হাজার বছর ধরে পৃথিবীর পথে হেঁটেছিলেন তিনি। বারবার ভালোবেসে ফিরে এসেছিলেন বাংলার নদী-নালা-ক্ষেতে। তিনি, জীবনানন্দ দাশ। সারাজীবন নিজের ভেতরে বয়ে বেরিয়েছেন নিজের জন্মভূমিকে। বরিশালকে। তাঁরই নামাঙ্কিত পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতেই চোখে পড়ে একটা লাল রঙের বাড়ির। একটা চার্চ। সামনের দিকটা গোলাকার ডোমের মতন। তাতে ধূসর ছাপ। ধূসর পাণ্ডুলিপি কি?
আরও পড়ুন
ট্রামের ঘণ্টাও শুনতে পাননি জীবনানন্দ, মৃত্যুর আগে কমলালেবু খেতে চেয়েছিলেন একটা
পোশাকি নাম অক্সফোর্ড মিশন চার্চ। স্থানীয় ভাষায় ‘লাল গির্জা’। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ গির্জা এটি। শুধু বাংলাদেশই নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম গির্জা হল এটি। চারিদিকে সবুজের সমারোহ। কোথাও তাড়াহুড়োর চিহ্ন নেই। যেন যত্ন নিয়ে সবটা সাজানো হয়েছে। গাছগুলো নিখুঁতভাবে ছাঁটা। তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে গির্জার লাল রঙের মূল স্থাপত্যটি। এছাড়াও রয়েছে বেশ কিছু পুকুর। তার স্বচ্ছ জলে সূর্যের আলো এসে পড়েছে। আলো পড়েছে শতাব্দীপ্রাচীন এই মঞ্চের গায়ে।
উনবিংশ শতকের শেষের দিক। আস্তে আস্তে খ্রিস্টান মিশনারিরা আসতে শুরু করেছে বরিশালে। তৈরি হচ্ছে গির্জা, ছড়িয়ে পড়ছে খ্রিস্ট ধর্ম। অক্সফোর্ড মিশন বলে একটি মিশনারি সংস্থার উদ্যোগে বরিশালে তৈরি হল এপিফ্যানি চার্চ। পরবর্তীকালে যেটা পরিচিতি পায় অক্সফোর্ড মিশন চার্চ হিসেবে। ১৯০৭ সালে সম্পূর্ণ কাজ শেষ হয় এই গির্জার। অনেক যত্ন নিয়ে নকশা করেছিলেন ফাদার স্ট্রং এবং সিস্টার এডিথ। প্রাঙ্গণ ছেড়ে গির্জার ভেতরে ঢুকলেই বোঝা যাবে সেই যত্ন।
মোট ৪০টি খিলানের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে এই বিশাল গির্জা। মূল প্রার্থনাকক্ষটির উচ্চতা প্রায় ৫০ ফুট! লাল ইট দিয়ে পুরো স্থাপত্যটি তৈরি হলেও, ভেতরের ছাদটি কাঠের তৈরি। মার্বেলের প্রশস্ত মেঝের ওই পাড়ে রয়েছে বড় একটি ক্রশ। বেথেলহেম থেকে নাকি এটি আনা হয়েছিল। বলা হয়, এই গির্জাটি এমনভাবে তৈরি, যাতে কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে স্থাপত্যটি রক্ষা পায়। বাস্তবিকই তাই। রয়েছে চার্চের বিখ্যাত ঘণ্টাও। দিনে সাত বার বাজে এটি। নিয়মিত। জাদুছন্দে প্রার্থনা শুরু হয়। জানান দেয় ঈশ্বরের ধ্বনি। বলা হয়, বরিশালের অক্সফোর্ড চার্চের এই ঘণ্টাটি নাকি এশিয়ার সবথেকে বড় ঘণ্টা।
ছাত্রাবস্থায় নাকি এই গির্জার হোস্টেলেই থাকতেন জীবনানন্দ দাশ। শোনা যায়, গির্জার এক সেবিকার কন্যা মুনিয়া ছিলেন জীবনানন্দের প্রথম প্রেমিকা। জীবনানন্দের একাধিক কবিতায় উল্লিখিত রয়েছে ‘মনিয়া’ বা ‘মুনিয়া’ শব্দটি। সত্যিই কি এই নামে জীবনানন্দের প্রেমিকা ছিলেন কেউ? না নিছক এক মিথ? প্রসঙ্গত, এই গির্জাটি জীবনানন্দের বাড়ি থেকে সামান্য দূরেই অবস্থিত।
চারিদিকে ভরা বাগান। পাম গাছের সারি। মনে পড়ে, এমনই রূপসী বাংলাতেই বারবার ফিরতে চেয়েছেন জীবনানন্দ। আর এই সব স্মৃতি নিয়ে ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে নিজের সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ‘লাল গির্জা’। বজায় রেখেছে নিজের গাম্ভীর্য।
(ঋণ - প্রথম আলো, রোর বাংলা)