দ্বিতীয় পর্ব
We are under the shelter of one of the great powers of the world. We should not be disappointed. The first round of the battle is a failure. The battle of freedom is not easy. America won her independence after seven years of fighting. Ireland won her freedom after four years fighting. We are sure to be successful within two years.
I will go to India on the crest of a third World War, and sit in judgement upon those who are trying my officers and my men at Red Fort.
১৯৪৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর। তখন বাংলার গভর্নর স্যার আর জি কেসি। গভর্নর হাউসের রেডিও মনিটর ছিলেন মিঃ কর। অন্যান্য দিনের মতোই, কানে হেডফোন দিয়ে বসে আছেন তিনি। হঠাৎ কানে ভেসে এল এক পরিচিত কণ্ঠস্বর – ‘দিস ইস রেডিও মাঞ্চুরিয়া। সুভাষ বোস স্পিকিং...’। আর তারপর, ওপরের কথাগুলি...
প্রথম পর্ব
পাঁচদিন পরে প্রকাশ্যে এসেছিল নেতাজির মৃত্যুসংবাদ - কেন?
মিঃ কর বিভিন্ন সংবাদপত্রে সেই ঘটনা নিয়ে লিখলেন – ‘নিজের কানকে যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না।’ জোরের সঙ্গে জানালেন তিনি, ওই একবারই নয়, কমপক্ষে তিনবার সুভাষের বেতার ভাষণ ধরা পড়েছে কলকাতায়। প্রথমবার ১৯ ডিসেম্বর ১৯৪৫, দ্বিতীয় ১৯ জানুয়ারি ১৯৪৬ ও তৃতীয় ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৬।
কিন্তু এ কী করে সম্ভব! মাসকয়েক আগে, ১৮ আগস্টেই তো সুভাষ মারা গেছেন তাইহোকুতে বিমান দুর্ঘটনায়। সে-খবর প্রচারিতও হয়েছে সব জায়গায়। মৃত ব্যক্তি রেডিও-য় ভাষণ দিচ্ছেন কী করে!
'ইয়ে সব ঝুট হ্যায়, সুভাষ মর নেহি সকতা। দুসরা কিসিকা লাশ জ্বালা দিয়া হোগা’
অবশ্য ব্রিটিশ ও আমেরিকান গোয়েন্দা বিভাগ ততদিনে এই তথ্য জোগাড় করে ফেলেছে যে, ১৯৪৪ থেকেই নেতাজি মাঞ্চুরিয়ায় যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন। এবং সম্ভবত বিমান দুর্ঘটনার কল্পিত নাটক সাজিয়ে মাঞ্চুরিয়াতেই আত্মগোপন করে আছেন তিনি।
তথাকথিত বিমান দুর্ঘটনার পর, ব্রিটিশ সরকার প্রকাশ্যে যতই ঘোষণা করুক যে সুভাষ মৃত, ভেতরে-ভেতরে বিশ্বাস করতে পারেনি তারাও। তাই গোপনে অনুসন্ধান চালিয়েছিল অনেক। বিমান দুর্ঘটনার খবর শুনে, মহাত্মা গান্ধী যখন প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন – 'ইয়ে সব ঝুট হ্যায়, সুভাষ মর নেহি সকতা। দুসরা কিসিকা লাশ জ্বালা দিয়া হোগা’; ভয় পেয়ে গিয়েছিল ইংরেজরা। সন্দেহ হয়েছিল, গান্ধীজিই বুঝি লুকিয়ে রেখেছেন সুভাষকে। তখন নেচার কিওর হোমে অবস্থান করছিলেন গান্ধীজি। ১৯৪৫-এর ২ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ গোয়েন্দাবিভাগের একটি দল গান্ধীজির আবাসস্থলে তল্লাশি চালায় প্রায় আধঘণ্টা ধরে। কিছু না পেয়ে, হতাশ হয়ে ফিরে যায়।
বিমান দুর্ঘটনার কয়েকদিন পরও সুভাষকে সায়গনে দেখা গেছে
এরই কাছাকাছি সময়ে, লন্ডনের সানডে অবজার্ভার পত্রিকার নতুন দিল্লিতে অবস্থিত সংবাদদাতা ফ্রাঙ্ক হ্যারিস নেহরুকে জানান, সুভাষের মৃত্যু-সংক্রান্ত জাপান সরকারের প্রচার ব্রিটিশ ও মার্কিন সামরিক মহল মোটেই বিশ্বাস করছে না। এক মার্কিন সংবাদদাতা নাকি এই প্রমাণও সংগ্রহ করেছেন যে, বিমান দুর্ঘটনার কয়েকদিন পরও সুভাষকে সায়গনে দেখা গেছে।
