‘মৃত’ নেতাজির যে ছবিগুলি দেখে চমকে উঠেছিল বাঙালি

তৃতীয় পর্ব

১৮ আগস্ট ১৯৪৫-এর বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যুর খবর বিশ্বাস করেননি অনেকেই। সাধারণ ভারতবাসী থেকে শুরু করে ব্রিটিশ-মার্কিন গোয়েন্দারা বরাবরই সন্দেহ পোষণ করে এসেছেন তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে। তাঁদের ধারণা, বিমান দুর্ঘটনার নাটক সাজিয়ে সবার চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়েছেন সুভাষ। কিন্তু কোথায় গেলেন তিনি? মুখার্জি কমিশনের রিপোর্ট বলছে, রাশিয়ায় চলে গিয়েছিলেন নেতাজি। অন্যান্য অনেক সূত্র থেকেও সেই সাক্ষ্যই পাওয়া যায়। কিন্তু এই সময়ের মধ্যেই, অনেকে দাবি করেন যে নেতাজিকে তাঁরা দেখেছেন। বিভিন্ন প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানও প্রকাশিত হয় একাধিক সংবাদপত্রে। তবে সেই দাবির স্বপক্ষে জোরালো কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি কোনোদিনই।

প্রথম পর্ব
পাঁচ দিন পরে প্রকাশ্যে এসেছিল নেতাজির মৃত্যুসংবাদ - কেন?

সেই সময়ে, বেশ কিছু ফটোগ্রাফও হাতে আসে গবেষকদের, যে ফটোগ্রাফগুলিতে এক ব্যক্তির চেহারা অনেকটাই নেতাজির মতো। কাউকে কাউকে পরবর্তীকালে অন্য ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা গেছে, কয়েকজনকে নিয়ে ধোঁয়াশা আর কাটেনি। তবে কোনো ছবি দেখিয়েই জোরের সঙ্গে বলা যায় না যে, ইনিই সুভাষ। বড়জোর সন্দেহ করা যায়, আর পারিপার্শ্বিকতা বিচার করে সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করা যায়। নিশ্চিত হওয়ার জো নেই। তেমনই কয়েকটি ছবি দেখে নেওয়া যাক আজ...

দ্বিতীয় পর্ব
বিমান দুর্ঘটনায় মৃত নেতাজি, বিশ্বাস করেনি ব্রিটিশ-মার্কিন সংবাদমাধ্যমও

(১)
১৯৬৫ সালে, ‘জাগৃহি’ পত্রিকা থেকে প্রকাশিত হয় একটি বই, নাম ‘রহস্য নয় ষড়যন্ত্র’। এর আগে নেতাজির অন্তর্ধান নিয়ে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন লেখা বেরিয়েছিল পত্রিকাটিতে। সেই লেখাগুলি সংকলিত করেই সম্পাদিত হয় ‘রহস্য নয় ষড়যন্ত্র’ নামের একটি বই।

সেই বইয়ে লেখা, ‘এখানে ডঃ সিংহ, আনন্দবাজার পত্রিকা, হিন্দুস্থান ষ্ট্যান্‌ডার্ড পত্রিকা এবং ভারতবর্ষ তথা সমগ্র বিশ্বের নেতাজী বিরোধীদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরছি – ১৯৪৮ সালের পরে ভারতমাতার বক্ষে ছদ্মবেশী নেতাজীর ছবি। ১৯৪৮-এর পরে ভারতের বিভিন্ন স্থানে নেতাজীর ছদ্মবেশে অবস্থান কালে ১৯৪৮ সালের পরে ফয়জাবাদের সীমুয়ী কারিতে তোলা এই ফটো...’

ওই লেখাতেই বলা হয়েছে, এটি সারদানন্দের ছদ্মবেশে নেতাজির ছবি। সারদানন্দ কে, সে-প্রসঙ্গে পরে আসছি। কিন্তু এই ছবির লোকটিকে দেখে দূর-দূরান্তেও নেতাজি মনে হয় না। চোখ, গাল, ভুরু – সবেরই গঠন আলাদা। অথচ বেমালুম ছাপিয়ে দেওয়া হল সুভাষের ছবি বলে। তবে বইয়ের এই ছবিটি কোনোদিনই সমালোচকদের কাছে গুরুত্ব পায়নি তেমন।

(২)
এটি ১৯৫২ সালে চিনের পিকিং-এ তোলা ছবি। ছবিটিতে বাঁ-দিক থেকে ষষ্ঠ ব্যক্তিটির মুখের আদলের সঙ্গে নেতাজির মুখের মিল পাওয়া যায়। ছবির অন্যান্যদের মুখের মধ্যে চৈনিক ছাপ থাকলেও, বলা বাহুল্য, উল্লিখিত ব্যক্তিটির মুখের গড়ন অনেকটাই আলাদা। আকর্ষণীয় ব্যাপার হল, অনেক খুঁজেও ওই ব্যক্তির প্রকৃত পরিচয় জানতে পারেননি গবেষকরা।


(৩)
এই ছবিটি দেখলে চমকে উঠতে হয়। ছবির ব্যক্তির মুখের সঙ্গে নেতাজির মিল অনেকটাই। এই ছবিটিও পিকিং-এ তোলা। মঙ্গোলিয়ান ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দের ছবি এটি। এই ছবিতেও, মাঝের ব্যক্তিটির পরিচয় জানা যায়নি খোঁজ করেও। ফলে সন্দেহ বাড়তে থাকে, নেতাজি কি তাহলে পিকিং-এ ছিলেন তখন?


