বিংশ শতকের গোড়ার কথা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি এ পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এক যুবক। সান্নিধ্য পেয়েছেন ডঃ দীনেশচন্দ্র সেনের। ছাত্রটির প্রতি তাঁর অনেক আশা। পড়াশোনায়ও মনোযোগী, তার ওপর সুন্দর কবিতা লেখে। এমন সময়ই ওই যুবকটির একটি কবিতা প্রকাশিত হল। যথারীতি সেটা পড়লেনও দীনেশচন্দ্র। তারপর আর কিছু বলতে পারলেন না। এত আবেগ, এত মাটির স্পর্শ, এত ঘরোয়া ছোঁয়া ছড়িয়ে আছে তাঁর ছাত্রের লেখায়? যুবকটিকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “তোমার কবিতাটি পড়ে আমি কেঁদেছি।” শুধু এতেই ক্ষান্ত থাকলেন না দীনেশচন্দ্র। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে ওই কবিতা পাঠ্য করলেন তিনি। ছাত্রাবস্থাতেই একজনের লেখা বাংলার পাঠ্যবইতে স্থান পাচ্ছে, এমন ঘটনা বিরল। অবশ্য হওয়ারই মতো। আজও যুবকটির সেই কবিতাটি আমরা প্রত্যেকে ছাত্রজীবনে পাঠ করেছি। তাকে জানতে শিখেছি। কবিতাটি হল—
আরও পড়ুন
কলেজ স্ট্রিটের ফরমায়েশি কাজ থেকে নিজস্ব ক্যানভাস – ছবির মতো লড়াকু তাঁর জীবনও
“ওইখানে তোর দাদির কবর ডালিম গাছের তলে,
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।”…
এতক্ষণে মানুষটিকে চিনে নেওয়া গেছে। ‘কবর’ কবিতাটির মধ্যে দিয়েই যে আপামর বাংলার ছোটো ছেলেমেয়েদের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন জসীম উদ্দীন! অবশ্য শুধু এই একটি লেখাই নয়, বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় তাঁর অমরত্ব নিয়ে কারোরই কোনো সংশয় নেই।
আরও পড়ুন
রবীন্দ্রনাথের বড়দা তিনি, অগোছালো, পাণ্ডুলিপির ছেঁড়া পাতা ছড়িয়ে থাকত জোড়াসাঁকোয়
জসীম উদ্দিনের কথা বললেই এসে পড়ে ‘নকশি কাঁথার মাঠ’-এর কথা। ১৯২৯ সালে প্রকাশিত এই বইটি পড়ে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এতটাই অভিভূত হয়েছিলেন যে, পরে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বইটির ভূমিকাও লিখতে বলেন। অবন ঠাকুরও অবশ্য সমান মুগ্ধ ছিলেন। ‘নকশি কাঁথা’র ভূমিকায় লিখেছিলেন- “নকশী কাঁথার মাঠ রচয়িতা শ্রীমান জসীমউদ্দীন নতুন লেখক, তাতে আবার গল্পটি নেহাতই যাকে বলে ছোট্ট এবং সাধারণ পল্লী জীবনের। শহরবাসীদের কাছে এই বইখানির সুন্দর কাঁথার মতো করে বোনা লেখার কতটা আদর হবে জানি না। আমি এটিকে আদরের চোখে দেখেছি। কেননা এই লেখার মধ্য দিয়ে বাংলার পল্লী জীবন আমাদের কাছে চমৎকার একটি মাধুর্যময় ছবির মত দেখা দিয়েছে। … জানি না, কিভাবে সাধারণ পাঠক এটিকে গ্রহণ করবেন, হয়তো গেঁয়ো যোগীর মতো এই লেখার সঙ্গে রচয়িতা এবং গল্পের ভূমিকা লেখক আমিও কতকটা প্রত্যাখ্যান পেয়েই বিদায় হব।” সেটা যে হয়নি, তা বলাই বাহুল্য।
আরও পড়ুন
বিদেশে গবেষণার চাকরি ছেড়ে জৈব খামারের উদ্ভাবক, শিকড়ের টানে ডা. হরি নাথ
