দি উইন্ড উইল ক্যারি আস
আব্বাস কিয়ারোস্তামি
ইরান, ১৯৯৯
সিনেমা প্রযুক্তির দান, শহরের জিনিস।
ছবির প্রথম দৃশ্য থেকে পরিচালক আব্বাস কিয়ারোস্তামি আমাদের বোঝান, এই ছবিটিও বহিরাগত, যদিও সেই 'বাহির'কে আমরা দেখতে পাই না।
একটি গাড়ি একটা গ্রামে ঢুকছে পাহাড়ি পথ দিয়ে।
গাড়িটি শহরের অনুষঙ্গ বহন করে আনছে, আমাদের চোখ (ক্যামেরার চোখ)-ও অনুরূপে শহরের অনুষঙ্গ বহন করছে। গ্রামে ঢুকছে একদল পরিচয় গোপন করা ফোটোগ্রাফার/ সাংবাদিক। একটি অতিবৃদ্ধার অন্ত্যেষ্টি কভার করা উদ্দেশ্য তাদের। বৃদ্ধা মরণাপন্ন। ছবির ফ্রেম আমরা প্রথম থেকেই দেখছি পেইন্টিং-সদৃশ। গাড়িটি জিগজ্যাগ, দুরূহ রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে, তাকে আমাদের দৃষ্টি (gaze) অনুসরণ করছে।
আরও পড়ুন
‘শেষ পঞ্চাশ’ প্রথম পর্ব: দ্বাদশ ব্যক্তি
গাড়ির মধ্যে চলা সংলাপ আসছে একেবারে কাছ থেকে। অথচ চরিত্রগুলি গাড়ির মধ্যে, অর্থাৎ ক্যামেরা ও সাউন্ড রেকর্ডারের আওতা থেকে লজিকালি দূরে অবস্থিত। - এখানে তা হচ্ছে না।
গাড়ির চরিত্রদেরও দেখা যাচ্ছে না। চার পাঁচ মিনিট ধরে তারা কথা বলেছে, তাদের একবারও দেখা যায়নি। তাদের মধ্যে একজন কবিতা বলছেঃ সোরাব সাফেরির কবিতা। লাইনটি ছিল, 'ঈশ্বরের স্বপ্নের সবুজতা'। আব্বাস এখানে নিজের ছবি (হোয়ার ইজ মাই ফ্রেন্ডস হোম/১৯৮৭) কেও কৌশলে উদ্ধৃত করছেন।
এবার প্রথম মানুষ ফিগার আমরা দেখছি- এক কৃষিজীবী মহিলাকে তারা পথ জিগ্যেস করছে। মহিলাকে আমরা দেখি তাদের দৃষ্টি থেকে।
এবার ছবির চরিত্র ফারজাদকে আমরা দেখব। সে গাড়িটিকে গ্রামে নিয়ে যাবে।
আরও পড়ুন
শেষ পঞ্চাশ দ্বিতীয় পর্ব : কল্পজগতের গুপ্তধন
ফারজাদের যে পোশাক আমরা দেখি- এই পোশাকেই তাকে ছবিতে ফিরে ফিরে আমরা দেখব। টুপি ও লাল শার্ট, মানে ফারজাদ।
আমরা গ্রামে এসেছি। ফারজাদ বলেঃ 'পূর্বপুরুষরা এই গ্রাম বানিয়েছেন। ' যেন বলতে চাইছে, পূর্বপুরুষদের সৃষ্টি থেকে গেছে, তারা নেই আর।
সবুজ শার্ট পরা যে লোকটি নেমেছে সে এবার ছবির মূল চরিত্র হয়ে যাবে। তার অপর বন্ধুরা ছবিতে উপস্থিত থাকবে, কিন্তু তাদের কখনোই ভালো করে দেখা যাবে না।
অন্য বন্ধুরা নেমেছে আমরা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু তারা গাড়ি সারাতে ব্যস্ত, এই সময় সবুজ জামা পরা লোকটি ফারজাদের সঙ্গে উঠে আসবে পাহাড়ি পাকদণ্ডি দিয়ে। তারা গ্রামে ঢুকছে, যেন ছবিটিও গ্রামে ঢুকছে।
