রামকৃষ্ণের জিভ চেপে ধরলেন মহেন্দ্রলাল, প্রশ্ন উঠল ‘পরমহংসগিরি’ নিয়েও

সময়টা উনবিংশ শতক। গুরুতর অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। ক্রমাগত বমি হচ্ছে, সেই সঙ্গে বেরিয়ে আসছে তাজা রক্ত। এ কি হল ওঁর! চিন্তায় পড়ে গেছেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ, নরেন দত্ত-সহ সমস্ত গৃহী, ত্যাগী শিষ্যরা। অ্যালোপেথি, হেকিমি, কবিরাজি - সমস্ত কিছুই তো চেষ্টা করা হল। বাকি আছে একটিই। হোমিওপ্যাথি। গিরিশ ঘোষের একান্ত ইচ্ছায় কাশীপুরে এলেন এক ডাক্তার। সাদা মোটা গোঁফ, রাশভারী চেহারা। রুক্ষ মেজাজের জন্য বিখ্যাত; কিন্তু সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি। কাজেই ভয় তো ছিলই সবার। কারণ, ডাক্তারের নামটি যে মহেন্দ্রলাল সরকার!

শুধু ডাক্তার হিসেবে নয়, বাংলা ও ভারতে আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার অন্যতম পথপ্রদর্শক এই মানুষটি। বিজ্ঞান গবেষণা, তার পরিকাঠামো, ডাক্তারিতে মেয়েদের আনা; সেই সঙ্গে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই— সেই সময় এই কাজ করার জন্য বেশি কাউকে পাশে পাননি তিনি। বরং পদে পদে সহ্য করেছেন কটূক্তি। অবশ্য তিনি যে ‘দ্য’ মহেন্দ্রলাল সরকার। কারোর তোয়াক্কা যে কোনোদিনও করেননি। যেটা নিজে মনে করে এসেছেন, সমাজের সার্বিক ভাল হবে যেটায়, তিনি তো সেটাই করবেন।

আরও পড়ুন
‘তুমি তো বড় ছ্যাঁচড়া!’ – বিরক্ত হয়ে বঙ্কিমচন্দ্র’কে বললেন রামকৃষ্ণ

বাবা চলে গিয়েছিলেন বেশ ছোটো বয়সে। পাইকপাড়ার বাড়ি ছেড়ে তখনই চলে আসা নেবুতলায় মামাবাড়িতে। হেয়ার স্কুল থেকে হিন্দু কলেজ (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়), সব জায়গায় সেরা ছাত্র তিনি। কলেজের অধ্যাপকরাও মুগ্ধ তাঁর মেধায়। সমস্ত কিছু চলছিল, এমন সময় মহেন্দ্রলালের নজর পড়ল ডাক্তারিতে। অধ্যাপকরা বারণ করলেন; কিন্তু কিছুতেই শুনলেন না তিনি। ঠিক যখন করেছেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হবেন, তো হবেনই। ভাগ্যিস হয়েছিলেন!

ডাক্তারিতেও সেরা হয়ে উঠলেন তিনি। ছাত্রাবস্থাতেই তিনি রীতিমত বিখ্যাত। স্নাতকোত্তর পাশ করেন ১৮৬৩ সালে। মহেন্দ্রলাল সরকারই ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় এম.ডি. যিনি স্নাতকোত্তর হন। অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসাপদ্ধতিই ছিল তাঁর অবলম্বন। হোমিওপ্যাথিকে ততটা গুরুত্বও দিতেন না। একবার সবার সামনে সভায় দাঁড়িয়ে এই পদ্ধতিকে ‘হাতুড়ে চিকিৎসা’ বলেন। তিনিই কিনা একদিন চলে আসবেন হোমিওপ্যাথিতে! গোটা বাংলা তাজ্জব হয়ে গিয়েছিল এই খবরে। ততদিনে অবশ্য মহেন্দ্রলাল একজন বিখ্যাত ডাক্তার। আর ততটাই বিখ্যাত তাঁর ‘স্বভাব’-এর দাপট।