ফরিদপুরের এই যুবকটিকে রবীন্দ্রনাথ আমন্ত্রণও জানিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে। তখন জসীম উদ্দীন এম এ পড়ছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এখানেও তাঁর শিক্ষক ও গুরু ছিলেন ডঃ দীনেশচন্দ্র সেন। ওখানে না করে, শান্তিনিকেতনে এসে যাতে স্নাতকোত্তরের পড়াটা চালিয়ে যান, সেটারই কথা বলেছিলেন রবি ঠাকুর। তখন জসীম উদ্দীন ২৬ বছরের যুবক। বিনীতভাবে গুরুদেবকে জানালেন যে, তিনি শান্তিনিকেতন আসতে পারছেন না। বিনীত, কিন্তু দৃঢ়। এদিকে দীনেশচন্দ্রও বারণ করছেন ওখানের অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে যেতে। তাঁর সঙ্গে ঘুরে ঘুরে লোকসাহিত্য সংগ্রহের কাজও যে করছেন জসীম উদ্দীন। বিনিময়ে মিলছে ৭০ টাকাও। সেটা ছেড়ে যাওয়া কি উচিত? এত কিছু ভেবে ফিরিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথের আহ্বান। যেটাই করেছেন, নিজে ভেবে, মন থেকে করেছেন। তাই তো মাটিকে এত ভালোভাবে চিনতে পেরেছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন
বিশ্বযুদ্ধের গুপ্তচর তিনি, মৃত্যু জার্মানদের হাতে, ভারতীয় বংশোদ্ভূত নূরের সম্মানে ব্লু প্লাক
তবে ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক থেকে গিয়েছিল তাঁর। রবীন্দ্রনাথ তো বটেই, অবনীন্দ্রনাথেরও কাছের ছিলেন তিনি। ‘নকশি কাঁথা’র কবি নিজেও তো ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করতেন সেসব। উল্টোদিকে ছিলেন আরেক শিল্পী। অবন ঠাকুরেরও যে বিশাল সংগ্রহ ছিল এসবের। তাই বোধহয় ‘নকশি কাঁথার মাঠ’-কে এতটা মনে ধরে রেখেছিলেন তিনি। রেখেছিলেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরও। বইটির ছবি করতে চাইলে অবনীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “নকশি কাঁথার কবিতা অন্য ধরনের। আমি ছাড়া এর ছবি আর কেউ আঁকতে পারবে না।” পরে গগন ঠাকুরও ছবি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, কোনোটাই হয়নি।
আরও পড়ুন
মাস্টারদার পরেই তিনি, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের ‘সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড’ অম্বিকা চক্রবর্তী
একদিন হঠাৎ করেই একটি নাটক লিখে ফেললেন জসীম উদ্দীন। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়লেন জোড়াসাঁকো। রবীন্দ্রনাথকে দেখালেন। আবদার, আরও একটি প্লট দিতে হবে। রবীন্দ্রনাথ দেখলেন, এই ছেলে তো নাছোড়বান্দা! তখন একটি অন্য নাটকের প্লট বলেন কবিগুরু। সেটা মাথায় রেখে একটি নতুন নাটক লেখেন জসীম উদ্দীন। কিন্তু তখন আর রবীন্দ্রনাথকে দেখানোর সুযোগ নেই। মারা গেছেন তিনি। পরবর্তীতে এই নাটক যে সবার কাছে সমাদৃত হয়েছে, পৌঁছে গেছে ঘরে ঘরে; দেখে যেতে পারলেন না সেটা। নাটকটির নাম ‘পল্লীবধূ’।
আরও পড়ুন
১৪৩ বছর আগে ফরাসি ভাষায় সাহিত্যচর্চা বাঙালি তরুণীর, অকালপ্রয়াণে থেমেছিল সব
ফরিদপুরে জসীম উদ্দিনের পরিবারের সঙ্গে বিশেষ পরিচয় ছিল সেন পরিবারেরও। সেই পরিবারেরই একটি ছেলে ছিল তাঁর বন্ধু। জসীম যখনই কবিতা লিখত, বন্ধুটি সেটা নিয়ে গিয়ে দেখাত ওর বাবাকে। বাবা বলতেন, “লেখাটি তো চমৎকার। কিন্তু বানান এত ভুল কেন?” এই করেই সখ্য তৈরি হয়েছিল ওই পরিবারটির সঙ্গে। পরবর্তীতে দেশভাগের পরেও সেই যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ ছিল। ফরিদপুরের সেন পরিবারের ওই ছেলেটির নাম আজ সবাই জানে। বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমার অন্যতম দিকপাল তিনি— মৃণাল সেন!
