‘এলজিবিটিকিউ-দের জীবন-নির্ভর সিনেমাকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজ কাশিশ করতেই থাকবে। একই সঙ্গে, সারা বিশ্বের এলজিবিটিকিউ সিনেমাকে ভারতে আনা এবং ভারতের সিনেমাকে সারা বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেওয়ার কাজও করব আমরা। এককথায়, ভারতের এলজিবিটিকিউ সিনেমার পতাকা উঁচু রাখতে আমরা পিছপা হব না।’
প্রহরকে বলছিলেন শ্রীধর। শ্রীধর রঙ্গায়ন। তাঁর মনে হয়েছিল, এই গল্পগুলোও বলা দরকার। সিনেমা যদি কোনো প্রেমের গল্প বোনে, তা কেন শুধুমাত্র বিষমকামীই হবে? তা মূলস্রোতের বলে? সমাজস্বীকৃত বলে? তার বাইরেও না-বিষমকামী প্রেমের একটা বড় জগৎ আছে। তার নিজস্ব গল্প আছে, সম্পর্ক আছে, সম্পর্কহীনতাও আছে বইকি। আছে ঘর বাঁধতে চাওয়ার ইচ্ছেও। এমন নয় যে, পৃথিবীজুড়ে অসংখ্য সিনেমায় এই গল্পগুলো উঠে আসছে বহুদিন ধরেই। ভারতেও আস্তে আস্তে ছকভাঙা সিনেমা হচ্ছে। হচ্ছে, কিন্তু উৎসব? ‘কাশিশ’ ছিল তেমনই একটি চেষ্টা।
সেই চেষ্টারই অংশ হিসেবে, আগামী ২১-২২ জানুয়ারি কাশিশের উদ্যোগে ভারতের আটটি শহরে আয়োজিত হতে চলেছে একটি প্রিমিয়ার। কলকাতা, মুম্বাই, নিউ দিল্লি, ব্যাঙ্গালোর, হায়দ্রাবাদ, পুনে, নাগপুর আর চণ্ডীগড় – এই আটটি শহর একই দিনে আন্দোলিত হবে কাশিশের সৌজন্যে। উপলক্ষ, ‘বেস্ট অফ কাশিশ’। চারটি শর্ট ফিল্ম মুক্তি পাবে এই প্রিমিয়ারে। এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়ে বোনা গল্প। ভারতে প্রথমবার কোনো মুভি থিয়েটারে মুক্তি পাবে এলজিবিটিকিউ-দের নিয়ে তৈরি শর্ট ফিল্ম। ঐতিহাসিক ঘটনা তো বটেই!
আরও পড়ুন
ধর্মের ভিতর থেকে গোঁড়ামির বিরোধিতা, শাহিনা জাভেদ এক অন্যস্বরের নাম
যে চারটি শর্ট ফিল্ম দেখানো হবে, তা হল – ‘আ মনসুন ডেট’(পরিচালক – তনুজা চন্দ্র), ‘ইউ ফর ঊষা(পরিচালক – রোহন কানাওয়াডে), ‘দ্য ফিশ কারি’(পরিচালক – অভিষেক ভার্মা) এবং ‘লাডলি’(পরিচালক – সুদীপ্ত কুণ্ডু)। কলকাতার যশোর রোড পিভিআর, অর্থাৎ ডায়মন্ড প্লাজায় স্ক্রিনিং হবে এই শর্ট ফিল্মগুলির। অন্যদিকে, কাশিশের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে ‘ভিকাও’ অনলাইন টিকিট বুকিং-এর ওয়েবসাইট-টিও। সেখান থেকেই টিকিট কাটতে পারছেন দর্শকরা। এবং, আজ থেকে বুকমাইশো-তেও পাওয়া যাবে ‘বেস্ট অফ কাশিশ’-এর টিকিট।
কলকাতায় 'কাশিশ'-এর এই উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন 'প্রান্তকথা'ও। এই নিয়ে তৃতীয় বছর তারা যৌথভাবে এমন আয়োজন করল। উদ্দেশ্য একটাই, মূলস্রোতের সিনেমা হলগুলিতে যেন এই ধারার সিনেমা দেখতে সব ধরণের মানুষই আসতে পারে। নইলে এলজিবিটি-দের জীবনের প্রেম 'অপর' হয়েই থেকে যাবে চিরকাল। কিন্তু প্রান্তকথা চায় না, তারা 'অপর' হয়েই থেকে যাক। সে-কারণেই এমন উদ্যোগে নিজেদের শামিল করেছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি।
প্রহরকে তাঁদের শর্ট ফিল্ম সম্পর্কে জানিয়েছেন চারজন পরিচালকই। কেন এই প্রয়াস, কোন ভাবনা তাঁদের অনুপ্রাণিত করেছে - এসবই অকপটে জানিয়েছেন তাঁরা। সঙ্গে রয়েছে ফেস্টিভ্যাল ডিরেক্টর শ্রীধর রঙ্গায়নের বক্তব্যও। শুনে নিন, কী বলছেন তাঁরা -
নিজের শর্ট ফিল্মটি সম্পর্কে পরিচালক তনুজা চন্দ্রা বলছিলেন, ভালোবাসা আসলে একটা লড়াই, একটা সংগ্রাম। আমাদের সূত্র যাই হোক না কেন, যে সম্প্রদায় থেকেই আসি না কেন আমরা, দিনের শেষে ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার সকলেরই আছে। সিনেমাটিও কি এমন বিষয়ের ওপরই তৈরি? তনুজা বললেন – ‘এটি একটি মেয়ের গল্প, যে জীবনের কিছু পরিবর্তনের পর, ভালোবাসতে ভয় পাচ্ছে। ইনসিকিউরিটি তৈরি হচ্ছে তার মনে। মেয়েটি ভাবছে, সে যাকে ভালোবাসে, সেই অপরজনও তাকে সমান ভালোবাসবে তো? হয়তো দুজনেই একই সামাজিক পরিস্থিতিতে রয়েছে। তবু, তারপরেও, গণ্ডি ভেঙে কি বেরিয়ে আসতে পারবে তারা?’ তনুজার মনে হয়, ভালোবাসা এমনই এক মোহ, জীবনে অপর একটি মানুষের প্রয়োজনীয়তা এতটাই তাড়িত করে যে, তা মাঝেমধ্যে পাহাড় চড়ার মতো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
সম্পর্কের কাছে জীবনের চ্যালেঞ্জও তো আসলে এটাই, তাই না?
