মৃত্যুর পরে 'বেওয়ারিশ' শিবরাম, চালান হয়েছিলেন মর্গেও

বিচিত্র মানুষের জীবনও যে বিচিত্র হবে - তাতে আর আশ্চর্য কী। বাংলা সাহিত্যের লেখকদের মধ্যে শিবরামের মতো বিচিত্র স্বভাবের মানুষ আর কেই বা আছেন? থাকা-খাওয়া-পরা নিয়ে আলাদা করে কোনো তাপ-উত্তাপ নেই। মাঝেমাঝে টাকাপয়সার প্রয়োজনে একে-ওকে খানিক বলেছেন। তবে পেলে ভালো, না-পেলে আরো ভালো। এভাবেই জীবন কাটিয়েছেন। মানুষটির পাতানো আত্মীয় ছিল ঢের। এই কারণে বিপদেও পড়েছেন। অবশ্য, তিনি যত না বিপদে পড়েছেন, তার থেকে লোককে বিপদে ফেলেছেন বেশি। বিশেষ করে তাঁর বইয়ের প্রকাশক যারা, তাদের বেশ বেগ পেতে হত শিবরামের আত্মীয়যোগ সামাল দিতে। শোনা যায়, তাঁর গ্রন্থের স্বত্বাধিকার চেয়ে একেকদিন হাজির হতেন একেকে। প্রত্যেকেই শিবরামের পরিচিত। আত্মীয় বা বন্ধু। আর প্রত্যেকের হাতেই শিবরামের লেখা চিরকুট-

'এই বইয়ের স্বত্ব তোমাকে দিলুম।'

দাবিদারদের ক্রমবর্ধমান সেই কিউ ঠেকাতে না-পেরে শেষমেশ নাকি বন্ধই হয়ে গিয়েছিল শিবরামের বইপ্রকাশ। আর তা ঘটেছিল শিবরামের আত্মজীবনী 'ঈশ্বর পৃথিবী ভালোবাসা'-র ক্ষেত্রেই। প্রথম খণ্ড প্রকাশের পরে দ্বিতীয় এই খণ্ডটি আর প্রকাশ করতে পারেনি আনন্দ পাবলিশার্স। স্বত্বের দাবিদারদের নাজেহাল আবদারের সকরুণ ফলাফল। অনেক পরে সেই বইয়ের পাণ্ডুলিপিটি দিয়ে দেওয়া হয়েছিল নবপত্র প্রকাশনাকে।

পরমপ্রিয় ভাগনে গোপালকে কলেজ স্ট্রিটে একটি বইয়ের দোকান করে দিয়েছিলেন শিবরাম। দোকানটির নাম ছিল - 'শিব্রাম চক্রবর্তীর বই-এর দোকান'। কারও কারও মতে, এই পরমপ্রিয় ভাগিনাও হতদরিদ্র শিবরামের অর্থ তছনছ করতে দ্বিধা করেননি। এমনকি শিবরামের চিকিৎসা, ওষুধপত্রের টাকাও সে সরিয়েছিল অকাতরে। প্রতিদানে শিবরাম তাঁর সমস্ত গ্রন্থের স্বত্বই গোপালকে দান করেছিলেন। জীবনের শেষসময়ে এসে উইলে স্বত্বাধিকারী হিসেবে একমাত্র গোপালের নামই ছিল।

আরও পড়ুন
মন্দির-মসজিদ নয়, সর্বধর্ম সমন্বয়ের জন্য পায়খানা বানানোর কথা লিখেছিলেন শিবরাম

তা এহেন আত্মীয়-পরিবৃত শিবরাম মৃত্যুর সময় বেওয়ারিশ ঘোষিত হয়েছিলেন। অবশ্য বিষয়টা খুব আশ্চর্যের নয়। যাঁর আত্মকাহিনির এমন দশা, মৃত্যু-পরবর্তীতে কেই বা তাঁর ওয়ারিশান হবে? ১৯৮০ সালের ২৮ আগস্ট তাঁর মৃত্যু। দিনটা ছিল কোনও এক ছুটির দিন। অনেক পরে খবর পেয়ে পিজি হাসপাতালে ছুটেছিলেন গৌরাঙ্গপ্রসাদ বসু ও বাদল বসু। এই গৌরাঙ্গপ্রসাদবাবুর বোন ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের বিখ্যাত অভিনেত্রী কাবেরী বসু। শিবরাম চক্রবর্তীকে নিয়ম করে প্রতিবছর ভাইফোঁটা দিতেন। আর বাদল বসু ছিলেন আনন্দ পাবলিশার্স-এর প্রকাশক।

পিজি হাসপাতালে পৌঁছে তাঁরা জানতে পেরেছিলেন বেওয়ারিশ ভেবে শিবরামের মরদেহ চালান হয়ে গেছে ঠান্ডাঘরে। অনেক দেরি করে ফেলেছেন তাঁরা। অগত্যা তাঁদের খোঁজ লাগাতে হল সেই ঠান্ডাঘরে। শিবরামের লাশ ততক্ষণে নিখোঁজ। শবাগারের কর্মী একটার পর একটা ড্রয়ার টেনে মৃতদেহ বের করছেন। মুখ দেখিয়ে জানতে চাইছেন, 'এই লাশটা কি?'

কৌতুকপ্রিয় শিবরাম যেন শেষ হয়ে গিয়েও কৌতুক করে চলেছেন। কিছুতেই তাঁর শব আর মেলে না। বাদলবাবু আর গৌরাঙ্গপ্রসাদ শেষমেশ প্রায় ভেবেই ফেলেছিলেন, মৃত্যুর খবরটা বোধহয় ভুল। আজকালকার ফেক-নিউজের মতো।

তবে না। অবশেষে মিলেছিল শিবরামের হাস্যোজ্জ্বল মৃতদেহ। মৃত্যুর মুহূর্তে কেউ সেদিন তাঁর সামনে ছিল না। একাই বিদায় নিলেন। তাও হাসতে হাসতেই।

ঋণ: 'পিওন থেকে প্রকাশক', বাদল বসু, আনন্দ পাবলিশার্স

Powered by Froala Editor