১৯৭৪ সালে অস্ট্রিয়ার লেখক, কবি ও নাট্যকার পেটার হান্টকে তাঁর দ্বিতীয় কবিতার বইটি প্রকাশ করেন, ‘অর্থহীনতা আর সুখ’-- এই ছিল নাম। মুক্ত গদ্যে লেখা তিনটি দীর্ঘ কবিতা-– ব্যাস, আর কিছু না। এটির কথা জানা তত সহজ হত না, হান্টকে ২০১৯-এর নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে অন্তত নয়ই, যদি অনেক আগেই অধ্যাপক-অনুবাদক মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এর একটি চমৎকার তর্জমা না করতেন। হান্টকের স্বল্প-পরিচিত বইটি আমরা তাই আগেভাগেই পড়ে ফেলেছি – সাম্প্রতিক খ্যাতি ও নাছোড় বিতর্কে তাঁর সহসা-উত্থান আমাদের অচেনা লাগেনি।
আরও পড়ুন
জলপাইশাখার মধ্যে দিয়ে যেতে
পাঁচের দশকে অ্যালেন গিনসবার্গ ‘হাউল’ নামে একটি কুখ্যাত দীর্ঘ কবিতা লিখলেন, তাঁর ভুবনবিজয়ের সেই শুরু। নাগাড় মনোবিপর্যয়, ভূতুড়ে ইমেজ, দুঃস্বপ্নময় প্রলাপ – যার অসম্ভব গতি - লাভাস্রোত বললে হয়তো ঠিক তুলনা হবে – তাই ছিল ঐ কবিতাটিতে। পাশ্চাত্য কবিতায় এ ঘটনা যদিও নতুন নয়, উনিশ শতাব্দীর এক দিব্যোন্মাদ কিশোর আর্তুর র্যাঁ বোও কবিতা লিখেছেন – মুখ ভর্তি করে যক্ষ্মাগ্রস্ত যেমন রক্ত তোলে – সওয়াল করেছেন কালো জাদু, অপরসায়ন, আদিম যুগ ও শুদ্ধ চৈতন্যে ফিরে যেতে – একটি প্রখর খোঁচাই ছিল যাঁর কাঙ্ক্ষা – যিনি দেখেছিলেন ‘আগুনটা তার হতভাগ্য সহচরকে নিয়ে জ্বলে ওঠে বারবার!’ ১৯১৩ সাল নাগাদ সুররিয়ালিজমের প্রাক্কালে কবি গীয়ম অ্যাপোলিনেয়ার ‘জোন’ নামে কবিতা লিখেছেন যার কয়েক লাইন নিচে তুলে দিচ্ছি –
I saw a pretty street this morning I forgot the name
New and cleanly it was the sun's clarion
Executives laborers exquisite stenographers
Criss-cross Monday through Saturday four times daily
Three times every morning sirens groan
অর্থাৎ কেউই বিচ্ছিন্ন নন, এমনকি মৌলিকও নন, বরং ধারাবাহিক ঐতিহ্যে লগ্ন এবং দূরবর্তী ক্রীড়াভূমির দিকে আগুয়ান এক মশালবাহক। কবিতায় কাহিনি বলবার দায় নেই, কেননা তা অতি পবিত্র ও অতি ব্যক্তিগত, কেননা কবিতা সব কিছুই হতে পারে - অন্তরঙ্গ জার্নাল কিংবা বিকট ইস্তেহারের ছেঁড়া কয়েকটা পাতা। অনেক রক্ত বয়ে গেছে সেতুর তলা দিয়ে, যেভাবে খুশি কবিতা লেখা যায়, যেমনটা বলেন চিলির কবি নিকানোর পাররা, ‘শুধু শাদা পাতার চেয়ে উৎকৃষ্ট হতে হবে তোমাদের!’
