কবে সারবে পৃথিবীর এই অসুখ? করোনা মহামারী আক্রান্ত পৃথিবীতে প্রশ্ন এখন একটাই। প্রশ্ন উঠেছিল বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে আরেকটি মহামারীর সময়েও। ১৯১৮-২০ সালের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ে মারণ ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রকোপ। সেই সময়েও ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রকোপ কবে কমবে তার সঙ্গে সঙ্গে আরও একটি প্রশ্ন উঠে গিয়েছিল প্রবল ভাবে, যা হল মৃত্যুর পরে আমাদের কী হয় এবং সত্যি সত্যিই মৃত প্রিয়জনদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব কিনা?
আরও পড়ুন
ফেলুদার শহরে শার্লক হোমসের ঠেক; ঢুঁ মারতেন সুকুমার সেন, প্রেমেন্দ্র মিত্র, নীরেন্দ্রনাথ, সমরেশ বসুরা
১৯১৮ সালের নভেম্বরে শেষ হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। সরকারি হিসাব মতে এর ফলে সারা বিশ্বব্যাপী প্রায় ২০ লক্ষ সেনা কর্মীর মৃত্যু হয়। আর ওই সময়েই শুধুমাত্র ইনফ্লুয়েঞ্জাতেই মারা গিয়েছিলেন কমপক্ষে ৫০ মিলিয়ন বা ৫ কোটি মানুষ। উভয় ক্ষেত্রেই বেশিরভাগ ক্ষতিগ্রস্তের মধ্যে ছিলেন তরুণরা, যাদের বয়স কুড়ি থেকে চল্লিশের মধ্যে।
আরও পড়ুন
সিনেমায় চশমা-পরা ব্যোমকেশ, সত্যজিতের ‘চিড়িয়াখানা’ দেখে অখুশি শরদিন্দু
এর পরেই একটা আশ্চর্য প্রবণতা দেখা দিতে শুরু করে তথাকথিত উন্নত প্রথম বিশ্বের দেশেও। একশ্রেণীর আধ্যাত্মিক তথা পরলোক তত্ত্ব চর্চাকারী গোষ্ঠী প্রচার করতে শুরু করেন যে, এই সমস্ত মৃত ব্যক্তিরা পুনরুজ্জীবন পাচ্ছেন ইউরোপের নানান দেশে। তাদের সঙ্গে বর্তমান যুগে ফেলে যাওয়া প্রিয়জনদের দেখা করিয়ে দেওয়াই এই গোষ্ঠীর জীবনের ব্রত। ১৯২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিখ্যাত নিউইয়র্ক সান পত্রিকায় হেডলাইন হয়: “Riddle of the Life Hereafter Draws World’s Attention.”
আরও পড়ুন
অপরাধীকে শনাক্ত করবে তার কানের গঠনই, ১৪০ বছর আগে গবেষণা ফরাসি গোয়েন্দার
এই পুনরুজ্জীবন তত্ত্বের পিছনে অন্যতম দুটি বিখ্যাত নাম ছিল স্যার আর্থার কোনান ডয়েল এবং স্যার অলিভার লজ। পৃথিবী বিখ্যাত গোয়েন্দা শার্লক হোমসের স্রষ্টা আর্থার কোনান ডয়েল এবং রেডিও তরঙ্গ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা শ্রদ্ধেয় পদার্থবিদ অলিভার লজ যুদ্ধে হারিয়েছিলেন পুত্রদের। ১৯১৯ সালে ডয়েলের ছোটো ভাইও মারা যান ফ্লু-তে। ঐতিহাসিকভাবেই এই দু’জনেরই অতিপ্রাকৃত বিষয়ে বিশ্বাস এবং অভিজ্ঞতা ছিল। তাই যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পরবর্তীকালে দু’জনেই গোটা আমেরিকা জুড়ে এই পুনরুজ্জীবন তত্ত্বের রীতিমতো প্রচার করে বেড়ান এবং বিস্তর লেখালেখিও করেন।
আরও পড়ুন
প্ল্যানচেটে রবীন্দ্রনাথকে ডাকলেন প্রবোধকুমার, আবৃত্তি করে শোনালেন কবিতাও!
