১৭০ বছর আগেই হারিয়েছিলেন সাহেবকে, ভুলে যাওয়া এক বাঙালি দাবাড়ুর গল্প

সাহিত্যে হোক, বা সিনেমায়— জীবন সম্পর্কে একটি উপমা অনেক সময়ই ব্যবহার করা হয়। ‘চৌষট্টি খোপের জীবন’। বাস্তবিকই, দাবার চালের মতোই আমাদের জীবনটাও একটি নির্দিষ্ট ছকে, তালে তালে চলে। অনেক সময় যা ভাবা হয় না, তেমনটাই হয়ে যায়। এমনটাই হয়েছিল বাংলার এক ব্রাহ্মণ ছেলের ক্ষেত্রে। আপন মনে ছোটোবেলায় খেলত সে। একদিন সেই খবর পৌঁছল কোর্টের এক সাহেবের কাছে, যে কিনা নিজেও একজন সেরা খেলোয়াড়। তাঁকেই কিনা টক্কর দিচ্ছিল ছেলেটা! এমনই ছিল মহেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প; যার পরিচয় দেওয়া যাক বাংলা ও ভারতের এক বিস্মৃত দাবাড়ু হিসেবে…

আরও পড়ুন
ব্যাটসম্যানদের ত্রাস ছিলেন তিনি, হারিয়েছেন স্মৃতি, ২৫ বছর পর ‘প্রত্যাবর্তন’ বোলারের

সময়টা উনিশ শতক। তখনও কলকাতা ভারতের রাজধানী। সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হতে আর কিছু বছর দেরি। এমন সময় শহরে হাজির হলেন জন কোচরান। স্কটিশ এই আইনজীবী একজন দাবাড়ুও বটে। যে সে দাবাড়ু নয়। সেই সময়ের ইউরোপে দাবার সবচেয়ে শক্তিশালী খেলোয়াড় ছিলেন তিনি। খেলার জীবনে খুব কমবারই পরাজিত হয়েছেন। কলকাতায় এসে ব্যারিস্টারির পাশাপাশি দাবাও শুরু করলেন। স্বাভাবিকভাবেই, এরকম বিশাল খেলোয়াড়কে কেউই হারাতে পারছেন না। তার ওপর ক্যালকাটা চেস ক্লাবের প্রেসিডেন্টও তিনি। এমন সময় তাঁর কানে এল একটি নেটিভ ছেলের কথা।

আরও পড়ুন
কাঁটাতারের মাঝখানে লাগানো ঢেঁকি, খেলার মাধ্যমেই সম্প্রীতি দু’দেশের বাসিন্দাদের

মহেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলার এক মফঃস্বলের ছেলে। ছোট থেকেই বন্ধুদের সঙ্গে দাবা খেলা চলত; তবে এ দাবা বিদেশি দাবা নয়। ভারতীয় দাবা, যাকে শতরঞ্জ, পাশা বা চতুরঙ্গ বলা হয়। এর নিয়ম স্বাভাবিকভাবেই একটু আলাদা। কিন্তু এতেই যেন নেশা জন্ম হয় মহেশের। কেউ তাঁকে হারাতে পারে না। ঠিক এমন সময়ই তাঁর নাম কানে যায় জন কোচরানের।

আরও পড়ুন
খেলা আসলে বাঁচারই লড়াই, শিখিয়েছিলেন যে শিক্ষকরা

সালটা ১৮৪৮। দুজনের সাক্ষাৎ তো হল। খেলাও তো হবে এবার। কিন্তু ভারতীয় দাবা খেলে অভ্যস্ত মহেশচন্দ্র আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ঠিকঠাক গলাধঃকরণ করতে একটু সময় নিল। কিন্তু বেশ দ্রুতই শিখে যাচ্ছিল। ১৮৪৮ থেকে ১৮৬০ - এই ১২ বছরে বহুবার মুখোমুখি হয়েছে কোচরান আর মহেশের। এই ব্রাহ্মণ সন্তানের বুদ্ধিমত্তা দেখে অবাকই হয়ে যাচ্ছিলেন তখনকার সেরা প্লেয়ার কোচরান। বেশ কয়েকবার তাঁকে পরাজিতও করেন মহেশচন্দ্র। ধীরে ধীরে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়তে লাগল। ভারতের আন্তর্জাতিক দাবার ইতিহাসে জন্ম হল নতুন এক নক্ষত্রের। নাম মহেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় হলেও, বাকিরা জানল ‘দ্য ব্রাহ্মিণ’ নামেই।

আরও পড়ুন
জাতীয় স্তরে খেলার মুখেই আক্রান্ত ক্যানসারে, মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই ১৭ বছরের রাইফেল শুটারের

তবে এইটুকু কারণে কোচরান-মহেশের লড়াইটা স্মরণীয় থাকবে না। দাবার ইতিহাসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে এই পুরো সময়। প্রথমত, মহেশের সঙ্গে দ্বৈরথেই কোচরান প্রথমবার তাঁর বিখ্যাত ‘কোচরান গ্যাম্বিট’ চালটি ব্যবহার করেন। তবে আসল ঘটনাটি ঘটিয়েছিলেন স্বয়ং মহেশচন্দ্র। দাবা খেলায় আক্রমণাত্মক পরিকল্পনাও যেমন হয়, তেমনই থাকে ডিফেন্সিভ টেকনিক। মহেশচন্দ্র এই ডিফেন্সের ক্ষেত্রেই প্রচলিত ‘ফিয়ানচেত্তো’ পদ্ধতিকে আরও উন্নীত করেন। জন্ম হয় ‘দ্য ইন্ডিয়ান ডিফেন্স’-এর। আজ দাবার জগতে এই টেকনিক জানেন না, এমন মানুষ খুব কম আছেন। অন্যতম প্রধান এই কৌশলটির উদ্ভাবক ছিলেন বাংলার এক সাধারণ ব্রাহ্মণ সন্তান। সত্যিই কি সাধারণ বলা যায় তাঁকে?

আরও পড়ুন
মহাকাশের হদিশ কলকাতায়, ইসরোর সঙ্গে তাল মেলাল বাংলার পড়ুয়ারাও

এছাড়াও, ওপেনিং টেকনিকেরও কিছু বদল আনেন। আজও যা ব্যবহার করা হয়। ভাবুন একবার, উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় আন্তর্জাতিক দাবার জগতে নতুন পদ্ধতির আবিষ্কার হচ্ছে বাংলায়। করছেন একজন বাঙালি সন্তান, যিনি মাত্র কয়েকবছর হল দাবার প্রচলিত পদ্ধতি শিখেছেন। ভারতীয় দাবাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে আসেন তিনি। জন কোচরান রীতিমত মুগ্ধ হয়ে পড়েন ‘দ্য ব্রাহ্মিণ’-এর প্রতি। নিজের বইতেও উল্লেখ করেছেন মহেশচন্দ্রের কথা। আক্ষেপ, বাংলার প্রথমদিকের এই দাবাড়ুকে আমরা হয়তো মনেই রাখিনি। মহেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম বললে হয়ত আমরা অনেকেই চিনতে পারব না। কিন্তু সেটা কি সত্যিই তাঁর প্রতি সম্মান জানানো হল? স্মৃতির চৌষট্টি খোপের ভিড়ে আমরাই তাঁকে হারিয়ে ফেললাম, নয় কি?

Powered by Froala Editor

More From Author See More