মন্দির-মসজিদ নয়, সর্বধর্ম সমন্বয়ের জন্য পায়খানা বানানোর কথা লিখেছিলেন শিবরাম

নিজের সম্বন্ধে তিনি বলতেন - 'আমি ছোটদের লেখক,ছোট লেখক'। কিংবা - 'আদৌ সাহিত্যিক নই আমি‚ মেহনতি জনতারই একজন - মজদুরের সগোত্র। মুটেও বলতে পারেন আমায়। মোট ফেলেই আমার খাওয়া; মোটামুটি লিখে মোটের ওপর কিছু পেয়ে যাওয়া।'

স্বাধীনতার আগের যাবতীয় আন্দোলন দেখেছেন, স্বাধীনতা দেখেছেন, দেশভাগ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, নকশাল আন্দোলন সব দেখেছেন - কিন্তু টুকরো টুকরো ছাড়া আর কোনো ছাপই তাঁর লেখায় আনেননি। গড়েছেন ভিন্ন এক পৃথিবী।

আরও পড়ুন
বইয়ের স্বত্বাধিকারী অনেক, অথচ মৃত্যুর পরে ‘বেওয়ারিশ’ শিবরাম চালান হয়েছিলেন মর্গে

তাঁর 'পঞ্চাননের অশ্বমেধ' গল্পে পঞ্চাননের একটি বেতো ঘোড়া ছিল, কোনো কাজেরই না। পঞ্চানন গরীব মানুষ। ভালো কিছু খেতে দিতে পারত না। একদিন মহাজন দেনার দায়ে পঞ্চাননের ঘোড়াটা নিয়ে গেল। সাজানো আস্তাবলে তার জায়গা হল। যে ঘোড়াটা কোনদিন ছোলাটোলা চেখে তো বটেই, চোখেই দেখেনি; তাকে গামলাভরা ছোলা দেওয়া হল - 'ঘোড়ার সামনে দু-বালতি ভরে ছোলা আর দানা সাজানো রয়েছে, কিন্তু ঘোড়াটা ওসব স্পর্শও করেনি। সে বোধহয় তাঁর এতখানি সৌভাগ্য বিশ্বাস করতে পারছে না। সে একবার করে বালতির দিকে তাকাচ্ছে আর তার ভিতর থেকে অট্টহাস্য ঠেলে উঠছে- চ্যাঁ হ্যাঁঃ হ্যাঁঃ হ্যাঁঃ হ্যাঁঃ!
...হাসতে হাসতে ঘোড়াটা মারা গেল।'

শিবরাম বলেছেন ঘোড়াটা আসলে তিনি নিজেই। গল্পের জন্য অযাচিত-অগ্রিম টাকাটা পেয়ে গরিব লেখক শিবরামের যেমন হাসি পেয়েছিল, ছোলা দেখে গরিব ঘোড়াটারও তেমনি হাসি পেয়েছিল।

জীবনে কিছুই পাননি। কিন্তু পেয়েছিলেন গোটা পৃথিবী। বানিয়ে নিয়েছিলেন সবকিছু তুচ্ছ করে দেওয়ার মতো একটা জীবনদর্শন-কে।

তাঁর মধ্যে তরুণ বয়েস থেকেই যে আগুন ছিল, নিজেই তাতে যেচে কিছুটা ছাইচাপা দিলেও সেই আগুন তাঁর বিভিন্ন লেখায় এখনও বেরিয়ে পড়ে। সেসব লাইন বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে রীতিমতো প্রাসঙ্গিক –

'প্রথমে ভেবেছিলাম যে মন্দির বানাবো। ...তারপর ভেবে দেখলাম... সেখানে কেবল হিন্দুরাই আসবে, মুসলমান ক্রিশ্চান এরা কেউ ছায়া মাড়াবে না তার। মসজিদ গড়লেও ...মুসলমান ছাড়া আর কেউ ঘেঁষবে না তার দরজায়। গির্জা হলেও তাই। যাই করতে যাই, সর্বধর্মসমন্বয় আর হয় না। তা ছাড়া পাশাপাশি মন্দির মসজিদ গির্জা গড়লে একদিন হয়তো মারামারি লাঠালাঠিও বেধে যেতে পারে। তাই অনেক ভেবেচিন্তে এই পায়খানাই বানিয়েছি। সবাই আসছে এখানে। আসবে চিরদিন।’

