বাগবাজারের ১৬ নম্বর বোসপাড়া লেনের বাড়িটিতে সেদিন এক বিরাট উৎসব। বাড়ির সদর দরজায় বসেছে মঙ্গলঘট। ফুলে ফুলে সেজে উঠেছে বাড়ি। আর কলকাতার গণ্যমান্য মানুষও তো কম আসেননি। কালীপুজোর সন্ধ্যায় স্বয়ং মা সারদা নিয়েছেন পুজোর দায়িত্ব। ইতিমধ্যে এসে জুটেছে পাড়ার ছোটো ছোটো মেয়েরা। উপস্থিত স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁর সঙ্গে এসেছেন দুই সতীর্থ স্বামী ব্রহ্মানন্দ ও স্বামী সারদানন্দ। আর এই সবকিছু একসঙ্গে সামলাতে রীতিমতো নাজেহাল ভগিনী নিবেদিতা। বাড়িটা যে তাঁরই। আর এই অনুষ্ঠানের আয়োজকও তিনি।
আরও পড়ুন
বেলুড় মঠে ‘জ্যান্ত দুর্গা’ মা সারদারও পূজা করেছিলেন বিবেকানন্দ
১৮৯৮ সালের ১৩ নভেম্বর, কালীপুজোর রাতে পথচলা শুরু করেছিল নিবেদিতা বালিকা বিদ্যালয়। এই নাম অবশ্য তখন ছিল না। নিজের বসতবাড়িতে কিছু মেয়েকে ডেকে এনে পড়ানো শুরু করেছিলেন নিবেদিতা। এভাবেই ক্রমশ ভারতবর্ষের সঙ্গে একাকার হয়ে যায় এই ‘স্কটিশ’ নারীর জীবন। আর সেই সবকিছুর সাক্ষী থেকেছে বোসপাড়া লেনের (এখন সারদামণি সরণি) ১৬ নম্বর বাড়িটা। যৌবনে রবীন্দ্রনাথ নিজে এসে গান গেয়েছেন। আর শ্রোতার ভূমিকায় মহেন্দ্রলাল সরকার, মোহিনী চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। উপনিষদ নিয়ে আলোচনা করে গিয়েছেন জগদীশ্চন্দ্র বসু। এসেছেন অরবিন্দ ঘোষ, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত। গুপ্ত সমিতির বহু বিপ্লবী আশ্রয় নিয়েছেন এখানে।
আরও পড়ুন
‘নতুন মাস্টার পড়াতে পারেন না’, বিবেকানন্দ’কে চাকরি থেকে বরখাস্ত করলেন বিদ্যাসাগর
এই বাড়ির ইতিহাস বলতে গেলে শেষ হবে না। পাশেই গিরিশ ঘোষের বাড়ি, সারদামণির বাড়ি। আর রামকৃষ্ণদেবকে ঘিরে আত্মীয়তার এক গভীর বন্ধনে বাঁধা পড়েছিলেন সবাই। তবে সেই সবকিছুই বিস্মৃতির অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে বসেছিল। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছিল বাড়িটি। তবে শেষ পর্যন্ত উদ্যোগী হল সরকার। ২০১৩ সালে বাড়িটি তুলে দেওয়া হয় সারদা মিশন কর্তৃপক্ষের হাতে। আর তারপরই শুরু হয় সংস্কারের কাজ। সেইসঙ্গে তৈরি হল নিবেদিতার জীবনকে ঘিরে থাকা নানা সংগ্রহ দিয়ে ভরা একটি মিউজিয়াম। গত রবিবার সেই মিউজিয়ামের দ্বার খুলে গেল। উদ্বোধন করেন 'বিবেকানন্দ কেন্দ্র বৈদিক ভিশন ফাউন্ডেশন'-এর ডিরেক্টর লক্ষ্মী কুমারী। এরপর গিরিশ মঞ্চে এক বিশেষ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সারদা মিশনের সহ-সম্পাদক পরিব্রাজিকা জ্ঞানদাপ্রাণা। ছিলেন পরিব্রাজিকা ভবানীপ্রাণা, পরিব্রাজিকা নির্ভীকপ্রাণা।
আরও পড়ুন
রামকৃষ্ণের জিভ চেপে ধরলেন মহেন্দ্রলাল, প্রশ্ন তুললেন ‘পরমহংসগিরি’ নিয়েও
এই মিউজিয়ামটি তৈরি হয়েছে অভিনব অডিও-ভিজুয়াল সিস্টেমে। এখানে কোড স্ক্যান পদ্ধতির মাধ্যমে বিশেষ রেকর্ডিং চালু হবে। অথচ বাড়ির নবরূপায়নের জন্য নেওয়া হয়েছে সেই পুরনো পদ্ধতি। ডিমের কুসুম, গাওয়া ঘি আর দইয়ের জল দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ওয়েদার-কোট। সরষের তেল দিয়ে পালিশ করা হয়েছে ছাদের মেঝে। এভাবেই ঐতিহ্যের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছে আধুনিকতা। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে মার্চের ২০ তারিখ থেকেই দর্শকদের জন্য খুলে যেত এই সংগ্রহশালা। কিন্তু করোনা-আতঙ্কের কারণে এখনই জনসমাগম চাইছেন না সারদা মিশনের আধিকারিকরা। এমনকি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানও হয়েছে অত্যন্ত ঘরোয়াভাবেই। ৩১ মার্চের পর জনগণের জন্য মিউজিয়াম খুলে দেওয়া হবে বলেই জানা গিয়েছে। আর ততদিন পর্যন্ত তাই নিবেদিতার জীবনের সাক্ষী হতে অপেক্ষা করতেই হবে আমাদের।