এদিকে, ১৯৪৬ সালের ২৭ এপ্রিল ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা থেকে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, ‘মিস্টার সুভাষচন্দ্র বোস যে এখনো জীবিত রয়েছেন এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাফেরা করছেন বিশ্বস্তসূত্রে এমন সংবাদ পাওয়া গিয়েছে। চীন, ইন্দোচীন ও মালয়ের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিই তাঁকে দেখেছেন বলে দাবি করেছেন। ইন্দোনেশিয়া থেকে খবর এসেছে, কয়েকদিন আগে তিনি একটি রুশ সাবমেরিনে করে ইন্দোনেশিয়ায় আসেন এবং সেখানকার বিদ্রোহী নেতাদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করেন।’
এরকম বিভিন্ন সূত্র থেকে খবর আসতে লাগল সুভাষের। স্বাধীনতার আগেও, পরেও। বেশ কিছু উড়ো খবরের পাশাপাশি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকেও খবর পাওয়া গেল কিছু। কয়েকজন পদস্থ আন্তর্জাতিক ব্যক্তি উড়িয়ে দিলেন সুভাষের মৃত্যুর কথা। সে-দলে ছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতা লীগের সিংহল বিভাগের সম্পাদক মিঃ পিল্লাই, শ্যাম সেনাবাহিনীর সহ-প্রধান সেনাপতি মিঃ আকাদি যোনানবা প্রমুখ।
২৪ আগস্ট, ১৯৪৫। এর আগের দিনই প্রকাশ্যে এসেছে সুভাষের মৃত্যুসংবাদ। বড়লাট লর্ড ওয়াভেল তাঁর জার্নালে লিখলেন –
I wonder if the Japanese announcement of Subhas Chandra Bose’s death in an aircrash is true. I suspect it very much, it is just what would be given out if he meant to go underground.
স্বয়ং ভারতের বড়লাটও সন্দেহ পোষণ করছেন! কিন্তু এর বছর দশেক পরে, শাহানওয়াজ তদন্ত কমিটি কিন্তু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল – হ্যাঁ, তাইহোকুতে বিমান দুর্ঘটনাতেই মারা গিয়েছিলেন নেতাজি। মনে রাখবেন, সেই তদন্ত কমিটির মাথায় ছিল ভারত সরকার। আর কমিটির সদস্যের মধ্যে শাহানওয়াজ প্রাক্তন আজাদি সৈনিক হলেও, ততদিনে নেহেরুর স্নেহধন্য। আর এস এন মিত্র ছিলেন সরকারি কর্মচারী। তৃতীয় সদস্য অর্থাৎ সুভাষচন্দ্রের মেজদা সুরেশচন্দ্র বসু তদন্ত কমিটির রিপোর্টের সঙ্গে একমত হননি।
মজার ব্যাপার হল, ভারত সরকারের তদন্ত কমিটি সুভাষকে বিমান দুর্ঘটনায় মৃত ঘোষণা করে দিলেও, মার্কিন সরকার তা তখনও মেনে নেয়নি। ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ‘ন্যাশানাল রিপাবলিক’ পত্রিকা বলছে – ‘The Government and people of USA do not believe the so called death of Chandra Bose in that reported plane crash. Moreover, some people have seen him after the incident including a field nurse. There is every possibility that Bose is alive.’
হ্যাঁ, বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ, গোয়েন্দা রিপোর্ট ইত্যাদি মিলিয়ে দেখলে এ-কথা ধরে নেওয়াই যায়, বিমান দুর্ঘটনায় মরেননি নেতাজি। আর বাঙালি তো কোনোকালেই বিশ্বাস করেনি সে-খবর। এদিকে, ১৯৪৬ থেকে বিভিন্ন জায়গা থেকে আসতে লাগল সুভাষের অবস্থানের খবর। উঠে এল বেশ কিছু ফটোগ্রাফও, যার সঙ্গে সুভাষের চেহারার অদ্ভুত সাদৃশ্য। এমন সব ফটোগ্রাফ পাওয়া গেল পরবর্তী প্রায় দেড় দশক ধরে, কখনও চিন, কখনও মাঞ্চুরিয়া, তাসখন্দ, এমনকি ভারতেও, যা নিয়ে আলোচনা হল বারবার। ইনিই কি সুভাষ? আলোচনা হল নির্দিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তিকে নিয়েও। সুভাষ নাকি ফিরেও এসেছেন ভারতে। শুধু নিজের পরিচয় দিচ্ছেন না, এই যা!
কোথায় ছিলেন সুভাষ? কোন ফটোগ্রাফগুলি দেখে বিভিন্ন সময় চমকে-চমকে উঠল আপামর বাঙালি?
(ক্রমশ)
তথ্যঋণ -
১। সুভাষ ঘরে ফেরে নাই(শ্যামল বসু)
২। আমি সুভাষ বলছি(শৈলেশ দে)
৩। নেতাজি অন্তর্ধান রহস্য
৪। নেতাজী রহস্য সন্ধানে(নারায়ণ সান্যাল)