পিতৃতান্ত্রিক সমাজের গালে চড়, নারীদের লড়াইয়ের কথাই তুলে ধরল 'থাপ্পড়'

'থাপ্পড়' একখানা চরম থাপ্পড় কষিয়েছে। তার মেইনস্ট্রিম বলিউডি ঝোঁক নিয়েই কষিয়েছে। অনেকের মতে এই থাপ্পড় 'পুরুষের' গালেই পড়েছে। বলছেন, "শুধুমাত্র একটা থাপ্পড়ের জন্য এতকিছু?"

আরও পড়ুন
এই প্রথম মহাকাশে পাড়ি বাংলা চলচ্চিত্রের, মঙ্গলের মাটিতে রহস্য বুনলেন পরিচালক

তাই কি? গপ্পটা তাহলে বলতেই হয় খানিক। ছবির মূল চরিত্র অমৃতা ওরফে আমু। একজন 'সুখী গৃহবধূ'। যেন 'সানন্দা'র পাতা থেকে উঠে আসা। অতি স্বচ্ছল বিবাহিত জীবন । স্বামী বিক্রম, কাজপাগল। নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। আর আমু স্বামীকে নিয়ে। বিক্রমের প্রতি তার ভালোবাসা নিখাদ। বিক্রমও ভালোইবাসে স্ত্রীকে। গড়পড়তা ভারতীয় পুরুষের মতোই, সে মাঝেমধ্যে রেস্টুরেন্টে ডিনারে যায়, স্ত্রীকে উপহার দেয় গয়না। আমুর সারাদিনের রুটিন, কফি-ব্রেকফাস্ট-ফাইফর্মাস-শাশুড়ির সেবায় কেটে যায়।

আরও পড়ুন
ঢাকায় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র মঞ্চে পুরস্কৃত কলকাতার পরিচালক সৌরভ

একদিন একটি পার্টিতে খানিক উত্তপ্ত ও মাতাল বিক্রম চড় কষায় স্ত্রীর গালে। একগাদা অতিথির সামনে। আমুর সামনে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে সবটুকু। মুহূর্তেই স্পষ্ট হয়ে যায়, 'সুখী গৃহকোণে' লুক্কায়িত পিতৃতন্ত্রের স্বরূপটি। এই 'চড়'কে হেসে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন সংসারের বাকি সদস্যরা। আমুর মাতৃদেবীও। শাশুড়ি বলেন "মেয়েদের সহ্য করতে হয়"…

তারপর… গল্প এগোতে থাকে। শুরু হয় আত্মমর্যাদা বনাম পুরুষতন্ত্রের লড়াই।

আরও পড়ুন
থ্রিলারের চেনা গণ্ডি ছেড়ে বাঁক নিল ‘শব্দ জব্দ’, প্রশ্নের ভূত তাড়া করবে দর্শককেও

মূল গপ্পের ভাঁজে আরো অনেকগুলো জীবন দেখিয়েছেন নির্দেশক মহাশয়। যেমন, পরিচারিকা সুনীতা, যাকে নিয়মিত নির্যাতিত হয় স্বামীর হাতে। আইনজীবী নেত্রাকে বারংবার মনে রাখতে হয়, যে তাঁর সাফল্যের পেছনে দায়ী শ্বশুরবাড়ির প্রতিপত্তি। এমনকি আমুর পিতৃদেব, যিনি তথাকথিত 'আধুনিক', নীরবে প্রশ্ৰয় দেন পিতৃতন্ত্রকে।

আরও পড়ুন
জাতপাতের হিংসার মধ্যেই মানুষের বেঁচে থাকা, নতুন শর্ট ফিল্মে উঠে এল ‘বদ্ জাত’দের কথা

ছবির সংলাপ-চিত্রনাট্য বেশ টানটান। মুখ্যচরিত্রে তাপসী পান্নু এককথায় অনবদ্য। স্ক্রিন দাপিয়ে বেরিয়েছেন নবাগত অভিনেতা পাভাইল গুলাতি। রত্না পাঠক শাহ, কিংবা গীতিকা বিদ্যা ওলিয়ান নিজ চরিত্রে প্রায় নিখুঁত। কুমুদ মিশ্র এই সিনেমায় নতুন রূপে। এমন সংবেদনশীল অভিনয় বড়পর্দায় বিরল।

আরও পড়ুন
জলপাইশাখার মধ্যে দিয়ে যেতে

তবে ছবির কিছু আঙ্গিক নিয়ে খানিক সমস্যা থেকেই যায়। মূলস্রোতের কিছু পপুলিস্ট যুক্তি দেখা গিয়েছে বৈষম্য বিরোধিতার ক্ষেত্রে। কয়েকটি অংশ যথেষ্ট দুর্বল। অতিরিক্ত আবহের ব্যবহার কিছু সিনের গাম্ভীর্যকে খানিক লঘু করে দেয়।

আরও পড়ুন
জলপাইশাখার মধ্যে দিয়ে যেতে (দ্বিতীয় পর্ব)

এই ছবিতে 'পুরুষ'রা মোটেই অতিরঞ্জিত রকমের 'ভয়ানক' না। তাঁরা পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো দ্বারা চালিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজেরাই বুঝতে পারেন না 'ভুল'টা। 'নারী'কে সম্পত্তি হিসেবে দেখার চোখ তো বহুদিনের। পুরুষের 'নারীবাদ', আধুনিকতার পেছনে চিরকাল নিজেদের ভাষ্য অনুযায়ী নির্মাণ করেছে 'নারী' পরিচয়কে। যা পুরুষের চোখে তুচ্ছ, তা প্রতিপদে অপরজনের কণ্ঠস্বরকে অবদমিত করে রাখা। ক্ষমতার সূক্ষ আগ্রাসন প্রতিফলিত হয়েছে ইতিহাসে, আপাত লিঙ্গসাম্যের ছদ্মবেশে। 'থাপ্পড়' শুধু সপাটে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে। খুলে দিয়েছে 'প্যান্ডোরার বাক্স'…

আরও পড়ুন
৪টি বিভাগে অস্কারজয়ী সিনেমা ‘প্যারাসাইট’ ও আজকের দেশ-দুনিয়া

সিনেমাটা দেখতে গিয়েছিলাম এক মন নিয়ে। ফিরলাম অন্য মনে। লিঙ্গচিহ্নে পুরুষ, তাই 'ছোট্ট' ঘটনাকে প্রশ্ন না করাটা হয়তো অবচেতনে জায়েজ। 'ছেলেবেলা' কখনো 'মেয়েবেলা'র সঙ্গে মেশেনি। ক্লাস নাইনে প্রথম চা ফোটানো। নিজেকে মনে হলো রান্নাঘরের রাজা। তারপর রন্ধনবিদ্যার সিলেবাসে এখনো চা-অক্ষর গোমাংস রয়ে গেছি। মায়ের হাত থেকে গরম মশলার কৌটোটা ছিনিয়ে নিতে শিখিনি। শেখায়নি সমাজ। খানিক চিন্তিতমুখে দিদা বলছিলেন, "ভাত ফোটাও দাদু… আজকালকার মেয়েরা আর রেঁধেবেড়ে খাওয়াবেনা।" নেহাত সেকেলে কথা। আপাত নারীবাদী মনন, সচেতনভাবেই এমন উপদেশ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবে। একগাল হাসলুম। বুড়ি বলে কী! তারপর সোফায় পা ছড়িয়ে বসে মধুরকণ্ঠে আদেশ করতে হলো, "ওমা! একটু চা করো না!"