আরও পড়ুন
প্রশ্নেই রয়েছে গলদ, আচার্য সুনীতিকুমারের ভুল ধরিয়ে দিলেন ছাত্র সুকুমার সেন
ঘনিষ্ঠতা এতটাই ছিল যে, মৃণালের মা’কেও নিজের মা-ই মনে করতেন জসীম উদ্দীন। ‘মা’ বলে ডাকতেনও। স্মৃতিচারণে একটি ঘটনার কথাও উল্লেখ করেছিলেন ‘কলকাতা ৭১’-এর পরিচালক। পুজোর পর মা সবাইকে খেতে ডেকেছেন। এসেছেন জসীম উদ্দীনও। সবাই রান্নাঘরে বসে খাচ্ছেন। কিন্তু জসীম কোথায়? জানা গেল, তাঁকে মৃণালের মা নিজের ঘরে আসন পেতে খেতে দিয়েছেন। এই বিভাজন কেন? ধর্মে ধর্মে এমন ভেদ কোনোদিনও মেনে নেননি তিনি। জবাবে মা বলেছিলেন, “আমি যদি তোমাকে ওদের সঙ্গে বসে খেতে দিই, তাহলে কাল থেকে আর ঠাকুররা রান্নাঘরে ঢুকবে না। তার চেয়ে ভালো, আমি নিজের হাতে বসে তোমাকে খাওয়াচ্ছি।”
আরও পড়ুন
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে একই বছরে জন্ম, বিস্মৃতির অতলে ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়
দেশভাগ দূরত্ব তৈরি করলেও, এমন মা-ছেলের সম্পর্ককে মুছে ফেলতে পারেননি। মৃণাল সেনের মা তখন খুবই অসুস্থ। এদিকে বাংলাদেশও স্বাধীন হয়েছে কিছুদিন হল। তখন একটা কাজে কলকাতায় এলেন জসীম উদ্দীন। ব্যস, খবর পেয়ে মায়ের জেদ, ছেলের সঙ্গে দেখা করবেনই। আর কবে সুযোগ আসবে! মৃণাল সেন তখন দিল্লিতে; ছবির শুটিংয়ের কাজে। সঙ্গে সঙ্গে কলকাতায় চলে এলেন তিনি। জসীম উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি চলে এলেন বাড়ি। মা সিঁড়ি বেয়ে নামছেন অসুস্থ শরীরে, ছেলে উঠছেন। মাঝপথে দেখা হল দুজনায়। একে অপরকে জড়িয়ে ধরলেন। জসীমের গলা দিয়ে বেরিয়ে এল একটাই আওয়াজ- ‘মা!’ কাঁটাতার কি এই টান মুছতে পারে? পেরেছে কোনোদিনও?
আরও পড়ুন
থই পাননি আবিষ্কারকও, ১১৭ বছরের ধাঁধার সমাধান করেছিলেন এক ভারতীয়
এরকমই ছিলেন জসীম উদ্দীন। মাটির মানুষ; যার প্রতিটা শ্বাসে জড়িয়ে আছে বাংলা মাটির গন্ধ। বাংলা সাহিত্যে চিরস্মরণীয় স্থান তো পেয়েছেনই, জীবনকালে নানা সম্মানেও ভূষিত হয়েছিলেন। কিন্তু এই যে সম্পর্কের মাধুর্য, তার বেদনা, কষ্ট, সেসব কি ভোলা যায়? তা না হলে কি কখনও লেখা হত ‘কবর’ কবিতাটি? জসীম উদ্দীন যে আসলে আদ্যোপান্ত বাংলার কবি…