সেই হাতিটার কথা; দিদিমার কাছে এসে যার গল্প শুনেছিলেন মণীন্দ্র গুপ্ত। আমাদের এখন মনে পড়ছে। জল থেকে কাঠ তোলার কাজ; শুঁড় বাড়িয়ে একটা গুঁড়িকে জড়িয়ে ধরতে একটু জলে নেমেছিল। অমনি তলতলে কাদায় পা বসে গিয়েছে। দু-একবার পা তোলার চেষ্টা। আরও ডুবে যাওয়া; অচিরেই হাতিটা বুঝে যায় অদৃষ্ট। নিয়তিতাড়িত সে। যত উঠতে যায়, তত ডুবে যায়। একদিন যায়, দু-দিন; তার মাহুতের অনেকরকম চেষ্টা; সুরাহা তবু হয় না। হাল ছেড়ে দেয়; হাতিটি ডুবতে থাকে। কাদায়; তার চোখে জল আসে। লোকে বলছে, শুঁড় উঁচিয়ে হাতি কোনোরকমে বাঁচার চেষ্টা করবে, তারপর দমবন্ধ; মৃত্যু। মাহুত বসে থাকে; হতাশ, অবসাদগ্রস্ত; মৃত্যুর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে হাত নাকি স্বপ্ন দেখবে। তার বনজীবনের স্বপ্ন, শৈশবের, এমনকি মৃত্যুর পরের, ভবিষ্যতের। এইভাবে পাঁচদিন। শেষে চা-বাগিচার সাহেবের গুলি; এই যন্ত্রণা থেকে হাতির নিষ্কৃতি; সেই হাতি ক্রমাগত ডুবছে, কল্পনা করতেন মণীন্দ্র, হাতির বিরাট কঙ্কাল সাদা হয়ে নেমে যাচ্ছে নিচে, পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে।
আরও পড়ুন
গৃহবন্দিরা ‘একা’ নন, সাহায্যের জন্য ২৫০টি স্বেচ্ছাসেবী দল ইংল্যান্ডে
হাতিটা এখন আমরাই। মানুষ বা মানব; আমাদের সভ্যতা। অপকর্মের তলতলে কাদায় ডুবে গেছে পা। হ্যাঁচোড়-প্যাঁচোড় করে ছাড়াবার যত চেষ্টা, বৃথা গেছে। পা থেকে কোমর, বুক-গলা-শরীর ডুবতে বসেছে সভ্যতার। এখন মৃত্যুছায়া স্পষ্ট; এখন স্বপ্ন ফিরে আসার কথা। শৈশবের। সেই জীবনের, যা জীবন বলেই প্রতিভাত; কৃত্রিমতা নয়, বানিয়ে তোলা জীবন নয়। এখন অবধারিত ভবিষ্যৎ-ভাবনা। কী হবে? যদি নাই-ই থাকি! মানুষ নেহাতই অসহায় এই প্রশ্নের কাছে।
আরও পড়ুন
নাৎজি সৈনিক ও ইহুদি বন্দিনীর প্রেম, যে অপূর্ণ সম্পর্কের সাক্ষী ছিল কনসেনট্রেশন ক্যাম্প
অথচ দিন একুশের আপাত বন্দিদশা এক ঝটকায় মানুষকে এনে ফেলেছে যাবতীয় গূঢ় ও গাঢ় প্রশ্নের মুখে; লহমার ঝড়; সরিয়ে দিয়েছে অনেক কৃত্রিমতা; বানিয়ে তোলা সংকট। বিভাজন; এখন অপরাধবোধ; এমনটা না-হলেই ভালো হত; প্রকৃতির উপর যারপরনাই জবরদস্তি। দেখেও না-দেখার ভান; নেহাতই উৎপ্রেক্ষা; শহর-গ্রাম ভেদাভেদ; শ্রেণির সমস্যা; সাম্য ও স্বপ্ন; অথবা কিছুই না-হওয়ার আক্ষেপ; সব ধুয়েমুছে গিয়ে জেগে আছে কেবলই কৃতকর্ম; আর-একটু আগে, এই বোধ-চেতন হলে, না-রাজনীতির বিভ্রান্তিমূলক অবস্থান ও দলীয় রাজনীতির সংকীর্ণ বাস্তবতা থেকে বেরিয়ে, মানুষে মানুষে সম্পর্কের ভিতর যে প্রসারিত অর্থে রাজনীতি - তা স্পর্শ করতে পারলে, হয়তো এড়ানো যেত; এই বিপর্যয়; কিং সিসিফাসের সাজা; নিয়তিতাড়িত জীবনের মহামারী! কিন্তু কারও কু-কর্মের ভার কেউ নেয় না; মানুষের-ও না। ফলে মানুষকেই এবার উইঢিবির অন্তরালে যেতে হবে। ফিরে পেতে হবে বোধ। বন্দিদশা তাই নির্ধারিত। অবধারিত-ও।
