মহামারী। গোটা বিশ্বে বিভিন্ন সময় এই শব্দটি ত্রাসের সৃষ্টি করেছে। যখনই রোগ নিয়ে এসেছে, শ্মশান করে দিয়েছে সমস্ত জায়গা। দেশ-কাল-গণ্ডি সমস্ত কিছু একাকার হয়ে গিয়েছিল। একটাই শব্দ - মৃত্যু! প্রাচীন ভারতও সাক্ষী থেকেছে কালাজ্বর, কলেরার মারণ আক্রমণের। বিশেষ করে কলকাতা-সহ পুরো বাংলা নানা সময় ছারখার হয়েছে মহামারীর আক্রমণে। সেই সঙ্গে আরও একটি রোগ জন্ম নেয়, প্লেগ। যার কথা বললেই মনে পড়ে উনবিংশ শতকের শেষ থেকে বিংশ শতকের শুরু পর্যন্ত বিস্তীর্ণ একটি সময়ের কথা। যা ছিল কলকাতার কালো সময়, মৃত্যুর সময়।
আরও পড়ুন
মহামারী রুখতে পথে রবীন্দ্রনাথ, ঘরছাড়া জগদীশচন্দ্র; মারা গেল অবনীন্দ্রনাথের ছোট্ট মেয়ে
অবশ্য শুধু এই শহরই নয়; ভারতের নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল এটি। ১৮৯৬ সালে মুম্বইকে (তখন বোম্বাই) বিধ্বস্ত করে যা গ্রাস করেছিল উত্তর ভারতকে। কলকাতায় প্লেগের তাণ্ডব শুরু হয় আরও দুইবছর পর, ১৮৯৮-এ। তার এক বছর আগে, হাওড়ার বেলুড়ে জমি কিনে তৈরি হয় একটি সংগঠন। রামকৃষ্ণ মিশন। আধ্যাত্মিক ও সেবার মন্ত্র নিয়ে চলার শপথই ছিল যাদের পাথেয়। যে নৌকার মাঝি হয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। প্লেগের খবর তাঁর কানে ঠিকই এসে পৌঁছেছিল। কিন্তু বাংলা তখনও এর গ্রাস থেকে মুক্ত ছিল। কিন্তু বেশিদিন রুখে রাখতে পারল কই?
আরও পড়ুন
মহামারীতে ছারখার বাংলা, মৃত ৫০ হাজারেরও বেশি, বাদ গেল না সাহেবরাও
যে বছর প্লেগ এল, সেই বছরই জানুয়ারি মাসে কলকাতা তথা সমগ্র ভারতের মঞ্চে উঠে এলেন এক বিদেশিনী। এই দেশের মাটি স্পর্শ করলেন সেবার মন্ত্র নিয়ে। স্বামীজির আহ্বানেই তাঁর এই আগমন। মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল। মান, যশ, পাশ্চাত্যের ঐশ্বর্য সবকিছু ছেড়ে মানবজাতির উদ্দেশ্যে তাঁর প্রাণ ছিল নিবেদিত। কয়েকমাস পর মার্গারেটের ভেতর থেকেই জন্ম নিল ‘সিস্টার নিবেদিতা’। যে সময় এই ঘটনা ঘটছে, ততদিনে হাহাকার শুরু হয়ে গেছে। লাখ লাখ মানুষ রাস্তায়, ঘরে অসহায়ের মতো মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। মহারানি ভিক্টোরিয়া যতই ভরসা দিক, ডাক্তাররা যতই চেষ্টা করুক, প্লেগের থাবা থেকে রেহাই পেল না সাধারণ মানুষ।
আরও পড়ুন
বাড়িতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করে বাজারে বিতরণ, উদ্যোগে ব্যারাকপুরের তরুণরা
সমস্ত খবরই আসছিল বেলুড়ে। যত সময় এগোতে লাগল, অস্থির হয়ে উঠলেন বিবেকানন্দ। এই শহর, যেখানে তিনি জন্মেছেন, বেড়ে উঠেছেন, মাতৃস্নেহ পেয়েছেন; সে শহর আজ কাঁদছে। তিনি কী করবেন? নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে নিলেন স্বামীজি। দরকারে নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়বেন সেবার কাজে।
আরও পড়ুন
পোকার আক্রমণে ধ্বংস হবে ইতালি, ভাইরাস দিয়েই তা ঠেকালেন বাংলার ঘনাদা
এমনিতে মহামারীর জন্য সরকারের প্লেগ কমিশন ও ব্রিটিশ সেনাদের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অনেক জায়গায় ঝামেলাও শুরু হয় এইজন্য। ভারতীয়দের নানা কুসংস্কার, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি প্লেগের সময়ও যায়নি। সেই সব কারণে ব্রিটিশদের ব্যাঙ্গের পাত্র হয়েছিল তারা। অনেক জায়গায় সেনাদের তরফ থেকে অশোভন আচরণও করা হয়। সমস্ত কিছু নজরে এসেছিল স্বামীজির। একসময় মঠের গুরুভাইদের নিয়ে নিজেই নেমে পড়লেন মাঠে। ১৮৯৮ সালের ৩ মে মঠে ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করলেন তিনি। যার সারমর্ম, রামকৃষ্ণ মিশন আর্তের সেবা করবে। সেই সঙ্গে, যতটা সম্ভব সংক্রমণ রোখারও