১৬ শতকের শেষ দিকে বাংলার বিখ্যাত বারো ভুঁইয়াদের সবচেয়ে বিখ্যাত জমিদার ঈশা খাঁর জমিদারির এক কাছারিতে মূলত হিসেব লেখার কাজ করতেন তাঁদের এক পূর্বপুরুষ। ঈশা খাঁ তাকে ‘খাসনবিশ’, ‘মজুমদার’ উপাধি দিয়েছিলেন। এই ‘মজুমদার’ আবার পাল্টে হয়ে গেল ‘চৌধুরী’। সবমিলিয়ে, মানে আগের ‘রায়’ আর পরের ‘চৌধুরী’ মিলিয়ে, তাদের পরিবারের পদবী হয়ে গেল ‘রায়চৌধুরী’।
এই 'রায়চৌধুরী' বেশি ব্যবহার করতেন না উপেন্দ্রকিশোর। জমিদার জমিদার লাগে বলে!
কালীনাথের পাঁচ ছেলে। সারদারঞ্জন, কামদারঞ্জন, মুক্তিদারঞ্জন, কুলদারঞ্জন, প্রমদারঞ্জন। এই দ্বিতীয় পুত্রটিকে পাঁচ বছর বয়সে রায়বংশের আরেক শাখার প্রসিদ্ধ উকিল ও জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরী দত্তক নিয়ে নাম বদলে রাখেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। হরিকিশোর যখনই শাসন করতেন, কামদা চিৎকার করে কাঁদত 'আমার কেউ নেই রে' বলে। তার বাবা তখনই ভাবতেন ছেলেকে আবার ফিরিয়ে আনবেন।
আরও পড়ুন
মৃত্যুর নয় দিন পর বেরোল সুকুমারের প্রথম বই
কয়েক বছর পরে হরিকিশোরের নিজের এক ছেলে হয়। তিনি নরেন্দ্রকিশোর। হরিকিশোর তাঁর সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী উপেন্দ্রকিশোরকেই করে গেলেও উপেন্দ্রকিশোর তাঁর ভাই নরেন্দ্রকিশোরকে বঞ্চিত করেননি। ময়মনসিংহের সমস্ত সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ ভাইয়ের হাতে ছেড়ে দিয়ে নরেন্দ্রকিশোর যে ভাগ তাঁকে দিতেন তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতেন।
পড়াশোনার বাইরে ছোটবেলা থেকেই গান এবং আঁকাআঁকির প্রতি তাঁর অন্যরকম আকর্ষণ ছিল, আঁকতেন চমৎকার। ময়মনসিংহে থাকাকালীন বাংলার তৎকালীন গভর্নর একবার সেই স্কুল পরিদর্শনে এলে একটি ছেলের দিকে তাঁর নজর যায়। সে একমনে আঁকছিল। তিনি সেই ছেলের কাছে গেলেন এবং দেখলেন তাঁর নিজের ছবি আঁকা হয়েছে। স্কুলের অন্য সবাই সেই ব্যাপারটায় ভয় পেলেও গভর্নর মোটেও এতে ক্ষুব্ধ হননি, বরং তিনি সেই ছেলেটিকে বলেছিলেন সে যেন তার এই গুণকে হারিয়ে যেতে না দেয়।
বাড়িতে কখনো সেভাবে পড়তে দেখা যেত না, অথচ পরীক্ষার ফল হত ভালো। তাঁর নিজের কথায়, সহপাঠীদের পড়া বলা শুনেই তাঁর সব মুখস্থ হয়ে যেত।
বড় বড় ওস্তাদের সংস্পর্শে এসে তিনি গান শিখেছিলেন, বেহালা বাজানো শিখেছিলেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁকে গান গাইতে হত। ছোটবেলায় একবার অভিমান করে সাধের বেহালা ভেঙে ফেলেছিলেন। সুকুমারসহ অন্যান্য ভাইবোনেরা নাকি রাতে বাবার বেহালার সুর শুনে ঘুমাতেন। বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন, তিনি যখন ছোট ছিলেন তখন থেকেই দেখে আসছেন যে কলকাতায় রায় বাড়ির সামনে লোকজন ভিড় করত শুধুমাত্র উপেন্দ্রকিশোর রায়ের বেহালা বাজানো শোনার জন্য।
