প্ল্যানচেটে রবীন্দ্রনাথকে ডাকলেন প্রবোধকুমার, আবৃত্তি করে শোনালেন কবিতাও!

বিকেল হয়েছে সবে। শহর কলকাতার এখন ঘরে ফেরার পালা। কাজ শেষ করে কেউ স্টেশনে বসে আছেন পরবর্তী ট্রেনের জন্য, কেউ বা বাসে বাদুড়ঝোলা ঝুলতে ঝুলতে চলেছেন প্রিয় মানুষটির কাছে। মাঠে, গঙ্গার ঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিছু উদ্ভ্রান্ত চেহারার মানুষ। সবই চলছে, যেমন চলে রোজ। শিয়ালদহ স্টেশনের দিকে রেল লাইনের পাশ ধরে হাঁটছেন এক যুবক। এটাও তাঁর প্রতিদিনের অভ্যাস হয়ে উঠেছে। যুবকটির মধ্যে তখন বাসা বেঁধেছে লেখার নেশা। কিন্তু বাড়িতে সেই উপায় পাওয়া যায় না। বৌদি নানান কাজে ব্যস্ত রাখে, সঙ্গে বিকেল হলেই আলো নিভিয়ে দেয়। তাই আর উপায় না পেয়ে পথেই বেরিয়ে পড়েছেন তিনি। পথ তো নয়, রেললাইন। একটা ছোট্ট জায়গা খুঁজে সেখানেই বসে যান তিনি। পাশ থেকে ট্রেন চলে যাচ্ছে। কত যাত্রী, কত মানুষ; কত চরিত্র সেখানে। সবারই নিজের নিজের দুঃখ-সুখ রয়েছে। সেসব এক মনে দেখে চলেছেন তিনি, প্রবোধকুমার সান্যাল। দেখছেন, আর লিখে রাখছেন সঙ্গে নেওয়া খাতায়।

ছোটো থেকেই প্রবোধকুমারের মধ্যে গড়ে উঠেছিল একটা যাত্রী। সে ছোটবেলায় ভাগলপুরে পিসিমার বাড়ি যাওয়াই হোক, বা পরে হরিদ্বার, হিমালয়-সহ গোটা দেশ। সেই সঙ্গে জুড়েছিল শব্দ। এটারও শুরু হয়েছিল ছোটবেলায়। একসঙ্গে অনেককিছু নিয়ে বেড়ে উঠছিলেন তিনি। পরিবার, পরিজন, ভ্রমণ— এই সবকিছুর সঙ্গে ছিল দারিদ্র্য। কিন্তু তাতে থেমে যায়নি জীবন। এগিয়ে গেছে নিজের মতো, নিজের গতিতে। কবিতা, গদ্য, প্রবন্ধ সবকিছুই চলছিল। তবে গল্পই যে হয়ে উঠবে তাঁর রাস্তা, সেটা ঠিক হল ১৯২২ সালে। তখন সিটি কলেজের ছাত্র প্রবোধকুমার। কাশীতে গেছেন প্রবাসী বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে। সেখানেই প্রথমবার কাছ থেকে দেখলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। ব্যস, লেখার ইচ্ছা মগডালে চড়ে বসল। গল্প না লিখলে জীবন তো একেবারে বৃথা! চারিদিকের মানুষগুলোর দুঃখ, সুখ, হতাশার গল্প লিখবেন তিনি। ১৯২৮ সালে প্রকাশ পায় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘যাযাবর’। আক্ষরিক অর্থে, এটাই ছিলেন প্রবোধকুমার সান্যাল।

অবশ্য এই একটা দিক দেখলেই হবে না। জীবনে নানা অভিজ্ঞতার মুখে পড়েছিলেন প্রবোধকুমার। তখন বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাস জেলে। চাঁদপুরে ইন্সপেক্টরকে হত্যা করার অপরাধে তাঁকে ফাঁসির সাজা দেওয়া হয়। এই ঘটনায় ক্ষোভে ফেটে পড়েন প্রবোধকুমার সান্যাল। এই ফাঁসির আদেশের প্রতিবাদ করে ‘স্বদেশ’ পত্রিকায় সম্পাদকীয় লিখলেন। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশদের রোষানলে পড়লেন তিনি। গ্রেপ্তার করা হল তাঁকে। অবশ্য স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হিল নিবিড়। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, যতীন দাসের মৃতদেহ বয়ে নিয়েও গিয়েছেন কাঁধে। প্রাণ চঞ্চল প্রবোধকুমার কোনো কিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারেননি। যাত্রীর চরিত্র যেমন হয়…