(৪)
এটি ১৯৫৬ সালে তোলা ছবি। বর্মা সীমান্তে যখন সফর করছিলেন কয়েকজন চিনা প্রতিনিধি, তখন এই ছবিটি তোলা হয়। একেবারে বাঁদিকে রয়েছেন যে-ব্যক্তি, তাঁকে নিয়েই প্রশ্ন তোলেন গবেষকরা। পরিচয় জানা যায়নি এঁরও।

আশ্চর্যের ব্যাপার হল, পরপর যে তিনটি ছবি দেখালাম, তিনটির সঙ্গেই কোনো-না-কোনোভাবে জড়িয়ে আছে চিনের নাম। ফলে সে-সময় যে মৃদু গুঞ্জন উঠেছিল, রাশিয়া থেকে চিনে এসেছিলেন নেতাজি – তার অন্যতম ভিত্তি সম্ভবত এই ছবিগুলিই।

(৫)
১৯৬২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরগরম হয়ে উঠল একটি খবরে। নেতাজি ফিরে এসেছেন এই বাংলার বুকেই, ‘স্বামী সারদানন্দ’ রূপে। জলপাইগুড়ি অঞ্চলে, ফালাকাটার নিকটবর্তী শৌলমারী আশ্রমে বসবাস করছেন স্বামী সারদানন্দ। আশ্রমটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা অত্যন্ত কঠোর। পাশাপাশি, আশ্রমের বিভিন্ন দায়িত্বে আছেন যেসব ব্যক্তি, তাঁরাও অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত। সারদানন্দ সবাইকে দর্শন দেন না। নিজেকে আশ্রমের একটি কক্ষের আড়ালে রাখেন সবসময়।

পশ্চিমবঙ্গ ও দিল্লির সরকারও কৌতূহলী হয়ে ওঠে এই সন্ন্যাসীকে নিয়ে। কেউ স্পষ্টভাবে স্বীকার না করলেও, গুঞ্জন ছড়াতে থাকে দ্রুত। সে-সময়কার অনেক ব্যক্তির স্থির বিশ্বাস হয়, শৌলমারীর সাধুই আসলে নেতাজি। অসংখ্য বই, পুস্তিকা, প্রচারপত্র প্রকাশিত হয় এর সমর্থনে। অনেক প্রতিকূলতার পর, সারদানন্দের সঙ্গে অবশেষে দেখা করেন নেতাজির এককালের দুই ঘনিষ্ঠ কর্মী – মেজর সত্য গুপ্ত ও উত্তমচাঁদ। সারদানন্দের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর, তাঁদের মনে স্থির বিশ্বাস জন্মায় যে, ইনিই নেতাজি। এঁদের কথায় বিশ্বাসও করে অনেক মানুষ। মেজর সত্য গুপ্ত রীতিমতো প্রচার করতে থাকেন সারদানন্দের ছদ্মবেশে নেতাজির ফিরে আসার কথা।

সারদানন্দ নিজে কিন্তু বারবার অস্বীকার করেছেন এটি। তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য ছিল, তিনি নেতাজি নন। কিন্তু তাঁর কথায় উত্তেজনা প্রশমিত হয়নি। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, যেহেতু কোনো নির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেল না, এই চর্চা থেমে আসে অনেকটাই। তবে তখনও অনেকেরই বিশ্বাস, সারদানন্দই নেতাজি।

১৯৭৩ সালে শৌলমারীর আশ্রম ছেড়ে দেরাদুনে চলে যান সারদানন্দ। সেখানেই মারা যান, ১৯৭৭ সালে। সারদানন্দের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আগে তাঁর কয়েকটি ছবি তোলা হয়। এই-ই প্রথম প্রকাশ্যে আসে সারদানন্দের ছবি। তখন আরেকবার গুঞ্জন ওঠে যে, ১৯৭৭ সালে হরিদ্বারে মারা গেলেন নেতাজি। অবশ্য গবেষকরা শেষ অবধি এই তত্ত্ব উড়িয়েই দিয়েছেন।


(৬)
২৭ মে, ১৯৬৪। মারা গেলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। অন্ত্যেষ্টির আগে, দিল্লিতে যখন তাঁর মরদেহ শায়িত, তাঁর পাশে দেখা গেল মুণ্ডিতমস্তক এক ব্যক্তিকে। কয়েকজন দাবি করলেন, এই ব্যক্তিই নেতাজি। নেহরুকে শেষযাত্রায় দেখতে এসেছিলেন তিনি। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে নেতাজির চেহারা পরিবর্তিত হয়ে এমন রূপ নিয়েছে।

