“হোয়্যার ইজ দ্য বডি?”—ফেলুদার গল্পে এভাবেই কৈলাসের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। তবে কৈলাস শুধু গোয়েন্দা গল্পেই নেই। ভারতের সনাতন হিন্দু ধর্ম অনুযায়ী, সুদূর হিমালয়ের কৈলাসেই বসবাস করেন দেবাদিদেব মহাদেব। থাকেন অন্যান্য দেবতারাও। যদি বলা হয়, শুধু হিমালয় নয়, খাস কলকাতাতেই আছে আরও এক কৈলাস! তবে এই ভূকৈলাস মহাদেবের নয়, বরং খিদিরপুরের ঘোষাল রাজপরিবারের।
আরও পড়ুন
জলের নিচে লুকিয়ে প্রাচীন মন্দির, উঁকি দেয় চূড়া, পুরুলিয়ার তেলাকুপির গল্প এমনই
ভূকৈলাসের নামকরণ কী করে হল? সেটা জানার আগে এই ঘোষাল পরিবারের ইতিহাসের দিকে একটু চোখ ফেরানো যাক। তিনশো বছরেরও অধিক পুরনো এই ভূকৈলাস। যদিও ঘোষালরা প্রথম থেকেই খিদিরপুরে থাকতেন না। মধ্য কলকাতাতেই বসবাস ছিল তাঁদের। এর মধ্যেই কলকাতায় পদার্পণ করে ইংরেজরা। নিজেদের শক্তিশালী করতে বাড়ি-দোকান ইত্যাদি পরিকাঠামো তৈরির পাশাপাশি সেনা ছাউনি তৈরিতেও মন দেয়। ১৭৭৩ সালে তৈরি করা হয় একটি দুর্গ, যা আজ ‘ফোর্ট উইলিয়াম’ নামে বিখ্যাত। কিন্তু এই ফোর্ট উইলিয়াম তৈরির দরুন বিপদে পড়েন সেখানকার আদি বাসিন্দারা। বাড়ি-ঘর ছেড়ে তাঁরা চলে যান অন্যত্র। এদের মধ্যেই ছিলেন ভূকৈলাসের ঘোষালরা। খিদিরপুরে এসে শেষে ঘাঁটি গাড়েন তাঁরা।
আরও পড়ুন
বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস ও ‘কপালকুণ্ডলার মন্দির’ – মিথ ও ইতিহাসের সহাবস্থান মেদিনীপুরে
আঠেরোশ শতক থেকেই ঘোষালদের যাবতীয় প্রতিপত্তির শুরু। শুরু ভূকৈলাসেরও। এই নামটি দিয়েছিলেন মহারাজা জয়নারায়ণ ঘোষাল। তাঁর ইচ্ছা ছিল, এই কলিযুগে এসে মর্ত্যে আরও একটা ‘কৈলাস’ তৈরি করবেন তিনি। যেখানে সমস্ত দেবতারা একত্রে অধিষ্ঠান করবেন। যেমন ভাবা, তেমনই কাজ। একে একে প্রতিষ্ঠিত হল শিব, গঙ্গা, কার্তিক, গণেশ, সূর্য, কালভৈরব ইত্যাদি দেবতার বিগ্রহ। প্রতিষ্ঠিত হল রক্ত-কমলেশ্বর, রাজ-রাজেশ্বর, কৃষ্ণ-কমলেশ্বর নামের তিনটি শিবলিঙ্গ। জয়নারায়ণের ইচ্ছা অনুযায়ী, মর্ত্যেই নেমে এল নতুন কৈলাস। ভূকৈলাস। আজও নিত্যদিন পুজো হয় এই বিগ্রহদের। বিশেষ তিথিতে মেলাও বসে এখানে। সব মিলিয়ে, মর্ত্যের এই কৈলাস আজও একইভাবে অমলিন।
আরও পড়ুন
পঞ্চানন মিলেমিশে যান বুদ্ধের সঙ্গে, তারকেশ্বরে সম্প্রীতির গল্প শোনায় বৌদ্ধ মন্দির
শুধু ভূকৈলাসই নয়, মহারাজা জয়নারায়ণ ছিলেন সবদিক থেকে চৌখস ব্যক্তি। বাংলা ছাড়াও হিন্দি, ইংরাজি, আরবি, ফারসি ইত্যাদি ভাষা অধ্যায়ন করেছিলেন। একটা সময় তৎকালীন পুলিশ সুপারিন্টেনডেন্ট জন শেক্সপিয়ারের সহকারী হিসেবেও কাজ করেছিলেন। তাঁর কর্মদক্ষতা, রাজভক্তির প্রতি মুগ্ধ হয়ে বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংসের সুপারিশে তিনি ‘মহারাজা’ উপাধি পান। ভূকৈলাসের রাজপ্রাসাদ এবং দুটি বড় সরোবর তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। জয়নারায়ণের পরের উত্তরাধিকাররাও তাঁরই মতন করিৎকর্মা ছিলেন। কালীচরণ, সত্যশরণ, সত্যানন্দ প্রমুখরাও পেয়েছিলেন ‘রাজা’ উপাধি। তবে সত্যানন্দ ঘোষালের পর আর কেউ ‘রাজা বাহাদুর’ হননি। কিন্তু প্রতিপত্তি কোনো অংশে কমেনি তাঁদের।
আরও পড়ুন
জাপানের এই মন্দিরে দেবতা থেকে পুরোহিত সবাই বিড়াল
ভূকৈলাসে শুধু শিবলিঙ্গই নেই, আছে দেবী পতিতপাবনীর অষ্টধাতুর মূর্তিও। ১৭৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই মহিষমর্দিনীর মূর্তি। সেই থেকে ইনি ঘোষাল বংশের কুলদেবী। এই মূর্তিটির সঙ্গেও জড়িয়ে আছে ইতিহাস। এখানে পতিতপাবনী দেবীকে বিভিন্ন রূপে, বিভিন্ন ভাবে পূজা করা হয়। সেখানে যেমন থাকেন কালী, লক্ষ্মী, তেমনই থাকেন কৃষ্ণ, বলরাম। এই পরিবারের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন সাধক রামপ্রসাদও। শোনা যায়, পতিতপাবনীর মন্দির প্রতিষ্ঠার পর বৃদ্ধ রামপ্রসাদ নাকি এখানে আসতেন প্রায়ই। গানও গাইতেন। এই দেবীর উদ্দেশ্যে গাওয়া তাঁর কিছু গান আজও এই মন্দিরে গাওয়া হয়।
আরও পড়ুন
দুর্গের ভেতরে প্রাচীন মন্দির ও মূর্তির হদিশ, উচ্ছ্বসিত ঐতিহাসিকরা
ইতিহাস, ঐতিহ্য, মিথ— সমস্ত কিছু নিয়ে তিনশোর’ও বেশি বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে এই ভূকৈলাসের ঘোষাল পরিবার। ১৯৯৬ সালে কলকাতা পুরসভার হেরিটেজ তকমাও পেয়েছে এটি। সেই রাজা এবং রাজত্ব না থাকলেও, কলকাতার বনেদি ইতিহাসের অন্যতম অঙ্গ হয়ে আছে ভূকৈলাস।
Powered by Froala Editor