১৯১৬ সালে মৃত ছেলের সঙ্গে যোগাযোগের প্রেক্ষিতে লেখা অলিভার লজের বই 'রেমন্ড অর ডেথ অ্যান্ড লাইফ'-এ এই প্রসঙ্গে বিস্তারিত লেখালেখি করেছিলেন নামজাদা পদার্থবিদ। শুধু তিনিই নন, তাঁর স্ত্রীও এই আত্মা ডেকে আনার বিষয়টিতে সঙ্গ দিতেন তাঁকে। ১৯২০ সালেও এক সাংবাদিকের সঙ্গে কথপোকথনের সময় লজ জানিয়েছিলেন, তখনও তাঁর পুত্রের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হত তাঁর।
আরও পড়ুন
তিন বছর আগেই মৃত মেয়ে, প্রযুক্তির সাহায্যে তাকে ‘ফিরে’ পেলেন মা
এই প্রসঙ্গে স্যার আর্থার কোনান ডয়েল জানিয়েছেন ১৯১৯ সালের অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার কথা, যাকে তিনি বলেছেন তাঁর 'আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার সব থেকে শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত'।
"সে আমার হাতের উপর হাত রাখল। সামনে ঝুঁকে এল। আমি অনুভব করলাম, আমার কপালে, চোখের ঠিক উপরে ঠোঁট রেখে চুম্বন করল সে। আমি কান্না ধরে রাখতে পারিনি। জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি ভালো আছ তো?” খানিকক্ষণের নীরবতা। আমার ভয় লাগল। সে কি চলে গেছে? তারপর দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে মিশে কিছু শব্দ ভেসে এল নীরবতার গহ্বর থেকে। “আমি ভালো আছি। আই অ্যাম সো হ্যাপি!"
আরও পড়ুন
জন্মদিনেই চুরি, মিউজিয়াম থেকে উধাও ভ্যান গঘের আঁকা ছবি
পরবর্তীকালে ১৯২২ সালে একটি বক্তৃতাতেও ডয়েল জানান, তিনি বহুবার তাঁর পুত্রের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং এর মধ্যে কোনও আপত্তিজনক কিছু আছে বলে তিনি একদমই মনে করেন না। উপরন্তু তিনি আরও জানান যে, এরকম আরও অন্তত ২৪টি পরিবারকে তিনি জানেন, যাঁরা তাঁদের মৃত পুত্রের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করে চলেছিলেন।
আরও পড়ুন
স্প্যানিশ ফ্লু প্রাণ কেড়ে নিল প্রথম প্রেমিকার, তিন বছর পরে খবর পেলেন চ্যাপলিন
তবে এর সুযোগ নিয়েই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে ব্যাঙের ছাতার মতো ভণ্ড কিছু সংস্থা। শোকাকুল পরিবারবর্গকে পুনরুজ্জীবন প্রাপ্ত প্রিয়জনের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা লোটার ফাঁদ পেতে বসে তারা। এই পরিস্থিতিতে আবার এগিয়ে আসেন আর এক প্রখ্যাত ব্যক্তি, জাদুকর হ্যারি হুডিনি। স্যার কোনান ডয়েলের অন্যতম প্রিয় বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও এই সময় বিখ্যাত 'এস্কেপ আর্টিস্ট' হুডিনি গোটা আমেরিকা জুড়ে এই পরলোক চর্চার বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে যান। স্যার কোনান ডয়েল এবং অলিভার লজকে 'ধাপ্পাবাজ' বলতেও দ্বিধা করেননি তিনি। পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যে, ১৯২৬ সালে একটি সরকারি কমিটি গঠন করা হয় পুরো বিষয়টির তদন্ত করতে। সেখানে এই পুরো পদ্ধতির মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ টাকা জালিয়াতি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন বিখ্যাত ম্যাজিশিয়ান। যদিও এ-বিষয়ে সরকার বিশেষ কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন বলে জানা যায় না। তবে পরবর্তী কালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর সময় থেকেই পরলোক তত্ত্ব ক্রমশ ফিকে হতে শুরু করে এবং তারপরে জনমানসের মধ্যে এর বিশেষ কোনও প্রভাব আর দেখা যায়নি।
Powered by Froala Editor