আরও পড়ুন
মন্দির-মসজিদ নয়, সর্বধর্ম সমন্বয়ের জন্য পায়খানা বানানোর কথা লিখেছিলেন শিবরাম
মেয়ে পুণ্যলতার লেখা থেকে জানা যায় শেষ দিনগুলোতেও নাকি সব কষ্ট, সব দুঃখ ভুলে থাকতেন ওই বেহালার সুরেই। ব্রাহ্মধর্ম নেওয়ার পর বেশ কিছু অসাধারণ ব্রাহ্মসঙ্গীত লিখেছিলেন। “কে ঘুচাবে হায় প্রাণের কালিমা রাশি”, “জয় দীন-দয়াময় নিখিল ভুবন পতি”, “বল দেখি ভাই এমন করে ভুবন কেবা গড়িল রে”, “জাগো পুরবাসী ভাগবত প্রেমপিয়াসি” ইত্যাদি বহু বহুল প্রচলিত ব্রাহ্মসঙ্গীত এসেছিল তাঁর কলম থেকে।
সমকালীন বিভিন্ন পত্রপত্রিকাতে সঙ্গীতবিষয়ক নিবন্ধ লিখেছিলেন। ইংরিজিতে অনুবাদও করেছিলেন গুটিকয় রবীন্দ্রসঙ্গীত। বিয়ের দু বছর পর, ১৮৮৮ সালে বের হয় তাঁর প্রথম বই, “শিক্ষক ব্যাতিরেকে হারমোনিয়াম শিক্ষা।” প্রকাশক হারমোনিয়ামের আবিষ্কর্তা দ্বারকানাথ ঘোষের প্রতিষ্ঠিত বাদ্যযন্ত্র প্রস্তুতকারক সংস্থা ডোয়ার্কিন অ্যান্ড সন্স। আজও চালু এই প্রতিষ্ঠানের নামকরণটি উপেন্দ্রকিশোরেরই করা।) সঙ্গীতবিষয়ে তাঁর দ্বিতীয় বইটি ওই একই জায়গা থেকে প্রকাশিত হয় ১৯০৪ সালে। এটি ছিল বেহালা শিক্ষার বই।
সিটি বুক সোসাইটি থেকে ‘ছেলেদের রামায়ণ’ নামে উপেন্দ্রকিশোরের লেখা ও অলংকরণ করা একটা সচিত্র বই প্রকাশিত হল। কাঠের ব্লকে ছাপার কিছু সমস্যার জন্য গোটা প্রথম সংস্করণটাই একেবারে বিগড়ে গেল। বইয়ের ছবির দশা দেখে তিনি ঠিক করলেন পদ্ধতিটাই বদলে ফেলতে হবে।
সে দশকের শুরুর দিক থেকেই পশ্চিমে একটা নতুন আবিষ্কৃত চিত্রমুদ্রণ পদ্ধতির বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু হচ্ছিল। এখানে হাতে ব্লক তৈরি করবার বদলে একটা অলংকরণের ছবি তোলা হত একটা ছোট ছোট ছিদ্রওয়ালা স্ক্রিনের সাহায্যে। ফলে ছবিটা কতগুলো ছোট ছোট বিভিন্ন মাপের কালো ফোঁটায় ভেঙে যেত। এরপর সেই কালো ফোঁটার নকশাটাকে ব্লক-এ বদলে দিয়ে তার সাহায্যে ছবিটা ছাপা হলে তাতে সেই ফোঁটাগুলো মিলেমিশে আসল ছবিটাকেই দেখিয়ে দিত। যেহেতু ক্যামেরা দিয়ে তৈরি তার ফলে আর খোদাইওয়ালার মর্জিমতন ছবি বিকৃতির দুর্যোগ থাকত না। তাছাড়া, এই পদ্ধতিতে ছবির টোন বা আলোকালোর বিভিন্ন ঘনত্বও ধরা পড়ত নিখুঁতভাবে। ফলে ছবি অনেকটাই বাস্তবসম্মত হত। ছাপা যেত ফটোগ্রাফও।
আরও পড়ুন
কুড়ি রানে ৭ উইকেট নিয়েছিলেন বিবেকানন্দ, বাংলার ‘ডব্লিউ জি গ্রেস’ বলা হত উপেন্দ্রকিশোরের দাদাকে