পেটার হান্টকে-র কবিতায় এই গুণগুলি (কিংবা দোষ?) রয়েছে - ‘কবিতা’ অভিধা থেকে তা মুহুর্মুহু নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছে, অথবা ‘কবিতা’ অভিধার ঘেরাটোপটি মুছে দিয়ে আবছা করে ফেলছে – ‘আমার জীবন দাঁড়িয়ে রইল অনড় ঠিক সেই সময়কার মতো/ যখন আমার এতই মন খারাপ ছিল যে/ আমি টাইপ করা শিখতে চেয়েছিলুম/ আর সন্ধেগুলো অপেক্ষা করে কাটিয়েছিলুম জানলাবিহীন ছোটো ঘরে/ …নিওনটিউবগুলো গর্জন করে উঠছিল’ (কবিতাবিহীন জীবন)… ‘গভীর রাতে/ আবার সব ঝলমল করে উঠল/ বাইরে থেকে গুঁড়িয়ে গিয়ে/ আমি জ’মে যেতে শুরু করলুম/ পূর্ণ চৈতন্যে/ অবোধ আমার লিঙ্গ হঠাৎ মৃদু টানে/ খাড়া হয়ে উঠতে লাগল’ (নীল কবিতা)… এ কেমন কবিতা – যার মাথামুণ্ডু নেই, উদ্দেশ্য-বিধেয় নেই, পথচলতি বেকারের যত এলোমেলো ভাবনা, নিজের সঙ্গেই যা-কিছু গোপন আলাপ, তলে তলে চালানো ফন্দি ফিকির, রোজকার দৈন্য-দুর্দশা আর তা নিয়ে অর্থহীন রগড়, যা চমৎকার গতিতে এগিয়ে চলে, জাল বিছিয়ে ধরে, কখনো-বা থমকায়, গর্জে ওঠে, হয়তো বিষণ্ণ হয়ে পড়ে - যেখানে বিষয়প্রতিমা (থিম) নিজের গুরুত্বই হারিয়ে ফেলেছে, কারণ এই কবিতা যেমন কিছু-নিয়েই-নয় একইভাবে সব-কিছু-নিয়েই – সঙ্গীত যেমন আঙ্গিকসর্বস্ব একটি শিল্প – বা ধরা যাক বিমূর্ত চিত্র, ভঙ্গিই যেখানে প্রধান – কবিতাও তার কাছে চলে যাচ্ছে বুঝি! ‘অনেক হয়েছে কবিতাকে শাসনে রাখা, যুক্তিবুদ্ধি-র কাছে ঝুটমুট বেগার খাটানো – এবার ওকে ছেড়ে দেওয়া হোক’ … কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলছেন যুদ্ধোত্তর কবি-রা, ‘পুঁজিবাদী সভ্যতা যেমন চায় সব কিছু থেকেই ‘মানে’, ‘মূল্য’, ‘উপযোগিতা’ নিষ্কাশন করতে – শিল্পকে সেই ফাঁদে পড়তে দিও না’- নতুন কবিতার পক্ষে তাঁরা ডান হাত তুলে বলছেন - ‘তাকে অ-কাজের, অনর্থের, বিক্রয়-অযোগ্য করে তোলো!’
‘নতুন রাস্তার ওপর দিয়ে, বহুদিন পর, আমি হেঁটে চলেছি আজ
বহুদিন পর…
পায়ে চটি, বড়দিনে দেখেছিলাম একবার
ফাঁকা মোটরগাড়ির ভেতর, বেতের ঝুড়ি-ভর্তি ফুল
মেমসাহেব চুমু খাচ্ছে বাড়ির দারোয়ানকে
আঃ আমি সুন্দর ভাবে মরে যেতে পারি আজ’
(ভ্রমণ, ভাস্কর চক্রবর্তী)
আরও পড়ুন
জলপাইশাখার মধ্যে দিয়ে যেতে (দ্বিতীয় পর্ব)
এই কবিতা ১৯৭১ সালের একটি বই (শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা)-তে আমরা পড়েছিলাম। এই কবিতাটিতে কি বিষয় আছে? না, নেই, বরং আছে একজন বিষয়ী। এই মুক্ত, গোপন, গরম প্রশ্বাসে ভর্তি কথাগুলি যে বিড়বিড় করে যায়; কলকাতা, প্যারিস, নিউ ইয়র্ক কিংবা অস্ট্রিয়ার মধ্যে তেমন কোনো তফাৎও থাকে না আর, স্থান-কাল আবছা হয়ে গিয়ে কবিদের ঘুমন্ত মাথাগুলি একাকার হয়ে যায়। কেন না তফাৎ আর তেমন কিছুই নেই, ‘মাংস-পল্লী’ কাব্যনাট্যের অন্তে অনন্য রায় যেমন লেখেন – ‘প্রার্থনা ঘুরে ঘুরে/ ছড়িয়ে পড়ে অনাগতে, স্বপ্নে, গর্ভে, কপোতীর মতো অন্ধকারে/ মোটরগাড়ির শব্দে বেজে উঠল একতাল গাছের ট্রাম্পেট/ ওদিকে শিশুরা নাচে হাতে নিয়ে ভায়োলেট, হলদে ফুল, সবুজ উৎসব’, কিংবা বইয়ের শেষ কবিতা (যেটি নামকবিতাও বটে) ‘অর্থহীনতা আর সুখ’-এর অন্তে পেটার হান্টকে যেমন –
‘গেলাশটা আচমকা উলটে ফেলার পর,
তুমি ভাবো
বাচ্চাটিকে আর কখনও যদি তোমার দিকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে না হয়
হয়তো তাই হয়ে উঠবে সত্যিকার পথ।’
‘অর্থহীনতা আর সুখ’
পেটার হান্টকে
অনুবাদ – মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রথম সংস্করণের প্রকাশক - কবিয়াল
নতুন সংস্করণের প্রকাশক – প্রতিভাস (২০১১)