তারা ছবির কি-ক্যারেকটার হয়ে যাবে এবার। অন্য বন্ধুরা কখন ঢুকবে আমরা দেখতে পাব না, তারা ছবিতে থেকেও থাকবে না যেন।
এই ছবি স্বেচ্ছাকৃত ভাবে সীমাবদ্ধ দৃষ্টির অধিকারী।
আরও পড়ুন
জলপাইশাখার মধ্যে দিয়ে যেতে
দূর থেকে সবুজ জামা পরা চিত্রসাংবাদিক ও ফারজাদ আসছে। তারা এবার বড়ো হয়ে আসে। ক্যামেরা এই প্রথম সাংবাদিককে বড় আকারে দেখে। সে ছবির চরিত্র হিসেবে এস্ট্যাবলিশড হয়ে যাচ্ছে। এবার ছবিটা তাদের সঙ্গে গ্রামে ঢুকে পড়েছে। গ্রামেই পরের দিনগুলি ছবিটি রয়ে যাবে, অপেক্ষা করবে।
পাহাড়ের ওপরে গোটা গ্রামটাই এরকম ফাঁকফোঁকরের মত দরজা, সুড়ঙ্গ বা সেতুর মতো রাস্তা দিয়ে তৈরি। এই স্ট্রাকচার দৃষ্টিকে প্রতিহত করে, স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি মনোযোগী হতে হয় আমাদের।
আমরা দেখছি, দুজনে একটা ছোট্টো নিচু দরজা দিয়ে ঢুকছে, ফ্রেম উইদিন ফ্রেম।
মহিলারা নীল-কালো পোশাক পরে আছেন। দুটি রংই মৃত্যুময়।
পেইন্টিং-এর কথা মনে আসবেই- এখানে টেক্সচারের বেশিরভাগটা হলুদ, দুজন চরিত্রের একজন সবুজ জামা, অন্য জন লাল জামা। পশুপাখিদের নিজস্ব প্রাকৃতিক রং।
এই দৃষ্টি বদ্ধ, কিছুটা ক্লাস্ট্রোফোবিক। ফ্রেম ন্যূনতম প্রয়োজনের বেশি কিছু ধরছে না।
এই দৃশ্যে সিনেমার সময় (রিল টাইম) ও বাস্তবের সময় (রিয়েল টাইম) সমান। ফলে আমাদের অভিজ্ঞতা ও সাংবাদিকের অভিজ্ঞতার মধ্যে ফারাক থাকছে না। আমাদের নাগরিক সত্তা ও সাংবাদিকের নাগরিক সত্তা একাকার হয়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন
জলপাইশাখার মধ্যে দিয়ে যেতে (দ্বিতীয় পর্ব)
দূরাবলোকনে, কখনো কাছ থেকে, আমরা সাংবাদিক ও ফারজাদকে অনুসরণ করে যাই। ফাঁক ফোঁকর দিয়ে ওরা এগোতে থাকে, মাঝে মাঝে দৃষ্টির বাইরে চলে যায়, আবার দৃষ্টির নাগালে আসে।
ছবির ভাষাই এভাবে টেনশন তৈরি করে, ছবির কন্টেন্টকে ছবির ভাষা ছাপিয়ে যায়।
দোতলার একটি ঘর। এই স্থানটিকে আমরা ভালো করে দেখব। এটি ছবিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এখানে সাংবাদিকদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে- গ্রামের লোকেরা যাদের এঞ্জিনিয়ার বলে চিনছে।
সাংবাদিক মরণাপন্ন বৃদ্ধার ঘরটি দেখতে চাইলে ফারজাদ তাকে নিয়ে যায় একটি উঁচু জায়গায়। সেখান থেকে একটা জানলাই শুধু দেখা যায়। নীল রঙের জানলা, যেটি বন্ধ।
