জলের নিচে লুকিয়ে প্রাচীন মন্দির, উঁকি দেয় চূড়া, পুরুলিয়ার তেলাকুপির গল্প এমনই

মন্দিরের দেশ হল ভারত। যাতায়াতের পথে, অলিতে গলিতে সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র দেবতার আবাসস্থল। তার মাহাত্ম্য এমনই যে, ভারতীয় রাজনীতিতেও ঢুকে পড়েছে সেই মন্দির-আখ্যান। কিন্তু এসবের আড়ালে আরও মন্দির, আরও স্থাপত্য আছে যা এখনও মাটির স্তুপ থেকে বের হয়নি। শুধু মাটি নয়, জলের তলায়ও রয়ে গেছে কিছু নিদর্শন। পুরুলিয়ার তেলাকুপি সেইরকমই একটি মন্দির-এলাকা। দামোদরের বাঁধ যাকে নিজের ভেতর গিলে নেয়।

পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর থানার অন্তর্গত এই তেলাকুপি অঞ্চল। লালপুর, গুরুন, তারাপুর, ঘরবিড়া ইত্যাদি গ্রামগুলি নিয়ে তৈরি এই অঞ্চলটি ঐতিহাসিক দিক থেকেও বেশ প্রাচীন। একসময় প্রাচীন শিখরবংশের রাজধানী ছিল এই তেলকুপি। তখন এর নাম ছিল ‘তৈলকম্পী’। এই শিখরবংশের রাজাদেরই পাঞ্চেতের প্রকৃত রাজবংশ বলে ধরা হয়। সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত ‘রামচরিতম’ থেকে এই শিখরদের রাজাদের সম্পর্কে জানা যায়। এদের অন্যতম উল্লেখযোগ্য রাজা রুদ্রশিখরের উল্লেখও পাওয়া যায় এখানে। যাই হোক, এই তেলকুপি অঞ্চলেই একসময় তৈরি করা হয় অনেকগুলি মন্দির। সংখ্যায় এবং কারুকার্যে কারোর থেকে কম ছিল না এই মন্দির। মনে করা হয় এখানকার তৎকালীন রাজবংশ এবং সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা তৈরি করেছিলেন এই মন্দির। ফলে, অনুমান করাই যায় এখনকার জলে নিমজ্জিত অঞ্চলটি একটা সময় যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল।

তেলাকুপির মন্দিরগুলির খবর প্রথম প্রকাশ্যে আনেন ইন্দো-আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ার এবং প্রত্নতাত্ত্বিক জে.ডি.বেগলার। ১৮৭৮ সালে প্রকাশিত “Report of A Tour through the Bengal Provinces(Vol VIII)” বইতে তিনি উল্লেখ করেন এখানকার মন্দিরের কথা। ছবিও দেন তিনি। তাঁর মতে, এত কম এলাকায় একসঙ্গে এত সুন্দর এবং উৎকৃষ্ট মন্দির আগে দেখা যায়নি। তাহলে এখন কী হল এই মন্দিরগুলির? এখনও কী আছে মন্দিরগুলো? আপাতত এর উত্তর রয়েছে জলের তলায়। ১৯৫৭ সালে পাঞ্চেতের কাছে দামোদর নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। পুরো ব্যাপারটার তদারকিতে ছিল দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন। আর সেই বাঁধ নির্মাণের দরুণ, দামোদর উপচে পড়ে। ১৯৫৯ সালের মধ্যে তেলাকুপির অধিকাংশই সেই জলের তলায় চলে যায়। যার মধ্যে থেকে গেছে সেই সমস্ত মন্দির।

দামোদর এবং মানুষের ক্রিয়াকলাপ এই স্থাপত্যকে গ্রাস করে নিলেও, একেবারে গিলে ফেলতে পারেনি। মাঝে মধ্যে যখন জলস্তর নামে, তখন মাথা উঁচিয়ে ওঠে মন্দিরগুলো। সবগুলো মন্দির হয়ত এখন অক্ষত নেই। যেগুলো টিকে আছে, সেগুলোও শ্বাস নিচ্ছে জলের তলায়। হয়ত এভাবেই দমবন্ধ হয়ে মরে যাবে অতীতের সমৃদ্ধশালী তেলাকুপি।

ঋণ –
১। দামোদরের পেটে তেলাকুপির ইতিহাস – আনন্দবাজার পত্রিকা
২। রাণা চক্রবর্তী
৩। উইকিপিডিয়া

More From Author See More