ধাক্কা মেরেই রোজগার তাঁদের, দিনশেষে মদ ও জুয়া – দিল্লির ‘ধাক্কামার’দের গল্প

তাঁদের পরিচয় ‘ধাক্কামার’ হিসেবে। যা তাঁদের পেশার পরিচয়ও বটে। শুনে অবাক হচ্ছেন? হ্যাঁ, বাঙালিরা সাধারণত এমন কোনো পেশার সঙ্গে পরিচিত নয়। কিন্তু খোদ রাজধানীতে দেখতে পাওয়া যায়’ ‘ধাক্কামার’দের। দিল্লির এই মানুষদের নাম এমন কেন? এমন অদ্ভুতুড়ে নাম দেখলে প্রশ্ন জাগবেই। তবে উত্তর পাওয়ার আগে, খানিক ভূগোলটাও জেনে নেওয়া দরকার।

আরও পড়ুন
মৃত্যুর আগেই সাক্ষাৎ নরকযন্ত্রণা – যেসব নৃশংস পদ্ধতিতে শাস্তি দেওয়া হত বিভিন্ন দেশে

যমুনা পাড় থেকে চাঁদনী চক অথবা পুরনো দিল্লি স্টেশনের পথ। পেরোতে হয় পুরানাপুল। পুরানাপুল হল যমুনা নদীর উপরে একটি ছোট ব্রিজ। যার উপর দিয়ে ট্রেন চলে, মাঝে মানুষজন গাড়িঘোড়া, আর নিচে যমুনা নদী। এই পুরানাপুল পার হয়ে, হনুমান মন্দিরের পাশে থেকে পুরনো দিল্লি স্টেশন যাবার রাস্তা পুরোটাই খাড়াই।

আরও পড়ুন
১৭০ বছর আগেই হারিয়েছিলেন সাহেবকে, ভুলে যাওয়া এক বাঙালি দাবাড়ুর গল্প

অন্যদিকে, গান্ধী নগর এবং যমনা পাড় জুড়ে শয়ে শয়ে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি। সেইসঙ্গে, এই ব্যবসার সঙ্গে জুড়ে থাকা আরও নানা ধরনের জিনিসের কারখানা। তাই কাঁচামাল এবং তৈরি হওয়া জামাকাপড় দুপাশে কাঠের বেড় দেওয়া ট্রলিতে অথবা রিক্সায় চাপানো হয়। তারপর পুরানাপুল পার হয়ে সামনেই হনুমান মন্দির। এই তল্লাটেই সকালের দিকে গেলে দেখা যায় ‘ধাক্কামার’দের।

আরও পড়ুন
৪০০টি শিশুহত্যা সঙ্গে জড়িত তিনি, মহিলা সিরিয়াল কিলারকে নিয়ে তোলপাড় ইংল্যান্ডে

হ্যাঁ ধাক্কামার অর্থাৎ যারা ধাক্কা মারে। ধাক্কা মারাতেও যে পেটের যোগান হতে পারে, তা দিল্লি ছাড়া জানা দুষ্কর। হনুমান মন্দিরের পাশ দিয়ে লাল কেল্লার লাল বাত্তি অব্দি রাস্তায় সার দিয়ে বসা মানুষ। সমস্তই ঝুজ্ঞীবাসী (বস্তিবাসী) বাঙালি, বিহারি এবং উত্তরপ্রদেশের লোক। গান্ধীনগর থেকে বোঝাই করা মালের রিক্সা অথবা ভ্যান পুরানাপুল পেরোলেই এঁদের ডাক পড়ে। কিন্তু কেন?