আরও পড়ুন
রাস্তার ধারের লাইব্রেরিই হয়ে উঠছে প্যান্ট্রি, মানবিকতার বিরল ছবি আমেরিকায়
আমাদের সমস্যা হচ্ছে। হওয়ারই কথা; প্রধানত তা মানসিক, যারা নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা-সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এমন কি হয় না যে, প্রকৃতি যেখানে এতটাও সদয় নয়, সেখানকার অধিবাসীরা প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম জোগাড় করে অন্তরীণ যাপনেই অভ্যস্ত! হয়; কিন্তু তার নির্দিষ্ট ছন্দ থাকে। থাকে অভ্যাস। এইরকম আচমকা চেপে বসা বন্দিদশায় মানুষ সে অভ্যাস রাতারাতি আয়ত্ত করতে পারে না। ফলে মনোজগতে নানারকম সমস্যা দেখা দেয়। ঠিক যেমন দেখা দেয় চিড়িয়াখানার প্রাণীদের। যাদের উপর বন্দিত্ব আরোপ করে মানুষ। ডেসমন্ড মরিস সাহেবের এ-বিষয়ে অসামান্য পর্যবেক্ষণ আছে। নাগরিকতায় বন্দি মানুষ আর এই প্রাণীদের আচরণ-ব্যবহারের সমান্তরালতা খুঁজেছিলেন তিনি। সে বেশ অস্বস্তিকর; নিজেদের বন্দি ভাবতে কার ভালো লাগে, যদিও সকলে বন্দি-ই বস্তত।
আরও পড়ুন
মহামারীর জন্য ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’, ঘরে বসেই মাধ্যাকর্ষণ সূত্র আবিষ্কার নিউটনের
অথচ ঠিক প্রাণীদের মতোই জীবন চেয়েছিলেন বছর তেইশের এক যুবক, নাম মাইকেল সিফ (Michel Siffre)। তাঁর ধারণা অবশ্য একটু অন্যরকম ছিল; প্রাণীদের মতো যাপন বলতে, মানুষের বেঁধে দেওয়া নিয়মের বাইরে সধারণ প্রাণী হিসেবে মানুষের যাপন কেমন হয়, তাই-ই বুঝত চেয়েছিলেন তিনি। সামান্য কিছু উপকরণ নিয়ে তাই ডুব এক গুহায়। নিয়ম হচ্ছে, তিনি যখন জাগবেন এবং ঘুমোতে যাবেন তখন বাইরের লোকেদের জানিয়ে দেবেন। কিন্তু বাইরের কেউ তাঁকে সময় জানাবে না। দেখা গেল, সময়ের ধারণাটাই সেখানে বদলে যাচ্ছে। দিন বা রাত বলে কিছু নেই। এখন খেতে হবে, এখন ঘুমোত হবে এরকমও কিছু নেই। এমনকি ২৪ ঘণ্টায় এক দিন-রাত এই ব্যাপারটাই নেই। হতে পারে, টানা ১২ কি ১৪ ঘণ্টা ঘুমোলেন। তারপর টানা ৩৬ ঘণ্টা কাজ করলেন। অর্থাৎ সাইকেলটাই বদলে যাচ্ছে। আদতে, যে সাইকেলটা মানুষ তার সুবিধামতো তৈরি করেছে ও মহাশয় শরীরকে দিয়ে তা সইয়ে নিয়েছে, তা মুছে গিয়ে একটি আশ্চর্য নিজস্ব ঘড়ি সচল হয়ে উঠেছে। ১৯৬২ সালে জুলাই মাসে এই গুহাবাস পর্ব শুরু হয় তাঁর। শেষ হওয়ার কথা সেপ্টেম্বর ১৪-তে। যখন বাইরের লোকজন