বড়ো। অনেক ব্যাপক। যেহেতু আমরা বৈদিক সাহিত্য থেকে মন্ত্রগুলো নিই, আর রবীন্দ্রনাথের গানগুলোও সেই বেদকেই ছুঁয়ে যায়। তাই আমরা প্রধানত রবীন্দ্রসঙ্গীতই ব্যবহার করি।”
আরও পড়ুন
থই পাননি আবিষ্কারকও, ১১৭ বছরের ধাঁধার সমাধান করেছিলেন এক ভারতীয়
নিজেদের জীবনেও বাঙালি রবি ঠাকুরকে জড়িয়ে ধরে থাকে। তাদের অনুষ্ঠানেও এভাবেই হাজির হন তিনি। হাজির হন নন্দিনী ভৌমিকরাও। তাঁদের কাছে মন্ত্রের শুদ্ধতা, পবিত্রতাই সবথেকে বড়ো। আর প্রশ্ন এলে তো তৈরিই থাকেন তাঁরা। লড়াই নয়, এভাবেই সমাজের মধ্যে থেকে, কাজ ও শিক্ষার মাধ্যমে নিজেদের কথা পৌঁছে দেবেন সমস্ত জায়গায়। আসন্ন সিনেমা তাঁদের সেই উদ্যোগকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে, এটাই তাঁদের বিশ্বাস। আরও নতুন নতুন মেয়েরা এখানে আসবে, ভালোভাবে শিখে তারপর তাঁরাও নিজেদের জায়গা করে নেবে পুরোহিত সমাজে, এটাই তো চান নন্দিনী ভৌমিক। এক সময় ঠিক যেটা চেয়েছিলেন তাঁর শিক্ষক দিদি গৌরী ধর্মপাল…