আরও পড়ুন
সমুদ্রে দাঁড়িয়ে সংক্রমিত জাহাজ, মৃত অধিকাংশ যাত্রী, কোয়ারেন্টাইনের শুরু সেখানেই

আসলে, হনুমান মন্দিরের সামনে থেকে দিল্লি স্টেশন অব্দি ২ কিলোমিটার রাস্তা উঠে গেছে চড়াইয়ের দিকে। এই রাস্তায় মালবোঝাই ভ্যান ঠেলে তোলাই কাজ ধাক্কামার-দের। বোঝাই করা রিক্সা অথবা ভ্যানচালকের একার পক্ষে এই পথ একা গাড়ি টানা সম্ভব নয়। তখন ধাক্কামারেরা এই পথটুকু তাদের গাড়ি ধাক্কা মেরে পৌঁছে দিয়ে আসেন। এক-একটি ভ্যান বা রিক্সা ঠেলে দুজন মিলে। এখন এঁদের মজুরি ১০ টাকা, দুজনের ৫ টাকা করে বখরা। সারা দিনে এই ধাক্কামারদের এক-একজনের রোজগার ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। এদের এই ধাক্কা মারামারি চলে রাত ১১টা অব্দি।

আরও পড়ুন
কলকাতা আক্রমণ করতে আসছে রাশিয়া, আতঙ্কে ইংরেজরা, সাহায্য প্রার্থনা বড়লাটের

দুপুরে খাবারের যোগান দেয় দিল্লির নানা লঙ্গর। প্রতিদিনই কেউ না কেউ (বিশেষত ধর্মভীরু পাঞ্জাবী এবং মারোয়ারি) হনুমান মন্দিরের সামনে অথবা চাঁদনী চক গুরুদোয়ারার সামনে লঙ্গর বসাচ্ছে। লঙ্গরে দুপুরের খানা খেয়ে সন্ধের মুখে এক ফাঁকে ঠেকা থেকে একটা দেশির কোয়ার্টার অথবা আদ্দা (কোয়ার্টার হল নিব আর আদ্দা হল পাঁইট) কিনে নিয়ে রাতে বাড়ি ফেরা। চাঁদনি অঞ্চল থেকে বাড়ি ফেরার পথে শাস্ত্রী পার্কের রাস্তার ধারার ঝুজ্ঞীতে তখন কাঠের চুলায় টমেটো চটকে জ্বাল দেওয়া চলছে। তাঁদের রাতের খাবার। ঝাল ঝাল টমেটোর রসে চুবিয়ে খান পনেরো রুটি পেটের ব্ল্যাকহোলে চালান করে দিয়ে আবার পরের দিনের ধাক্কা মারার প্রস্তুতি।

আরও পড়ুন
ভুলে যাওয়া ক্যালকাটা কেমিক্যাল, স্বদেশি যুগ ও শতবর্ষের মার্গো সাবান

শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা বারোমাসই ধাক্কামারেরা ভিড় জমান এই রাস্তায়। এদের বিলাসিতা বলতে দেশি দারু, আর পাশের পার্কের সস্তার দেহপসারিনী এবং জুয়া। শুধু তাসের জুয়া নয়, রাস্তার ধারে ধারে বসে অন্য এক জুয়া। একটা এক আঙুল চওড়া কাপড়ের বেল্ট তিন-চার ভাঁজ করে রাখা। একটা পেন ওই ভাঁজগুলির মধ্যে মাঝখানের ভাঁজে আটকাতে হবে। যদি পেনে বেল্ট আটকায় তবে জিত, আর পয়সা ডবল, নইলে সমস্ত ধাক্কার পয়সা ফক্কা।

আরও পড়ুন
বেঁচে গিয়েছিলেন জালিয়ানওয়ালাবাগে, পরে সেখানেই স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি হুগলির ডাক্তারের

পেটের তাগিদ মেটানোর এমন ধাক্কামারা কাজ দেশের আর কোনো এলাকায় আছে কিনা, জানা নেই। তবে দরিয়াগঞ্জ থেকে আই.এস.বি.টি, চাঁদনি চক থেকে গান্ধীনগরের বিস্তৃর্ণ অঞ্চল খুঁজলে এমন অনেক অত্যাশ্চর্য জীবিকার সন্ধান পাওয়া যায়। শুধুমাত্র পেট চালানোর জন্য যাঁরা বেছে নিয়েছেন একেকটি কল্পনাতীত পেশা। সে-গল্প অন্য আরেকদিন…

More From Author See More