জানাল, সময় ফুরিয়েছে, তখন যুবকের হিসেবে মাস গিয়ে দাঁড়িয়েছে মোটে ২০ আগস্ট। এমনকি আনুমানিক এক সেকেন্ড প্রতি সংখ্যা - এই ছন্দে ১২০ অবধি গুনতেন তিনি। যা হওয়ার কথা ২ মিনিট, তা আসলে ৫ মিনিট হচ্ছিল মানুষের বেঁধে দেওয়া সময়ের নিয়মে। পরে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, এইরকম পরিস্থিতিতে আমাদের স্মৃতিতে সময়ের ছাপ থাকে না। আরও মোটা দাগে বললে, এ আসলে অভ্যাসের-ই ছাপ। যা আমাদের বলে দেয়, এখন অফিস যাওয়ার, এখন আড্ডা দেওয়ার, খাওয়ার, ঘুমোনোর সময়। কিন্তু এই ধরনের পরীক্ষা জানিয়ে দেয়, সময়ের ছাপ যদি না-থাকে তাহলে একদিন কি দু-দিন আগে এই সময়ে ঠিক কী করা হয়েছিল তা মনেই থাকে না। ফলে, এখন আমাদের এটা করার কথা, এবং এটা করতে না-পারার যে অবসাদ, তা আসার প্রশ্নই থাকে না।
আরও পড়ুন
সমুদ্রে দাঁড়িয়ে সংক্রমিত জাহাজ, মৃত অধিকাংশ যাত্রী, কোয়ারেন্টাইনের শুরু সেখানেই
আমরা খেয়াল করলে দেখব, আমাদের বর্তমান সমস্যা এই যে, আমরা আমাদের স্বাভাবিকতা থেকে দূরে সরে গেছি বলে ভাবছি। সেইহেতু বিরক্তি; কিন্তু বরং আমাদের ভাবা উচিত যে, স্বাভাবিক বলতে আমরা যা বুঝি, সেটাই স্বাভাবিক কি না! নাকি যা স্বাভাবিক হিসেবে ধার্য ছিল, সেটাই আসলে বেঁধে দেওয়া নিয়মের বন্দিদশা। বরং বন্দিদশা বলতে আমরা যে অবস্থার কথা ভেবে কষ্ট পাচ্ছি, তা অনেকাংশে আমাদের স্বভাবিকতার অভিমুখী করে তুলবে। ভাবনার কাঁটা উলটে নিলে বোধহয় এরকম সংকট মুহূর্তে আমাদের মনের ভার খানিক লাঘব হবে।
আরও পড়ুন
শাঁখ, উলুধ্বনি, বাজিতে উত্তাল গোটা দেশ, করোনার সঙ্গে দীর্ঘযুদ্ধের প্রস্তুতি?
তবে, এই ধারণাবিশ্বের বাইরে যা প্রবল ও অনতিক্রম্য - তা ক্ষুধা। তা যে-কাউকে রাস্তাতে নামাবেই। দেশভাগ না-দেখা, মন্বন্তর না-দেখা প্রজন্ম যে ভুলে পা দেয়, সে আক্ষেপ - ঋত্বিক কুমার ঘটকের - ঝরে ঝরে পড়েছিল সুবর্ণরেখায়। একদিন, আমরা এতই দুর্বল হয়ে পড়ি, যে আত্মহত্যার ক্ষমতাও থাকে না; তারও বেশি নিয়তি লেখা থাকে অদৃষ্টে; বেঁচে থেকেই সীতার মৃতচক্ষু দর্শন। দেখেছিলেন নিবারণ চক্রবর্তী; দেখছি আমরাও, আজ, এই সংকটের দিনে; ফ্রি ইন্টারনেট আর মুখরোচক ভিডিওতে মশগুল এ-প্রজন্ম জানত-ই না, তাদের জন্য কী অপেক্ষায়; তারা বর্মহীন; উলটে এই প্রচারসর্বস্ব, আত্মভর, খণ্ডিত মনসংযোগের যুগে মানসিক স্থৈর্য, সহিষ্ণুতার যে অনুশীলন আবশ্যক, তা-ও তার ধাতে নেই। ফলে আগত মারী একা রাম নয়, সুগ্রীবও দোসর…
আরও পড়ুন
টেডি বিয়ারের বুকে অকালমৃত সন্তানের হৃদস্পন্দন, আবেগতাড়িত বাবা