অথবা - 'ধর্মকে আমি গুরুত্ব দিইনি কোনোদিন... পাছে কোনও কারণে আমায় স্বর্গে যেতে হয় এই ভয় আমার দারুণ। সাবধান থাকি‚ প্রাণ থাকতে ধর্মকর্ম কিছু করিনে। স্বর্গে নয়‚ পৃথিবীর এই রসাতলেই ফিরে আসতে চাই ফের - একবার নয়‚ আবার আবার বারংবার। পাপী মানুষ‚ কিন্তু তাপী নয়‚ পাপের উপর ধর্মের সন্তাপ বাড়িয়ে উত্তপ্ত হবার বাসনা নেই আমার।'

অসাধারণ কিছু টিপ্পনীও কেটেছেন কাগজে-
'কুকুরে মানুষ কামড়ালে খবর হয় না। মানুষে কুকুর কামড়ালে তখনই খবর হয়। তখন বুঝতে হবে যে দেশে দুর্ভিক্ষ চলছে।'

টেলিভিশন এদেশে আসবে কিনা, সেই বিতর্ক নিয়ে শেক্সপিয়ারের হ্যামলেট ধার করে করলেন তাঁর স্বভাবসিদ্ধ পান-
'tv or not Tv that is the question'

আবার বলেছেন আরেক অসাধারণ সত্যি - 'খবরের কাগজ যত দেরিতে পড়া যায় তত মন ভাল থাকে।'

তাঁর সঙ্গে যারা অবিচার করেছেন, প্রত্যক্ষভাবে না হ'লেও পরোক্ষভাবে তাঁদের আক্রমণ করেছেন। যেমন শিশির ভাদুড়ীকে নিয়ে বলেছিলেন- 'শিশি-র ভাদুড়ী নও, বোতলের তুমি'। আবার শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের প্রাণের পোষা কুকুর ভেলি মারা যেতে সবাই শরত্চন্দ্রকে শোকবার্তা পাঠাচ্ছে। শরত্চন্দ্রের এক ঘনিষ্ঠ প্রকাশক‚ নাম অবিনাশ‚ শিবরামকে বললেন ভেলিকে নিয়ে দুলাইন লিখে দিতে। এই অবিনাশবাবু শরত্চন্দ্রকে অন্য লোকজনদের থেকে আগলে আগলে রাখতেন‚ এক কথায় মোসায়েব। শিবরাম লিখেছিলেন ‘ভেলির বিনাশ নাই‚ ভেলি অবিনাশ’। অবিনাশবাবু ব্যাঙ্গটা না বুঝে ওটাই ছেপেছিলেন।

ধর্মের ধ্বজাধারীদের তিনি ছাড়েননি –
'ঘরে ঘরেই আস্ত ঢেঁকি
মাথায় তাদের দীর্ঘ টিকি
গুঞ্জরিয়া পান্ডা আসে পুঞ্জে পুঞ্জে ধেয়ে
ধর্ম মোক্ষ বানিয়ে থাকেন কেবল অর্থ পেয়ে
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি
সকল সৃষ্টিছাড়া সে যে আমার জন্মভূমি'