অবশ্য পরবর্তীকালে জানা যায়, ব্যক্তিটি জনৈক কম্বোডিয়ান বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। নাম বীর ধম্মবর। নেহরুকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতেই উপস্থিত হয়েছিলেন তিনি।

(৭)
এটি আরেক অমীমাংসিত রহস্য। এর সমাধা আজও হয়নি। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাক যুদ্ধের পর, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের তাসখন্দে শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করতে যান ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রপিতি আইয়ুব খান। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী নিকোলাই কোসিগিনের উদ্যোগে স্বাক্ষরিত হয় এই চুক্তি।

চুক্তির পর, উপস্থিত সকলকে নিয়ে একটি ছবি তোলা হয়। সেই ছবির এক ব্যক্তিকে দেখতে অনেকটা নেতাজির মতোই। এ-নিয়ে ওঠে বিতর্ক। অবশ্য এই তর্কটিকে অন্যান্যগুলির মতো এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কেননা এটি ছিল একটি আন্তর্জাতিক মিটিং এবং উপস্থিত সকলের পরিচয়ই যে পাওয়া যাবে, তা স্বাভাবিক। অথচ গবেষকরা সোভিয়েত ইউনিয়নে একাধিকবার যোগাযোগ করেও সন্দেহজনক ব্যক্তিটির পরিচয় জানতে পারেননি। সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য ছিল, এই ব্যক্তি তাঁদের অপরিচিত। অথচ তাসখন্দ চুক্তির মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং-এ উপস্থিত ব্যক্তিটি যে নিতান্ত অবহেলার কেউ নন, তা বুঝতে খুব বেশি মেধা লাগে না।

তাসখন্দ চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার দিন রাতে হোটেলে ফিরে ভারতে নিজের পরিবারকে ফোন করেন লালবাহাদুর। ফোনে বলেন, দেশে ফিরেই ভারতবাসীকে একটি সুখবর উপহার দেবেন তিনি। কিন্তু সেই উপহার আর তাঁর দেওয়া হয়নি। সেদিন রাতেই মারা যান ভারতের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী। অনেকের বক্তব্য, বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়েছিল তাঁকে। কেন? সুভাষের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, এবং সুভাষ জীবিত – এই কথা ভারতে প্রচারিত হলে কারোর সমস্যা হতে পারে বলেই কি? এই প্রশ্ন গত পঞ্চাশ বছরে উঠে এসেছে বারবার। সঠিক উত্তর পাওয়া যায়নি। এবং লালবাহাদুরের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ আজও একটি রহস্য।

যাইহোক, দীর্ঘদিন পর, ২০১৫ সালে এক ব্রিটিশ গবেষক তাসখন্দে উপস্থিত ওই নেতাজি-সদৃশ ব্যক্তির ফেস ম্যাপিং করেন। যে রিপোর্ট উঠে আসে, তা চাঞ্চল্যকর। ফেস ম্যাপিং-এর ক্ষেত্রে কম্পিউটারের যে প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়া হয়, তাতে ভুলের সম্ভাবনা অনেকটাই কম। নেতাজির মুখের সঙ্গে ওই ব্যক্তির মুখের তুলনা করে গবেষক যে রিপোর্ট প্রকাশ করেন, তাতে দেখা যায়, নেতাজির সঙ্গে ভদ্রলোকের মুখের আশ্চর্যরকমের মিল। এমনকি ফেস ম্যাপিং-এ ব্যক্তিটির মুখের অধিকাংশ পার্টই নেতাজির সঙ্গে মিলে যায়। ফলে আরেকবার সেই সন্দেহ উঁকি দেয় – তাসখন্দে উপস্থিত ব্যক্তিটিই কি নেতাজি? ভারত-পাক শান্তিচুক্তির ক্ষেত্রে কি তাঁর কোনো ভূমিকা ছিল? তথাকথিত বিমান দুর্ঘটনার পর, নেতাজি পালিয়ে যান রাশিয়ায়। ফলে, সোভিয়েত ইউনিয়নে তাঁর সেই সময় উপস্থিত থাকাটা অস্বাভাবিক নাও হতে পারে।


এতগুলি ছবি ও সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনার পরও, একটি কথা জানিয়ে রাখতেই হয় – আজ অবধি ফৈজাবাদের গুমনামী বাবার কোনো ছবি পাওয়া যায়নি। অথচ এই ২০১৯-এ দাঁড়িয়ে বিভিন্ন অনুমান ও প্রমাণ মিলিয়ে দেখলে চমকে উঠতে হয়। গুমনামী বাবাই কি নেতাজি?

চতুর্থ পর্ব
নেতাজির মতো, গুমনামী বাবার মৃত্যুর সঙ্গেও জড়িয়ে আছে রহস্য

Powered by Froala Editor

Latest News See More