তনুজার শর্ট ফিল্মটি আগে কাশিশ চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয়েছিল। সেখানে বিপুল জনসমাদর পেয়েছিলেন তিনি। আর তারপর, এই নির্বাচিত চারটি শর্ট ফিল্মের একটি তাঁরই ‘আ মনসুন ডেট’। তাঁর মনে হয়, এই ‘বেস্ট অফ কাশিশ’ উদ্যোগটি ভারতীয় চলচ্চিত্রকারদের আরও অনুপ্রাণিত করবে। পাশাপাশি, অনেকে এগিয়েও আসবেন, এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়ে সিনেমা তৈরি করতে।
কিন্তু এই যে বিপুল আয়োজন, তাকেও তো অতিক্রম করতে হয়েছে দীর্ঘ পথ। শুরু কবে? শ্রীধর বলছিলেন, ২০১০ সালের ২২-২৫ এপ্রিল মুম্বাইয়ে প্রথমবারের মতো আয়োজিত হয় ‘কাশিশ মুম্বাই ইন্টারন্যাশানাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’। ‘কাশিশ’ শব্দটির বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায় – ‘আকর্ষণ’। হ্যাঁ, শ্রীধর তো একরকম আকর্ষণেরই চেষ্টা করছেন। সাধারণ মানুষকে। চাইছেন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে। এলজিবিটি-রাও যে আলাদা নন কারোর থেকে, তা বোঝাতে চেয়েছেন তিনি। বারবার প্রথমবারের সেই চলচ্চিত্র উৎসবের পর কেটে গেছে একটা দশক। ১১তম বছরে পা দিতে চলেছে এবার, মে মাসে।
আরও পড়ুন
গোটা দেশে, এমনকি কলকাতায় আজো প্রকাশ্যে বিকোচ্ছে অ্যাসিড, লড়াই থামেনি, বলছেন লক্ষ্মী আগরওয়াল
তবে কোনো ঘটনা-পরম্পরা ছাড়াই যে শুরু হয়ে গেল একটা চলচ্চিত্র উৎসব, এতও সহজ নয় ব্যাপারটা। জানতে হলে ফিরে যেতে হবে ২০০৯ সালে। সে-বছর জুলাই মাসে, দিল্লি হাই কোর্ট যখন সমকামিতাকে বৈধ হিসেবে রায় দেয়, দীর্ঘদিনের একটা বন্ধ দরজা যেন খুলে গিয়েছিল এক লহমায়। শ্রীধর চেয়েছিলেন একটি চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজন করতে, যা এক ও একমাত্র এলজিবিটি-দের কথাই বলবে। সিনেমা, শর্ট ফিল্ম, ডকুমেন্টরির মাধ্যমে তিনি পৌঁছে যেতে চেয়েছিলেন প্রত্যেক মানুষের কাছে। বোঝাতে চেয়েছিলেন, এলজিবিটিরা সমাজছাড়া, গোত্রছাড়া কেউ নন, আর পাঁচজনের মতো সাধারণ মানুষ।
তারপরই ২০১০-এ প্রথমবারের মতো আয়োজিত হয় ‘কাশিশ মুম্বাই ইন্টারন্যাশানাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’। প্রহরকে এসবই জানাচ্ছিলেন শ্রীধর। তাঁর পরিচয় শুধু ‘ফেস্টিভ্যাল ডিরেক্টর’-এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এই কেজো পদের বাইরেও রয়েছে এক আন্তরিকতা। উৎসাহ। বলা ভালো, ‘কাশিশ’। সেই কাশিশের টানেই তিনি ছুটে বেড়াচ্ছেন সর্বত্র, চালিয়ে যাচ্ছেন লড়াই। সেই লড়াইয়ের শরিক হল প্রহরও।