কিংবা,
'গরুদের সঙ্গে পণ্ডিতদের আত্মীয়তা সর্বজনবিদিত। পণ্ডিতরা তো সব গবেষণা নিয়েই থাকেন‚ আর গবেষণা কথার অর্থ হচ্ছে‚ গরু খোঁজা। গো+এষণা - সন্ধি করলেই হয় গবেষণা। এষণা মানে খোঁজা। পণ্ডিতরা গরু খুঁজতেই ব্যস্ত‚ ...কিন্তু খালি খুঁজতেই ওঁরা ভালবাসেন‚ খুঁজে পেতে চান না‚ কেননা গবেষণা থেকে গো এষণা কিনা গরু‚ ডু নট কাম‚ এও বোঝাচ্ছে। আমার মনে হয় এই যে‚ পণ্ডিতরা পণ্ডিতদের মোটেই দেখতে পারেন না‚ মতের গরমিল হয়ে প্রায়ই তাঁদের ঝগড়া বেধে যায়। এই কারণেই পণ্ডিতেরা ব্যস্ত হয়ে গরু খুঁজে বেড়ান। গরুদের সঙ্গে তাঁদের ভয়ানক মতের মিল হয়। গরুরা পণ্ডিতদের বুঝতে পারে আর পণ্ডিতরাও গরুদের বোঝেন।'

শিবরামকেও একবার একটি মেয়ে বলেছিল - 'তোর মাকে ****'।
শিবরাম বলেছেন -
"চকারাদ্য ক্রিয়াপদটা আমার অজানা নয়। অনুচ্চার্য এই অশোভন কথাটি প্রায়ই শুনতে হত অকুস্থলে।
আমাদের পাড়ার ছেলেরা ভারী মাতৃভক্ত। কিন্তু সে এই পরের মার। কারণে অকারণে তুচ্ছ অজুহাতে আশপাশ বস্তির আবালবৃদ্ধের মুখে কথাটা শোনা আমার কিন্তু কোনও বনিতার মুখে এই প্রথম। কারো সঙ্গে একটু না বনলেই‚ একটুখানি অবনিতা হলেই যে এমন ভাষা কোনো মেয়ে প্রয়োগ করতে পারে তা আমার ধারণার বাইরে ছিল।
অবশ্য গভীরভাবে কিঞ্চিৎ ভাবলেই হয়ত সান্ত্বনা মিলত যে সব ভালোবাসাই যেমন বিধাতায় গিয়ে পৌঁছয়‚ পৌঁছে দেয়‚ তেমনি পর-মার প্রতি এই প্রবণতা হয়ত একদিন ওদের সেই পরমার কাছেই নিয়ে যাবে‚ উপমার প্রতি অপচেষ্টাই সেই অনুপমার মন্দিরে পৌঁছে দেবে এদের।
'তোমার খ্যামতা আছে স্বীকার করি'‚ আমি বলি : 'কিন্তু আমার মাকে নিয়ে কি তোমার কোনও সুবিধা হবে? তার চেয়ে বরং আমার বাবাকে নিলে‚ নিতে পারলে তুমি কিছু আরাম পেতে।'"

এখনকার পরিস্থিতির সঙ্গে কী অসাধারণ মেলানো যাচ্ছে!

বাংলার একাঙ্ক নাটকের ধারা ঠিকঠাক চলা যাঁদের হাত ধরে, সেদিক দিয়ে বলতে গেলে শিবরামই সবার আগে।
তাঁর নাটকের সংলাপও তীক্ষ্ণ - 'নারী-পুরুষের বন্ধুত্বের সম্পর্ক 'চুম্বনের অধিকার' পেলেও তা 'চর্ব্বণ'-এর হয়ে ওঠে না।’
কিংবা, 'এই যে দাঁড়িয়ে গেছ, আর তুমি পতিতা নও । ...এখন রাস্তা দিয়ে যারা চলছে, তাদেরই একজন...'

প্রেমেন্দ্র মিত্র যথার্থই বলেছিলেন যে একটা খড়কুটো পেলেও শিবরাম বাগান বানিয়ে দিতে পারত।
হিমানীশ গোস্বামীর মতে, অবনীন্দ্রনাথ, সুকুমার রায় এবং শিবরামের বিকল্প কেউ আসবে না বাংলা সাহিত্যে। শিবরাম নিজেও বলেছেন - কথার খেলা নেহাত খেলার কথা নয়!

Powered by Froala Editor