আরও পড়ুন
মুসলমান গুরু গোবিন্দ রায়ের কাছে দীক্ষা, মহম্মদের দেখা পেলেন রামকৃষ্ণ

একবার বউবাজারের এক বাড়িতে গেছেন মহেন্দ্রলাল। জমিদার বাড়ি, স্বয়ং গিন্নিমা অসুস্থ। অতএব, তলব মহেন ডাক্তারকে। স্টেথোস্কোপ বসাতে যাবেন, এমন সময় এল বাধা। পরপুরুষের সামনে কি করে মুখ দেখাবে জমিদার-গিন্নি। পর্দার এপারে রোগী, ওপারে ডাক্তার। কেউ কাউকে দেখছেন না। ওপার থেকে স্টেথো এগিয়ে দিলে কোথায় বসাচ্ছে, কেউ দেখতে পাচ্ছে না। জমিদারও সেরকম। বিরক্ত হয়ে গেলেন মহেন্দ্রলাল। উঠে আসতে যাবেন, এক ছেলে তাঁর ফি এগিয়ে দিচ্ছে। ক্রুদ্ধ ডাক্তার ফি নিয়ে সটান ছুঁড়ে ফেলে দিলেন মাটিতে। তারপর গটগট করে উঠে বসলেন নিজের গাড়িতে।

এরকম আরও বহু ঘটনা ঘটেছে তাঁর ডাক্তারি জীবনে। তবে এই ঘটনা তাঁর জীবনের আরও একটি কাজের সঙ্গে যুক্ত। মহিলা রোগীদের দেখার সময় মহেন্দ্রলাল অন্যভব করতেন এই দেশে মহিলা ডাক্তারের গুরুত্ব কতটা। না হলে অনেক রোগী তো বেঘোরে চলে যাবে। মেয়েরাও যাতে ডাক্তারি পড়ে, তা নিয়ে জোরদার প্রচার চালান মহেন্দ্রলাল। তাঁর সামনে অবশ্য দুইজন ছিলই, যাঁদের ওপর ছিল অগাধ আস্থা। অবলা এবং কাদম্বিনী। তিনি দেখেছেন, ডাক্তার হওয়ার জন্য কি অসম্ভব পরিশ্রম করছে মেয়ে দুটো। কিন্তু বিধি বাম! চেন্নাইতে ডাক্তারি পড়তে গিয়ে মাঝপথেই অসুস্থ হয়ে পড়েন অবলা। ফিরে আসেন কলকাতায়। বিয়ে করেন তখনকার বিজ্ঞানের এক শিক্ষক, জগদীশ চন্দ্র বসু’কে। পরবর্তীকালে জগদীশ ও অবলা দুজনেই ইতিহাসে জায়গা পাবেন। তবে মহেন্দ্রলালের স্বপ্নের শুরুটা হয়েছিল কাদম্বিনীর হাত ধরে। স্বামী দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো বন্ধু, মহেন্দ্রলাল সরকারের মতো শিক্ষককে পেয়েছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ই হয়েছিলেন ভারতের দ্বিতীয় মহিলা ডাক্তার; আর বাংলার প্রথম।

আরও পড়ুন
বিরোধীরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ, ‘গণতান্ত্রিক’ পথেই জয় এনেছিলেন বিদ্যাসাগর