উপেন্দ্রকিশোরের নজর পড়ল ফটোগ্রাফি আর মুদ্রণের মধ্যে সেতুবন্ধনকারী সেই হাফটোন মুদ্রণ পদ্ধতির দিকে। হাফটোন পদ্ধতি নিয়ে কিছুকাল যাবতই তাঁর পড়াশোনা চলছিল। এইবার পৈত্রিক জমিজিরেতে তাঁর অংশের অনেকখানি বেচে দিয়ে সেই টাকায় বিলেতের পেনরোজ কম্পানি থেকে বইপত্র, রাসায়নিক, ক্যামেরা, যন্ত্রপাতি আনিয়ে নিয়ে শুরু হল হাফটোন পদ্ধতিকে ভালো করে জেনে বুঝে নিয়ে তার উন্নতিসাধনের চেষ্টা। বাড়ি বদলে উঠে এলেন শিবনারায়ণ দাস লেন-এর অপেক্ষাকৃত বড় একটা বাড়িতে। সেখানে নতুন সব যন্ত্রপাতি বসিয়ে শুরু হল তাঁর মুদ্রণসংস্থা ইউ রে আর্টিস্ট-এর জয়যাত্রা। ছাপাখানার পাশাপাশি সেখানে একটা ঘরে গড়ে তুললেন হাফটোন নিয়ে তাঁর স্টুডিও তথা গবেষণাগার। একটা স্নানঘর বদলে গেল তাঁর ডার্ক রুম-এ।
শুরুতে কেবলমাত্র কিছু ব্রোমাইড এনলার্জমেন্ট আর সীমিত ক্ষমতার হাফটোন ব্লকের কাজ হত সেখানে। কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল, নিজস্ব পদ্ধতিতে সাত রকম ডিটেইলযুক্ত হাফটোন ব্লকে ছবি ছাপাইয়ের বিজ্ঞাপন দিতে শুরু করেছেন তরুণ উদ্ভাবক। ৭৫ থেকে শুরু করে ২৬৬ লাইনের হাফটোন ব্লক—যার যেমন পকেটের জোর তিনি তেমন মানের ব্লক নিয়ে নিন ইউ রায় আর্টিস্টের থেকে। মাঝারি মানের ১৩৩ লাইনের ব্লকের দাম মাত্রই ১ টাকা প্রতি বর্গ ইঞ্চি।
ছাপাখানার ব্যবসার পাশাপাশি, সেই ১৮৯৭ থেকেই ব্রিটেনের গ্রাফিক আর্টের বিখ্যাত জার্নাল পেনরোজ অ্যানুয়ালে একের পর এক প্রবন্ধে প্রকাশিত হতে শুরু করল হাফটোন মুদ্রণপদ্ধতি নিয়ে তাঁর মৌলিক গবেষণার ফলাফল। ১৯১১ সালের মধ্যে নটা গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় তাঁর এই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জার্নালে।
ফোকাসিং দ্য স্ক্রিন—১৮৯৭, দা থিওরি অব হাফটোন ডট—১৮৯৮ ,দা হাফটোন থিওরি গ্রাফিক্যালি এক্সপ্লেইনড—১৮৯৯ , অটোম্যাটিক অ্যাডজাস্টমেন্ট অব দা হাফটোন স্ক্রিন (১৯০১), ডিফ্র্যাকশান ইন হাফটোন (১৯০২-০৩), মোর অ্যাবাউট হাফটোন থিওরি(১৯০৩-০৪), দা সিক্সটি ডিগ্রি ক্রস লাইন স্ক্রিন (১৯০৫-০৬), মালটিপল স্টপস্ (১৯১১-১২)।
উপেন্দ্রকিশোর আবিষ্কার করেন হাফটোন ক্যামেরার জন্য অটোমেটিক স্ক্রিন অ্যাডজাস্টমেন্ট ইন্ডিকেটর, যার সাহায্যে হাফটোন ক্যামেরার ফোকাসিং-এর জন্যে পর্দার সঠিক অবস্থানটা যান্ত্রিক নির্ভুলতায় নির্ধারিত হয়ে যেত। সংশ্লিষ্ট গবেষণাপত্রটি বের হয় পেনরোজ পত্রিকার ১৯০১ সালের সংস্করণে। সে যন্ত্র তাঁর পদ্ধতি মেনে বাণিজ্যিকভাবে তৈরি শুরু হল ব্রিটেনে। “পেনরোজ” তার ১৯০৪-০৫ সংখ্যার সম্পাদকীয়তে, হাফটোনের জন্য নিখুঁত নেগেটিভ তৈরি করবার ক্ষেত্রে তাঁর আবিষ্কারের মৌলিক গুরুত্বকে সশ্রদ্ধে স্বীকারও করে নিল।