এই সবকিছুর সঙ্গে এগোতে থাকে তাঁর লেখাও। নানাভাবে রোজগারের চেষ্টা করছেন তিনি; কখনও মাছের ব্যবসা করে, কখনও ট্রেনে-বাসে-ট্রামে বিক্রি করছেন ‘বিচিত্রা’ পত্রিকা। হঠাৎ এক বন্ধুকে নিয়ে চলে যান ভারতের উত্তর পশ্চিম সীমান্তে। সেনাবাহিনীর চাকরি করতে শুরু করেন। একসময় সেই সবকিছু ছেড়ে চলে আসেন স্রেফ লিখবেন বলে। কড়া ধমক দেন বন্ধুস্থানীয় সাহিত্যিকরা। এভাবে সংসার চলবে? পেট ভরবে? তখন বুঝলেও, বিয়ের পরপর আবারও চাকরি ছাড়ার পথে পা বাড়ান তিনি। এমনকি, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কেও সেই পরামর্শই দিয়েছিলেন তিনি।

ততদিনে অবশ্য তিনি প্রথিতযশা সাহিত্যিক। তাঁর আগেই তিনি নজরে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথের। তিনিও রীতিমতো চমকে যান প্রবোধকুমারের লেখা পড়ে। একটানা লিখে যাচ্ছেন তখন; সমস্ত পত্রিকায় লেখা ছাপা হচ্ছে তাঁর। সব জায়গাতেই ধরা পড়ছে যাযাবর মনটা। এভাবেই লিখে ফেলেছেন ‘মহাপ্রস্থানের পথে’। কেদারবদ্রী যাত্রা করার সময় ৬০০ কিমি’র কিছু বেশি পথ পায়ে হেঁটে পরিক্রমা করেন। মোট ৩৮ দিনের এই যাত্রাই হল ‘মহাপ্রস্থানের পথে’। যে বই আকৃষ্ট করেছিল স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেও। বিশ্বকবির সঙ্গে প্রবোধকুমারের এমন সখ্য ছিল যে, মারা যাওয়ার পর তাঁকে প্ল্যানচেটেও ডাকেন তিনি। সেখানে নাকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আত্মা’ কবিতা শুনতে চেয়েছিলেন। প্রবোধকুমার সান্যাল নিরাশ করেননি, শুনিয়েছিলেন ‘কঙ্কাল’ কবিতাটি!

লিখতে লিখতে কোনোদিকে খেয়াল থাকত না তাঁর। একদিন মাটিতে বসে লিখছেন, হঠাৎ হাজির হল একটা তেঁতুলবিছে। প্রবোধকুমার সান্যালকে সামনে পেয়ে এক কামড় দিয়েছে বিছেটি। কিন্তু কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই তাঁর! যেন কিছুই হয়নি, এইভাবে লিখেই যেতে লাগলেন। যন্ত্রণায় মুখটি এতটুকুও বিকৃত হল না। শুধু তাই নয়, যখন লিখতেন তখন কারোর সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলতেন না; খেতেনও না। তবে ভেতরে ভেতরে তখনও যাত্রা চলত তাঁর। সারাজীবন চষে বেরিয়েছেন দেশের প্রতিটা কোণে। বিদেশেও গেছেন অনেকবার। সম্মান পেয়েছেন প্রচুর। এরকম যাত্রীর শেষটাও তো পথেই হয়! দণ্ডকারণ্যে ঘুরতে গিয়ে গুরুতর আহত হয়ে ফিরে আসেন। তারপর, শয্যা ছেড়ে আর উঠলেন না। দীর্ঘ অসুস্থতার পর ৭৪ বছর বয়সে মারা যান তিনি। কিন্তু যাত্রা কি আজও থেমেছে? প্রবোধকুমার সান্যাল এখনও হয়ত মহাপ্রস্থানের পথেই ঘুরছেন। চিনে নেওয়ার চেষ্টা করছেন আশেপাশের মানুষগুলোকে।

ঋণ-
১) আনন্দবাজার পত্রিকা, ‘চিরপরিব্রাজক, চিরতীর্থপথিক, সাহিত্যিক’
২) অবসর, ‘পথ-পূর্বাভাস-উপেক্ষা-মহাপ্রস্থান’
৩) অবসর, হিমালয়ের ভ্রমণকথার প্রবাদপুরুষ: প্রবোধকুমার সান্যাল

More From Author See More