এরপর হয়তো অপেক্ষায় আছে মন্বন্তর; অন্তত এইসময় রাষ্ট্র যদি কল্যাণকামী ভূমিকা না নেয়, তবে তা অবধারিত। এবং, অবধারিত মানুষের আদিমতার প্রকাশ। সভ্যতার পলেস্তরা, এই খিদে ও বাঁচার মুহূর্তে, খুলে খুলে পড়ে যায়; জেগে ওঠে এক আদি অকৃত্রিম প্রাণী যে কেবল নিজের জন্যেই নিজে বাঁচতে চায় খেতে চায় খাবার জমাতে চায়। মানুষের কথা না-ভেবে, মারী ছড়িয়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা সত্ত্বেও সে জমায়েতে ক্লেশ বোধ করে না। দোষ খানিকটা স্বভাবে। তবে মুখ্য অভাবের দিকটিও। আমাদের দেশের যেরকম অর্থনৈতিক অবস্থা, এবং সাম্প্রতিক অতীতে তা যেভাবে অচেনা পাহাড়ি রাস্তায় হোঁচট খেয়ে হাঁটার মতো করে করে এগোচ্ছে, তাতে মানুষ কীই-বা করবে! একশ্রেণীর সঞ্চয়ই নেই; যাদের আছে, তাদের সঞ্চয়ে সুদ ক্রমহ্রাসমান; সাহায্যের প্রতিশ্রুতি নেই; এদিকে দাম বাড়বে; খাবার মিলবে না; স্বল্প আয়োজনেই দিন অতিবাহিত হবে; দোকানপাঠ খাঁ খাঁ; ঘোর দুর্দিনে মজুত করা মাল লুটও হতে পারে; আশঙ্কা মাত্র। সত্যি না হয়, এই প্রার্থনা। কিন্ত এসবের মূলকথা এই যে, যা যা অপ্রত্যাশিত, তাই-ই হতে পারে; অন্তত তার সম্ভাবনা অনেকটাই। জোরটা সেখানেই হওয়া উচিৎ।
আরও পড়ুন
মহামারী রুখতে পথে রবীন্দ্রনাথ, ঘরছাড়া জগদীশচন্দ্র; মারা গেল অবনীন্দ্রনাথের ছোট্ট মেয়ে
এই লকডাউনে মনভার কাটানোর নানা খেলাধুলো, হালকা হাসির প্রস্তাবনা ঘুরছে ইতিউতি; নিশ্চিত তার গুরুত্ব আছে। তবু জরুরি মনে হয়, আমাদের মানসিকভাবে তৈরি থাকা, শক্ত থাকা। অনাগতর জন্য; কারণ, ২১ দিন পেরোলে যে আমরা আবার চেনা ছন্দ ও অভ্যেসের পৃথিবীতেই ফিরব, এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। চেনা যাপন বহুলাংশে বদলে যেতে পারে; আমাদের অভিজ্ঞতা নেই, কিন্তু বাস্তববোধ আছে। তা আমাদের জানাচ্ছে, একঘেয়ে লাগার বিলাসিতা এখন বাহুল্য মাত্র। কার একঘেয়ে লাগছে? আমার না আমার অভ্যেসের যাপনের? যদি অভ্যেস আমি না-হই, আমি তবে কে? হেরাক্লিটাস বলেন, এক নদীতে দু-বার স্নান করা যায় না। কেন-না নদী বদলে যায়, এক থাকে না; ঠিক তেমনই, যেখানে চেনা পৃথিবী বদলে যাওয়ার মুখে, এক না-থাকার সম্ভাবনাই প্রবল, সেখানে এক অভ্যেসের আমিকে আঁকড়ে ধরে একঘেয়ে লাগা বা অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ার থাকার কী-ই বা সার্থকতা! বরং আমরা বুঝে নিই যে, আমাদের এতদিনের যাত্রায় কত ক্লেদ জমেছিল! কত কালি মাখা হয়েছে হাতে-মুখে; আমাদের তবুও হেলদোল ছিল না। এই মারী যদি পেরোতে পারি, তারপর থেকে সেই খেয়াল থাকবে তো? অতীত আর ভবিষ্যতের ভিতর বিস্ময়চিহ্ন হয়ে থাকা এই সময়টুকু বরং বদলে যাক সেই প্রশ্নে এবং উত্তরসন্ধানে।