ইতিমধ্যে ১৯০২ সালে তিনি তৈরি করেছেন রে’জ টিন্ট প্রসেস। ১৯০৩ সাল থেকেই সেই পদ্ধতি অবলম্বন করে ম্যাগাজিনে হাফটোন রঙিন ছবি ছাপাইয়ের কাজ শুরু হয়ে গেছে। রঙিন হাফটোন ছাপার এই পদ্ধতিটা তখন ব্রিটেনের বেশ কিছু প্রযুক্তি শিক্ষালয়ে ব্যবহৃতও হতে শুরু করেছে।
ঘরে বাইরে দু জায়গাতেই স্বীকৃতি পেয়েছিল তাঁর এই উদ্ভাবন। রবীন্দ্রনাথ ১৮৯৮ সালে ভারতী পত্রিকায় সাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোরের এই নতুন পরিচয় নিয়ে লেখেন “অনেকেই হয়তো জানেন না হাফটোন লিপি সম্বন্ধে উপেন্দ্রবাবুর নিজের আবিষ্কৃত বিশেষ সংস্কৃত পদ্ধতি বিলাতের শিল্পীসমাজে খ্যাতিলাভ করিয়াছে- সর্বপ্রকার পরামর্শ ও সহায়তার অভাব সত্ত্বেও এই নূতন শিল্পবিদ্যা আয়ত্ত এবং তাহাকে সংস্কৃত করিতে যে পরিমাণ অধ্যবসায় ও মানসিক ক্ষমতার প্রয়োজন তাহা অব্যবসায়ীর পক্ষে মনে আনাই কঠিন।”
বিবেকানন্দ তখন বিশ্বজয় করে ফেলেছেন, রবীন্দ্রনাথের তখনও নোবেলপ্রাপ্তি ঘটেনি... কিন্তু কলকাতায় বসে মুদ্রণশিল্পে নিজের উদ্ভাবনী ক্ষমতা দেখিয়ে বিশ্বে আলোড়ন ফেলেছিলেন এই উপেন্দ্রকিশোর।
লেখা ও ছবি আঁকবার পাশাপাশি চলছিল তাঁর ছবি ছাপাইয়ের কাজও। সখা ও সাথী, মুকুল ইত্যাদি পত্রিকার অলংকরণের বহু ব্লকই তৈরি হত তাঁর ছাপাখানাতেই। ১৯০১-তে প্রবাসী পত্রিকার জন্য ‘ডুয়োটাইপ’ পদ্ধতিতে ছবি ছাপাইয়ের কাজ—ভারতে সেই প্রথম। ১৯০৭ সালে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় যখন ইংরিজিতে তাঁর জাতীয়তাবাদী সর্বভারতীয় পত্রিকা পত্রিকা 'মডার্ন রিভিউ' চালু করলেন তখন তার অসাধারণ অলংকরণগুলো ছাপানো সম্ভব হয়েছিল উপেন্দ্রকিশোরের সৃষ্টি হাফটোন ব্লকের কল্যাণে। ১৯১২ সালে যখন রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি প্রকাশিত হল তখন তাতে গগন ঠাকুরের অসামান্য ছবিগুলোর হাফটোন ব্লকও আসে উপেন্দ্রকিশোরের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ইউ রায় অ্যান্ড সন্স থেকেই।
১৯১৩ সালে ইউ রায় অ্যান্ড সন্স উঠে আসে ১০০ নম্বর গড়পার রোডের তেতলা বাড়িতে। তাঁর সমস্ত নকশাও উপেন্দ্রকিশোরের নিজের হাতে করা। বাড়ির ছাদে ছিল উপেন্দ্রকিশোরের তারা দেখবার ঘর। নিচের তলায় প্রেস, দোতলায় ব্লক বানাবার আর টাইপসেটিং-এর বন্দোবস্ত।
তিনি শিশু সাহিত্যে বিশাল অবদানকারী, সে নিয়ে প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু এই বহুমুখী উপেন্দ্রকিশোরকে নিয়ে সেভাবে চর্চা হয় কোথায়!
Powered by Froala Editor