প্রশ্নেই রয়েছে গলদ, আচার্য সুনীতিকুমারের ভুল ধরিয়ে দিলেন ছাত্র সুকুমার সেন

তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্বয়ং আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। একদিন হঠাৎই আগে থেকে কিছু না জানিয়ে চলে গেলেন উপাচার্যের ঘরে। সঙ্গে তাঁর এক ছাত্র। বলা ভালো, সুযোগ্য ছাত্র। এত মেধা এই ছেলের, অথচ বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা করবে না, তা হয় নাকি কখনও? ছাত্রের বায়োডেটা বের করে উপাচার্যকে নিজেই আবেদন করলেন। এদিকে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে দেখে মনে হচ্ছে, তিনি সেরকম আগ্রহী নন এই বিষয়ে। জানালেন, আপাতত পাটনা যাচ্ছেন। ফিরে এসে ভেবে দেখবেন। কিন্তু সেটাই ছিল বাংলার বাঘের শেষ পাটনা যাত্রা। সেখানেই মারা যান তিনি। ওই ছাত্রের বাইরে যাওয়া আর হল না।

আরও পড়ুন
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে একই বছরে জন্ম, বিস্মৃতির অতলে ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়

সে না হয় হল না। কিন্তু তার জন্য এতটুকুও আফসোস নেই ছেলেটির। জীবনের কোনো সময়ই সেই আক্ষেপ করেননি। বরং এই বাংলায় থেকেই নিজের সমস্ত গবেষণা, কাজ করেছেন— এটা নিয়ে রীতিমতো গর্ব ছিল তাঁর। বিদেশে না গেলেও, বিদেশ নিজেই তাঁর কাছে ছুটে এসেছিল। বাংলার ভাষাতাত্ত্বিক এবং সাহিত্য-গবেষক সুকুমার সেনের জ্ঞান আর প্রজ্ঞার আকর্ষণ যে কম ছিল না!

আরও পড়ুন
থই পাননি আবিষ্কারকও, ১১৭ বছরের ধাঁধার সমাধান করেছিলেন এক ভারতীয়

একদম ছোটোবেলায় খেলতে খেলতে দাদার কোমরে গোঁজা চাবি দেখে প্রশ্ন করেছিলেন ছোট্ট ভুনে। “এটা কী?” ঘটনাটা তাঁর ভবিষ্যতের প্রতীকী হিসেবে ধরা যেতেই পারে। ভাষা, ইতিহাস, সাহিত্য— মণিমুক্তোয় ভরা এই বাক্স খোলার চাবির সন্ধানই করে গেছেন আজীবন। শুধু ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’ আর ‘ভাষার ইতিবৃত্ত’-এর চিরস্মরণীয় গবেষক, লেখক হিসেবে নয়। তাঁর মেধা, পাণ্ডিত্য, গবেষণা; সর্বোপরি শিক্ষক হিসেবে তাঁর ভূমিকা ইতিহাসের অঙ্গ হয়ে থাকবে।

আরও পড়ুন
‘এসবই ওঁর বুজরুকি’ – রামকৃষ্ণকে প্রথমবার দেখে বলেছিলেন গিরিশ ঘোষ

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে। বলা যায়, তাঁর ‘মানসপুত্র’ ছিলেন সুকুমার সেন। সারা জীবন তাঁকেই মেনে এসেছেন তিনি। এই ছাত্রটিকে নিয়ে গর্বও ছিল সুনীতিবাবুর। তাঁকেও ছাড়েননি সুকুমার। একবার এক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র তৈরি করেছিলেন সুনীতিকুমার। তখনই স্যারের একটি প্রশ্নের ভুল খুঁজে বের করেন সুকুমার। রীতিমতো যুক্তি দিয়ে বোঝানও তিনি। না, একফোঁটাও রাগ করেননি সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। বরং তাঁর প্রিয় ছাত্রটির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন আরেক পণ্ডিতের, মুহম্মদ শহীদুল্লাহের। এই সুনীতিকুমারের হাত ধরেই বিশ্বকে চেনা।

