করোনার জন্য সমস্ত পৃথিবী একরকম স্তব্ধ হয়ে আছে। লকডাউন চলছে ভারতে। সমস্ত মানুষকে বাড়ির ভেতর থাকতে বলা হচ্ছে। সেই সঙ্গে বলা হচ্ছে আরও দুটো জিনিস। এক, এই পরিস্থিতিতে যাঁদের সবচেয়ে বেশি দরকার, সেই ডাক্তার, পুলিশ, সংবাদমাধ্যমকে যেন সবসময় আমরা সহযোগিতা করি। আর দুই, কোনোরকম গুজবে যেন কান না দেওয়া হয়। কিন্তু আমরা কি সত্যিই সেটা মেনে চলছি? বিভিন্ন ঘটনা সেই প্রশ্নচিহ্নটাই তুলে আনছে। সম্প্রতি পিয়ারলেস হাসপাতালের একজন সিনিয়র চিকিৎসককেও প্রবল হেনস্থা করা হয়েছে। যা আরও একবার আমাদের মানসিকতাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাল।
আরও পড়ুন
সেরে উঠেছেন লক্ষাধিক মানুষ, করোনা-আক্রমণের বিপরীতে আশার আলো
ঘটনাটি ঘটেছে কলকাতার পঞ্চসায়রের ‘উপহার’ আবাসনে। সেখানেই থাকেন পিয়ারলেস হাসপাতালের সিনিয়র গায়নোকলজিস্ট ডাঃ রূপশ্রী দাশগুপ্ত। কাজের সূত্রে প্রায় প্রতিদিনই তাঁর এমারজেন্সি থাকে; এই কদিন সেই ব্যস্ততা আরও বেড়ে গেছে। হাসপাতালের বাকি ব্যবস্থা বন্ধ করলেও, এমারজেন্সি তো বন্ধ করা যাবে না। তাহলে রোগীরা কোথায় যাবে?
আরও পড়ুন
হাসপাতালে স্থানাভাব, মেঝেতে শুয়ে করোনা-আক্রান্তরা – ভয়াবহ দৃশ্য স্পেনে
ডাঃ দাশগুপ্ত প্রহরকে জানালেন - “সকালে আমার ওয়ার্ডে তিনজন রোগী ছিল। প্রত্যেকের অবস্থাই গুরুতর। কিন্তু তাঁরা কেউ করোনা আক্রান্ত নন। সেইজন্যই সকাল সকাল বেরোনোর কথা ছিল আমার। ড্রাইভারও এসে গিয়েছিল সময়মতো। কিন্তু আবাসনের গেটে তাঁকে আটকে দেওয়া হয়। হাজার অনুরোধেও ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয় না। বরং রীতিমতো অপমান করা হয়। পরে যখন আমি ঘটনাস্থলে যাই, তখন আমার সঙ্গেও একই ব্যবহার করা হয়।” আবাসনের অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে তাঁর গাড়ি ছাড়া হয় না। কারণ? তিনি পিয়ারলেস হাসপাতালের ডাক্তার! সেখানে করোনা রোগী ভর্তি হয়েছে, অতএব সেখানকার ডাক্তাররাও সেই রোগ ‘ছড়াচ্ছে’! এমনই বক্তব্য শুনতে হয়েছে বলে দাবি করেন ডাঃ রূপশ্রী দাশগুপ্ত। এমনকি, তাঁর ড্রাইভারকে ধাক্কাও মারা হয় বলে প্রহরকে জানান তিনি।
আরও পড়ুন
করোনা রুখতে কাজে ফিরলেন কয়েক হাজার অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তার ও নার্স
অথচ একইসঙ্গে আরও একটি গাড়ি সেই সময় উপস্থিত ছিল। সেটির গন্তব্য ছিল অন্য হাসপাতাল। তাকে না আটকিয়ে, ছেড়ে দেওয়া হয়! পরে লালবাজারে ফোন করার পর পুলিশের সহায়তায় এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পান তিনি। কিন্তু তাঁর আগে দীর্ঘ অনেকটা সময় তাঁকে চরম হেনস্থার মধ্যে পড়তে হয়। ডাঃ রূপশ্রী দাশগুপ্ত বলছিলেন, “এরকম পরিস্থিতির মধ্যে একজন ডাক্তারকে কেন পড়তে হবে? যেখানে প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী সবাই বলছেন ডাক্তারদের সঙ্গে সহযোগিতা করার। আমরা তো মানুষের জন্যই কাজ করছি। ঘরে তো বসেই থাকতে পারতাম; কিন্তু সেটা করলে মানুষগুলোর চিকিৎসা হত? শুধু তো করোনা আক্রান্তরা নন, রোজ বহু এমারজেন্সি কেস আসে আমাদের কাছে। আমরা না থাকলে তাঁদের বাঁচাবে কে? সেখানে আমাকে এমন পরিস্থিতির সামনে পড়তে হল। অথচ দুধওলা, কাজের মাসি থেকে শুরু করে অনেকেই সেই সময় যাতায়াত করেছে। তাঁদের তো কিছু বলা হল না?” এই পরিস্থিতিতে কাজ করছেন বলে ডাক্তাররাও ‘করোনা ছড়াচ্ছেন’, এমন দাবিও নাকি করা হয়েছে।
আরও পড়ুন
করোনার টেস্ট কিট তৈরি করল ভারত নিজেই, মাত্র ৬ সপ্তাহের প্রচেষ্টায় সাফল্য
পঞ্চসায়রের এই ঘটনা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হতে পারত। কিন্তু এমন অনেক অভিযোগ কিন্তু সামনে আসতে শুরু করেছে। প্রশাসন, পুলিশ যতই চেষ্টা করুক, আমরা সচেতন না হলে কিচ্ছু হবে না। এটা কি সচেতনতার নমুনা? আজ ডাঃ দাশগুপ্তকে যে হেনস্থা সহ্য করতে হল, সেটা কি তাঁর কাম্য ছিল? তিনি তো দায়িত্ব পালন করতেই যাচ্ছিলেন। আজ রূপশ্রীদেবীর মতো বাকি ডাক্তাররাও হাত তুলে নিলে কোথায় যাব আমরা, ভেবে দেখেছেন? সচেতন হন, গুজবে পা দেবেন না। সবার সঙ্গে সহযোগিতা করে চলুন। এমন সময়, একে অপরের পাশে এসে দাঁড়ানোটাই প্রধান কাজ।