বৃদ্ধা জানলার ওপারে, আমাদের চোখের আওতার আড়ালে, এবং বাইরে।
আরও পড়ুন
একটা গোটা গ্রামই প্রযোজক, ছকভাঙা এক সিনেমার গড়ে ওঠার ‘সত্যি রূপকথা’
নিচে বৃদ্ধার ছেলে (ইনিও বৃদ্ধ) বসে আছেন। ক্যামেরা সম্ভ্রম রাখছে মৃত্যুর প্রতি। এই সম্ভ্রম ভাষাগত। ক্যামেরা দূর থেকে দেখছে, চুপ করে দেখছে।
এই সম্ভ্রম সাংবাদিকের নেই। কারণ তার তাড়া আছে, ছবি তুলে নেওয়ার তাড়া। সে টেনসড, ক্যামেরা তার টেনশনকে দেখছে। এখান থেকে ছবি দুটো সুতোয় ছিঁড়ে গেল। একটি সুতোয় থাকল গ্রাম, গ্রামের নিস্তরঙ্গ জীবন এবং অন্য সুতোয় সাংবাদিক ও তার প্রকল্প। স্থান বিন্যাসও ভেঙে গেল দুভাগে, সাংবাদিক গোটা গ্রাম চষে বেড়াবে, তার সাথে সাথে আমরাও। এই স্থান-ভাগটি ডায়নামিক। সে যখন ফিরে আসবে এই জানলার কাছে, আমরা অন্য স্থান-ভাগটিকে দেখব। এটি স্থির হয়ে আছে, স্ট্যাটিক।
আরও পড়ুন
থ্রিলারের চেনা গণ্ডি ছেড়ে বাঁক নিল ‘শব্দ জব্দ’, প্রশ্নের ভূত তাড়া করবে দর্শককেও
এই দিনটি শেষ হয়ে যায় অতর্কিতে- রাত না দেখিয়েই। দুজন স্ত্রীলোক সাংবাদিককে লক্ষ করছে, এটি প্রথম দিনের শেষ দৃশ্য। পরের দৃশ্য, মোরগ ডাকছে, সাংবাদিক বন্ধুদের ডাকছে নাম ধরে। তারা তিন জন ঘরের ভেতর। তাদের নাম আমরা সাংবাদিকের মুখে শুনতে পাই। সাংবাদিকের হাতের আপেল গড়িয়ে ঢাল বেয়ে নেমে যায় তলায়। ফারজাদ সেটা কুড়িয়ে নেয়।
ফারজাদ আপেল কুড়োচ্ছে।
অর্থাৎ বস্তু (অবজেক্ট) ছবির ন্যারেটিভে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিল। আপেল ঢাল বরাবর গড়িয়ে না গেলে ছবির ন্যারেটিভই এই সূক্ষ্ম ভাঁজটিতে অন্য রকম হত। বস্তুপৃথিবীর প্রতি আব্বাস নজর রাখছেন, দরদের সঙ্গে।
আরও পড়ুন
সর্বস্ব খুইয়েও, উত্তরণের দিকে এগিয়ে যাওয়াই জীবন – ‘মানুষ’ চিনিয়ে দিল তা
সাংবাদিক ফারজাদের সঙ্গে যাচ্ছে।
সে জিগ্যেস করে, এই গ্রামটি এত সুন্দর, এর নাম কেন কালো উপত্যকা?
ফারজাদ উত্তর দেয়, কারণ পূর্ব পুরুষেরা এই নামই রেখেছেন।
সাংবাদিকঃ কেন, তুমি এটাকে সাদা উপত্যকা বলে ডাকতে পার না?
ফারজাদঃ না, আমাদের সেই অধিকার নেই। আমাদের কালো উপত্যকা বলেই ডাকা নিয়ম।
গ্রাম্য সংস্কারে আমরা স্পষ্ট পাচ্ছি জীবন ও মৃত্যুর দ্ব্যর্থক ইঙ্গিত- সাদা ও কালো, জীবন ও মৃত্যু।
গ্রামের নামের মধ্যেই ছমছমানি ভাব, যেন মৃত্যু এখানে ছায়া ফেলে আছে।
(ক্রমশ)