চেষ্টা করা। কিন্তু টাকা? অর্থেরও তো প্রয়োজন! সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠলেন স্বামীজি - “দরকার হলে নতুন মঠের জমি বিক্রি করে দেব! আমরা ফকির, ভিক্ষা করে গাছতলায় শুয়েও দিন কাটাতে পারি। এই জমি বিক্রি করলে যদি হাজার হাজার লোকের প্রাণ বাঁচানো যায় তবে কিসের জায়গা? কিসের জমি?” যদিও তার দরকার হয়নি শেষ পর্যন্ত। কিন্তু এই জমি আর মঠ তৈরি তাঁর বহুদিনের স্বপ্ন ছিল। মানুষের বিপদের দিনে সেটাকেও বিক্রি করে দেওয়ার কথা বলতে এক মুহূর্তও চিন্তা করেননি স্বামী বিবেকানন্দ…
আরও পড়ুন
অসহায় বৃদ্ধাদের জন্য একমাসের খাবার, সঙ্গে আশ্রয়ের নিরাপত্তা, উদ্যোগ কলকাতার নাগরিকদের
তাঁর এই কাজে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছিলেন সিস্টার নিবেদিতা। জীবনের শেষ পর্যন্ত আর্তের সেবাই ছিল তাঁর পরম ধর্ম। নিজে সশরীরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন প্লেগ আক্রান্তদের সেবায়। নিজের সুস্থতার পরোয়া করেননি। রাত কাটিয়েছেন বস্তিতে, রাস্তায়। নিজের সন্তানের মতোই বুকে তুলে নিয়েছিলেন শিশুকে। স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য কী কী করতে হবে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি। নিবেদিতার এই উদ্যোগ নিজের চোখে দেখেছিলেন ডাঃ রাধাগোবিন্দ কর, যিনি আজকের আর জি কর হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯১১ সালে ভগিনীর মৃত্যুর পর স্মৃতিচারণায় উঠে এসেছিল সেই কথাও।
আরও পড়ুন
মানুষ নেই পথে, জাপানের শহরে অবাধ বিচরণ হরিণের
সালটা ১৮৯৯। প্লেগ তখন পূর্ণমাত্রায় বিকশিত হচ্ছে শহরে। ডাঃ রাধাগোবিন্দ করও ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। একদিন রোগী দেখে বাড়ি ফিরে দেখেন, একজন বিদেশিনী তাঁর ঘরে বসে আছে। “তাঁহার পরিধানে গৈরিকবাস, গলদেশে রুদ্রাক্ষমাল্য, আননে দিব্যদীপ্তি।” সেই প্রথম নিবেদিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ। ওইদিনই ডাঃ রাধাগোবিন্দ সকালে বাগবাজারের এক বস্তিতে একটি শিশুকে পরীক্ষা করতে গিয়েছিলেন। প্লেগে আক্রান্ত হয়ে ওর মা আগেই মারা গিয়েছিল, শিশুটিকেও গ্রাস করেছে সেই মারণ রোগ। এই কথা শুনে নিবেদিতা সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যান সেখানে। পরে রাধাগোবিন্দ কর দেখেন, “সেই অস্বাস্থ্যকর পল্লীতে— সেই আর্দ্র জীর্ণ কুটিরে নিবেদিতা রোগগ্রস্ত শিশুকে ক্রোড়ে লইয়া বসিয়া আছেন। দিনের পর রাত্রি— রাত্রির পর দিন তিনি স্বীয় আবাস ত্যাগ করিয়া সেই কুটিরে রোগীর সেবায় নিযুক্তা রহিলেন।” নিজের স্বাস্থ্যের দিকে কোনো লক্ষ্য নেই তাঁর। ঘর পরিষ্কার করতে হবে বলে নিজেই মই এনে চুনকামের কাজ করতে লাগলেন। নিবেদিতা ভালো করেই জানতেন, এই বাচ্চাটি বাঁচবে না আর। বাঁচেওনি; কিন্তু সমস্তটুকু স্নেহ ঢেলে দিয়েছিলেন সেখানে। শুধু একটি জায়গায় নয়, সর্বত্র। কখনও প্লেগ হাসপাতাল তৈরির উদ্যোগ করছেন, কখনও নিজেই অকুস্থলে পৌঁছে যাচ্ছেন।
আরও পড়ুন
সতর্কতার মধ্যেই অনুষ্ঠান, অনলাইন স্ট্রিমিং-এর আয়োজন বাঙালি শিল্পীদের
শুধু রাধাগোবিন্দ কর নন, গোটা বাংলা তাঁর এই রূপ দেখে মোহিত হয়ে গিয়েছিল! কিন্তু নিবেদিতার কাছে এটা কোনো আলাদা বা বিশেষ কাজ ছিল না। স্বামীজির কাছেও নয়। মানবজাতির সেবাই যে আমাদের মূল ধর্ম। অহং, লোভ সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে নিজের আসল কাজটুকু করে যাওয়া, এটাই তো আমাদের কর্তব্য। যাতে শুধু আমি না, আমার চারিপাশে যারা আছে সবটুকু নিয়ে ভালো থাকা। আজ, এমন দুঃসহ পরিস্থিতিতেও কি সেটা করতে পারি না সবাই?
Powered by Froala Editor