উনবিংশ শতকে গোটা বিশ্বের বিজ্ঞানের অগ্রগতির নিরিখে ভারত এবং বাংলা অনেকটাই পিছিয়ে ছিল। সেরকম প্রতিষ্ঠান নেই, গবেষণার সুযোগ নেই, পরিকাঠামো নেই; তার ওপর সমাজে আষ্টেপৃষ্ঠে আছে কুসংস্কার। বিজ্ঞানকে যে করেই হোক, মূল স্রোতে ফেরাতে হবে। আধুনিক করতে হবে- এই ছিল তাঁর ব্রত। বাস্তব জীবনেও মহেন্দ্রলাল সরকার ছিলেন ঘোর নাস্তিক। কুসংস্কার আর ধর্মের গোঁড়ামি দেখলে একেবারে সামনেই যা নয় তাই বলে দিতেন। এখানেই একটি ঘটনার সূত্রপাত দেওয়া যাক। স্বামী বিবেকানন্দের বিখ্যাত ‘কালী, দ্য মাদার’ কবিতাটি একটি বিশেষ সভায় পাঠ করছিলেন ভগিনী নিবেদিতা। সেখানে অন্যান্য অতিথিদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারও। মাঝপথেই রীতিমত চিৎকার করে উঠেছিলেন তিনি! এ কী হচ্ছে! সমাজসেবা বাদ দিয়ে এখন ধর্ম, আর কালী নিয়ে বক্তৃতা হবে! বিজ্ঞান নেই! তাঁর প্রতিবাদে সঙ্গ দিয়েছিলেন আরও বেশ কিছু ব্যক্তিত্ব। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠের চিৎকারে একপ্রকার দমেই যান মহেন্দ্রলাল। সভা ছেড়ে বেরিয়ে যান তখনই।

সেই সময় কেউ বুঝতে না পারলেও, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে মহেন্দ্রলাল সরকারের অবদান অস্বীকার করা কখনই যাবে না। বটগাছের মতো দাঁড়িয়ে আছে তাঁর নিজের হাতে তৈরি করা সংস্থা ‘ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট ফর দ্য কালটিভেশন অফ সায়েন্স’। ১৮৭৬ সালে তৈরি হওয়া এই প্রতিষ্ঠান ভারতের প্রাচীনতম গবেষণাকেন্দ্র। বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য এরকম নিবেদিতপ্রাণ মানুষটি যতই রগচটা হন না কেন, তাঁকে কি অস্বীকার করা যায়!

আরও পড়ুন
সারদা দেবীর মা শ্যামসুন্দরীকে দেখা দিলেন রক্তবর্ণা দেবী, জয়রামবাটীতে শুরু হল জগদ্ধাত্রী পুজো

প্রসঙ্গ শুরু হয়েছিল রামকৃষ্ণ দিয়ে। ওঁর শেষ কয়েকটি বছর চিকিৎসার দায়িত্বে ছিলেন ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার। কাশীপুরের বাগানবাড়িতে ঢুকেই তাঁর প্রথম প্রশ্ন ছিল, “এত পরমহংসগিরি করছ কেন?” তাঁর কাছে, ইনি ‘মথুরবাবুর শখের জিনিসমাত্র’। ওরম শখ নাকি বড়লোকদের হয়েই থাকে। মুখরা ডাক্তারকে রীতিমত ভয়ই পেতেন রামকৃষ্ণ। একবার পরীক্ষা করার জন্য মহেন্দ্রলাল এত জোরে তাঁর জিভ চেপে ধরেছিলেন যে রীতিমতো যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠেছিলেন। বলেছিলেন, “ভারী যন্ত্রণা হয়েছিল গো, যেন গরুর জিভ চেপে ধরেছে।” কিন্তু সময় যত এগোতে থাকে, ছবিটা বদলে যায়। না, নাস্তিকতা ত্যাগ করেননি। কিন্তু রামকৃষ্ণের মধ্যে ‘একজন খাঁটি মানুষ’-কে খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি। বুঝতে পেরেছিলেন, মানুষটি আর বেশিদিন নেই। ক্যানসার আঁকড়ে ধরেছে। মহেন্দ্রলাল সরকারও কি হারিয়ে গেলেন আমাদের কাছে?

ঋণ-
১) প্রথম আলো, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
২) বঙ্গ গৌরব, জলধর সেন

Powered by Froala Editor

More From Author See More