ট্রামের ঘণ্টাও শুনতে পাননি জীবনানন্দ, মৃত্যুর আগে কমলালেবু খেতে চেয়েছিলেন একটা

১৭ অক্টোবর, ১৯৫৪,  শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে ২নং ওয়ার্ডে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকছেন কবি ও সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্য। পরিচিত কয়েকজনের ভিড় পার হয়ে তিনি গিয়ে বসলেন মুমূর্ষু একজন রোগীর সামনে। রোগীর কোমর থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত ব্যান্ডেজ বাঁধা। মুখ বিকৃত, স্ফীত। রোগীর কাঁপা কাঁপা হাতটা ধরে গিয়ে বসলেন পাশে। একটু আগেই মেডিকেল কলেজের ছাত্র ভূমেন গুহ রোগীকে দেখে গেছেন। সজনীকান্ত দাশের বিশেষ অনুরোধে পরেরদিন রোগীকে দেখতে আসবেন ডঃ বিধানচন্দ্র রায়। হঠাৎ সঞ্জয় ভট্টাচার্যের হাত ধরে রোগী বললেন, 'এখানে ভালো লাগছে না। একটা কমলালেবু খেতে পারব?'

সঞ্জয় ভট্টাচার্য চমকে গেলেন। কমলালেবু! গান্ধিজির সঙ্গে শেষ দেখার সময়ও তিনি একটা কমলালেবু দিয়েছিলেন কিন্তু সেই গল্প তো কখনও এই রোগীর কাছে করেননি! তাহলে কমলালেবুর কথা তিনি কীভাবে জানলেন? যে গল্পটির আক্ষেপ ২২ অক্টোবর থেমে গেল সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কাছে। তিনি পাগলের মতো একা, গণেশ অ্যাভিনিউর ফ্ল্যাটে, রাত দশটায়, মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে বসে অশ্রুস্নাত চোখে লিখতে লাগলেন একটি অমর কবিতা, 'একটা জাহাজ ছেড়ে গেল...'। সেদিন সঞ্জয় ভট্টাচার্যের মনে হয়েছিল, মর্ত্যের বন্দর ছেড়ে একটি অমর জাহাজ শান্তি-পারাবারে চলে গেল।

সারাজীবন লেখা-লেখা করেই পাগল হয়ে ছিলে, প্রাণ দিলে শুধু লেখাতেই।

কিন্তু কোন সেই জাহাজ, যে অকালহেমন্তে পারি দিল দূর তমসায়? সেই শম্ভুনাথ পণ্ডিত  হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা মুমূর্ষু রোগীটি।  যিনি অব্যক্ত যন্ত্রণা ছটফট করছিলেন ১৪ অক্টোবর থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত। যাঁর ঘরের এককোণে কালো আলকাতরার মতো ভয়ংকর দেখতে এক কুখ্যাত খুনির অস্ত্রোপচার হয়েছিল, যাঁকে পাহারা দিচ্ছিল তিনজন সশস্ত্র পুলিশ। যে সারারাত চিৎকার করত অসহ্য যন্ত্রণায়। এমন ঘরে একজন সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে যেতে পারে যে-কোনো সময়। অথচ ১৪ অক্টোবর, দিব্যি সুস্থ তিনি বেরাতে যাওয়ার জন্য গিয়েছিলেন সুবোধ রায়ের বাড়ি। সুবোধ রায় ইনফ্লুয়েঞ্জার জেরে কাহিল থাকার জন্য একা বের হয়েছিলেন হাঁটতে। এই হেমন্ত ঋতুতে তিনি ল্যান্সডাউন রোড ধরে একা একা হেঁটে বেড়াতেন। সুবোধ রায়ও বের হচ্ছিলেন একটু দেরি করেই, হঠাৎ তাঁর কাছে ছুটে এলেন একটু আগেই বেড়াতে বের হওয়া মানুষটির ছেলে রঞ্জু। এসে বললে, জানেন সর্বনাশ হয়েছে। বাবাকে এইমাত্র হাসপাতাল নিয়ে গেল। উৎকণ্ঠায় কালো রঞ্জুর মুখ।

আরও পড়ুন
বইটি 'বান্ধবীকেন্দ্রিক', বারবার নাম বদলেছেন বিনয় মজুমদার

রঞ্জুর কাছেই তিনি জানলেন রঞ্জুর বাবা হেঁটে ফেরার পথে রাসবিহারী অ্যাভিনিউ-র কাছে 'জলখাবার', 'জুয়েল হাউসে'র সামনে রাস্তা অন্যমনস্কভাবে পার হচ্ছিলেন। শুধু অন্যমনস্ক নয়, গভীর চিন্তাতে আচ্ছন্ন হয়ে রাস্তা পার হচ্ছিলেন। চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে রাস্তার মাঝের ট্রাম লাইন পার হলেন। এদিকে চলন্ত ডাউন বালিগঞ্জ ট্রাম স্পটিং স্টেশন থেকে বের হয়ে তখনও তাঁর অবস্থান থেকে ছিল পঁচিশ ত্রিশ হাত দূরে। অবিরাম ঘণ্টা বাজানো ছাড়াও সতর্কবাণী ঘোষণা করে বারবার ড্রাইভার সাবধান করে দিচ্ছেন। অবশ্যম্ভাবীভাবে ট্রাম এসে পড়ল মানুষটির সামনে। ব্রেক কষে গাড়ি থামালেন ড্রাইভার। কিন্তু ততক্ষণে তাঁর দেহ আটকে গেছে ক্যাচারের ভেতরে। ক্যাচারের কঠিন আঘাতে রক্তাপ্লুত, অচৈতন্য তাঁর শরীর। বুকে, হাতে, ডান চোখের কোণে তীব্র আঘাত পেয়েছেন তিনি। কেটে, ছিঁড়ে, থেঁতলে গ্যাছে এখানে ওখানে। বুকের পাজরার অনেকগুলো হাড় চুরমার হয়েছে। গুঁড়িয়ে গ্যাছে উরুর হাড়। তাকে টেনে-হিঁচড়ে বের করলেন সবাই। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতানুসারে, ঘাতক ডাউন বালিগঞ্জ ট্রামের ক্যাচারও দুমড়ে গেছে, তুবড়ে গেছে ট্রামের সামনের কিছুটা অংশ, অথচ একজন অসহায় মানুষকে আঘাত করে...।