আরও পড়ুন
নিরক্ষর ক্রীতদাস তিনি, অঙ্কের জাদুতে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন সবাইকে

বাড়িতে ছিল বইয়ের পাহাড়। কাজের সময়, বিশ্রামে এমনকি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা থেকে অবসর গ্রহণের পরও দিনের অনেকটা সময় কাটত সেই বইয়ের ভিড়েই। আসলে চর্চার মধ্যে কোনোদিনও কোনো ফাঁকি মানতে পারেননি তিনি। নিজের ক্ষেত্রে তো বটেই, ছাত্রদের ক্ষেত্রেও নয়। তিনি নিজেই বলতেন, “ইতিহাসের পথে এগোতে হলে তথ্যের পাথেয় চাই। যুক্তির যষ্টির অবলম্বন চাই।” তাই যখন ‘রামকথার প্রাক-ইতিহাস’ লেখার কথা ভাবলেন, তখন শুরু থেকেই এই ‘যুক্তির যষ্টি’কেই সঙ্গে নিয়েছিলেন। কখনও ধর্মবিশ্বাসীর কথা আনতেন না। সেই জন্যই বোধহয় শুধু এই দেশের গণ্ডিতেই আটকে ছিল না রামকথার ইতিহাস। তার নির্যাসের সুতো সুকুমার খুঁজে পেয়েছিলেন আইরিশ মিথ, লিথুয়ানিয়ান সাহিত্যেও।

আরও পড়ুন
সাহিত্যে মিলিয়েছিলেন বাংলা আর ওড়িশাকে, ৯২ বছরে চলে গেলেন যুগলকিশোর দত্ত

সারাজীবন আপন করে এসেছেন শ্রদ্ধেয় ‘স্যার’ সুনীতিকুমারের শিক্ষা। সেই শিক্ষা থেকেই ছাত্রদের ‘আপনি’ করে সম্বোধন করা। স্যারের চেয়ারও পরে অলঙ্কৃত করেছিলেন তিনি। সুনীতিকুমারের পরেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্ব বিভাগের দ্বিতীয় খয়রা অধ্যাপক হয়েছিলেন তিনি। নিজের দেশ তো বটেই, বিদেশ থেকেও সম্মান এসেছে প্রচুর। পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি, দেশিকোত্তম, রবীন্দ্র পুরস্কার-সহ নানা সম্মান। কিন্তু বাংলার মাটি ছাড়েননি কখনও। তিনি যে ‘হোম বেকড স্কলার’!

আরও পড়ুন
দেশভাগ-পরবর্তী বাংলার প্রথম ভাষাসৈনিক তিনি, জরাজীর্ণ অবস্থায় ধুঁকছে তাঁর বাড়িই

চোখের সমস্যা কখনও পিছু ছাড়েনি। ছোট থেকেই নানারকম অসুখে ভুগতেন তিনি। বাঁ চোখে মাইনাস ১৭ পাওয়ার। ডান চোখও প্রায় অন্ধ। তাও পড়ার খিদে কমেনি একফোঁটাও। কোন র্যা কে কোন বই আছে, সব মনে আছে। লোডশেডিং হয়ে গেলে টর্চ দিয়ে চলত বই পড়া। নিজে না পড়তে পারলে কাউকে দিয়ে পড়ানো। মোট কথা, পড়া তাঁর চাই-ই। জীবনের শেষে এসেও নিত্য নতুন বিষয় নিয়ে গবেষণার ইচ্ছা জাগত। কিন্তু তখন আর জোর নেই। ১৯৯২ সালে চিরতরে থেমে গেল ‘ভাষার ইতিবৃত্ত’-এর কলম।

ঋণ-
১) আনন্দবাজার পত্রিকা, ২০১৭, ‘মহীরুহ সুকুমার’
২) আনন্দবাজার পত্রিকা, ‘শব্দ ও ভাষা নিয়ে ভাবার শিক্ষা’

Powered by Froala Editor

More From Author See More