ধরাধরি করে সবাই তাঁকে নিয়ে এলেন রাস্তার ওপারে। রাস্তার পথচারী ও দোকানদারই মুখে-হাতে জল দিলেন, কেউ বাতাস করলেন। কেউ দোকান থেকে বরফ এনে তাঁর আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে বুলিয়ে দিলেন। ধীরেধীরে তাঁর সংজ্ঞা ফিরল, প্রশ্ন করলেন সামনে থাকা জটলাকে, 'কী হয়েছে? আমি এখানে কেন?' একজন উত্তর দিল, 'হাঁটতে হাঁটতে মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন।' বয়স্ক মতো এক ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন কবিকে, 'আপনার নাম কী? ঠিকানা কী?' মানুষটি লঘুস্বরে উত্তর দিলেন এবার – 'জীবনানন্দ দাশ। ১৮৩, ল্যান্সডাউন রোড।' তারপর বাড়ি যাওয়ার জন্য উঠতে গিয়ে আবার আছাড় খেলেন। পায়ের হাড় গুঁড়িয়ে গেছে সব। সবাই ধরাধরি করে একটা ট্যাক্সিতে তুললেন। ওই ট্রামের যাত্রী বিমলেন্দু শীল, জলখাবার দোকানের মালিকের ভাই চুনীলাল দে, একজন পুলিশ সহ আরও দু একজন গেলেন সেই ট্যাক্সিতে। সেদিন ল্যান্সডাউন রোডের বাড়িতে জলখাবার দোকানের চুনীলালই দুর্ঘটনার খবরটি পৌঁছে দিয়েছিলেন। ট্যাক্সি চলল শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালের দিকে। ২নং ওয়ার্ড।

আচ্ছা, এত যে লিখেছি... একটিও কি সুপ্রিম পোয়েট্রি হয়নি? যা আমার মৃত্যুর পর বেঁচে থাকতে পারে?

২২ অক্টোবর, শুক্রবার, সকাল থেকেই কথা বন্ধ হয়ে গেল তাঁর। কিছুই খাওয়ানো গেল না। ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে আনা রক্ত বৃথায় পড়ে রইল। আলোর স্বচ্ছ হয়ে আসছে সব। পত্নী লাবণ্য দাশ আর সামলাতে পারলেন না নিজেকে। জীবনের এত সংগ্রাম এক মুহূর্তে এসে থমকে দাঁড়াল। তখন এগোরোটা পঁয়ত্রিশ, তিনি মানবজগতের সব আশা-ভরসাকে ব্যর্থ করে পাড়ি দিলেন রূপাতীত অন্ধকারে নাকি আলোর দেশে? রোদের গন্ধ মুছে ফেলে এই পৃথিবীর সমস্ত বন্ধনকে ছিন্ন করলেন মুহূর্তেই। শনিবার সকাল থেকেই ত্রিকোণ পার্কের বাড়িতে আসতে শুরু করলেন কবি, সাহিত্যিক, আত্মীয়, বন্ধু সহ অসংখ্য কবির অনুরাগী, ভক্তের দল। অনুচ্চ কণ্ঠে অচিন্ত্যকুমার, বুদ্ধদেব, প্রেমেন্দ্র মিত্র, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সঞ্জয় ভট্টাচার্য সহ বাংলার সাহিত্যের দিকপালরা। দোতলা থেকে একতলাতে নামানো হল তাঁর মৃতদেহ। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে আত্মীয়, বন্ধু সবাই। শবদেহ তুলতে যাবে শোকবিহ্বল পরিজনেরা, এমন সময় ডুকরে কেঁদে উঠলেন তাঁর পত্নী লাবণ্য দাশ, স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে একদৃষ্টিতে বললেন, 'সারাজীবন লেখা-লেখা করেই পাগল হয়ে ছিলে, প্রাণ দিলে শুধু লেখাতেই। আর আজ, তুমি চলে গেলে। তোমার লেখাই শুধু পড়ে রইল।'

লেখাগুলোই যে তাঁর সম্বল ছিল। তাই একদিন সান্ধ্য আড্ডাতে, চুপিচুপি, সুবোধ রায়কে বলেছিলেন, 'আচ্ছা, এত যে লিখেছি... একটিও কি সুপ্রিম পোয়েট্রি হয়নি? যা আমার মৃত্যুর পর বেঁচে থাকতে পারে?' এ-কথা শুনে সুবোধ রায় স্তব্ধ হয়ে গেলেও, এর উত্তর বেশ দ্বিধাহীনভাবে স্পষ্ট কণ্ঠে দিয়েছিলে কবি বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশের শ্রদ্ধাবাসরে, 'রবীন্দ্রনাথের পর বাংলাদেশে জীবনানন্দ দাশের মতো এতো বড়ো প্রতিভাবান, প্রতিপত্তিশালী কবির আর মৃত্যু ঘটেনি।'

More From Author See More