মাদুরাইয়ের টি. কালুপাত্তি ব্লক। সেখানকারই কুভালাপুরাম গ্রামে গিয়ে যে-কোনো কাউকে জিজ্ঞেস করুন, গেস্টহাউসগুলো কোন দিকে? তাঁদের চোখের সন্দেহজনক চাউনি আপনার মনের জিজ্ঞাসাকে বাড়িয়ে দেবে আরও একটু। পুরুষেরা কোনো উত্তর না দিয়ে আঙুল তুলে দেখিয়ে দেবেন সন্তোষজনক দূরত্ব রাখা মহিলাদের দিকে। তাঁদের দেখানো নির্দেশিকা মেনে গ্রামের প্রান্তে প্রায় অর্ধেক কিলোমিটার পথ হেঁটে গেলে দেখা যাবে, দুটো ফাঁকা ঘর দাঁড়িয়ে আছে মাঠের মধ্যে। দূর থেকে দেখে মনে হবে পরিত্যক্ত। ঘরের চাতালে দুপুরের হাওয়ায় ডালপালা নাড়িয়ে চলেছে একটি নিম গাছ। নিম গাছের ডালে সার বেঁধে রাখা আছে বিভিন্ন আকারের পলিথিন ব্যাগ, বস্তা। এই বাড়ি দুটিই স্থানীয় মানুষে চলতি কথায় ‘গেস্ট হাউস’।
কিন্তু এই গেস্ট হাউসের ‘গেস্ট’ মানে অতিথি কারা? খোঁজ নিলে সামনে আসে গায়ের লোম খাড়া করে দেওয়া সত্যি। বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও, এই বাড়ির আসল বাসিন্দারা হলেন গ্রামের ঋতুমতী মহিলারা। মাসিক চলাকালীন সমাজের থেকে তাঁদেরকে বিচ্ছিন্ন করতেই এই অভিনব গৃহের পরিকল্পনা! তাই মাসের সেই ‘বিশেষ’ পাঁচটি দিন কোনো-না-কোনো মেয়েকে এসে থাকতেই হয় এই ঘরে। শুধু তাই নয়, বয়ঃসন্ধির প্রাথমিক লগ্নে কিশোরী মেয়েদের গোটা একটি মাস বন্দি করে রাখা হয় এখানে, যাতে তারা সমাজের সংস্পর্শে আসতে না পারে, যাতে তারা সমাজকে আরও একটু নোংরা করতে না পারে। প্রসবকালেও মহিলাদেরকে সদ্যোজাত শিশুসন্তানসহ একটি মাস জোর করে রেখে দেওয়া হয় এই ঘর দুটিতেই।
আরও পড়ুন
মায়ের মৃত্যুর পর অপ্রকৃতিস্থ ছেলে, এক বছর ধরে বন্দি শিকলে
মাসিক চলাকালীন মেয়েরা অচ্ছুত। তাই গাছে বেঁধে রাখা বস্তা বা পলিপ্যাকের ভিতরে খাবারের পাত্রে বাড়ি বা প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে কেউ এসে রেখে যায় দৈনিক খিদে মেটানোর রসদ। ঋতুমতী মেয়েদের ধারেকাছেও আসে না কেউ, পাছে ছোঁয়া লেগে যায়!
প্রায় কুড়ি বছর আগে গ্রামের চাষাভূষা মানুষগুলোই নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে বানিয়ে দিয়েছিল এর মধ্যে একটি ঘর। পরবর্তীকালে ঘরের সংখ্যা বাড়ে আরও একটি। কিন্তু তাতেই বা কুলোবে কেন? মাসের মধ্যে সুতরাং কোনো-কোনো দিন আট-নয়জন মেয়েকে এসে গাদাগাদি করে থাকতে হয় এই ছোট দু’টি ঘরে, স্থানীয় ভাষায় যাদের নাম ‘মুত্তুথুরাই’ বা দূষিত মহিলাদের থাকবার জায়গা। তবে শুধুমাত্র কুভালাপুরাম গ্রামেই নয়, মাদুরাইয়েরই আরও চারটি গ্রামে চালু আছে এই নিকৃষ্ট প্রথা।
আরও পড়ুন
নাৎজি সৈনিক ও ইহুদি বন্দিনীর প্রেম, যে অপূর্ণ সম্পর্কের সাক্ষী ছিল কনসেনট্রেশন ক্যাম্প
যদিও স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের মতে, বহু প্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছে এই প্রথাটি। যখন জঙ্গলের মানুষদের প্রধান জীবিকাই ছিল শিকার করা, তখন থেকেই মাসিক চলাকালীন সময়ে মহিলাদেরকে জঙ্গল থেকে দূরে রাখার একটি প্রথা চালু ছিল। পিছনে কারণ ছিল সেই মানুষের বিশ্বাস যে, রক্তের গন্ধে লোকালয়ে আক্রমণ করতে পারে জংলি জন্তু-জানোয়ারেরা। সেই প্রাচীন প্রথাটিকেই হাতিয়ার করে সেটিকে বর্তমানে মহিলাদের উপর ‘দমন-নীতি’ হিসেবে চালানো হচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এক্ষেত্রে গ্রামীণ মানুষের কথায় উঠে আসে, প্রাচীন লোককথার প্রসঙ্গও। লোককথা মতে, ‘সিদ্ধার’ বা পবিত্র ক্ষমতাশালী একজন পুরুষ আসলে এই কুভালাপুরাম সহ আরও চারটি গ্রামের ‘স্বামী’। সিদ্ধারের কাছেই প্রাচীনকালে করা হয়েছিল প্রতিজ্ঞা, ঋতুকালীন সময়ে মহিলাদেরকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে তার কাছে। সেই বিশ্বাসবশতই এই পাঁচটি গ্রামে আজও জারি আছে এই অসুস্থ প্রথা। কারণ গ্রামবাসীদের বিশ্বাস, এই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করলে সিদ্ধারের কোপে ধ্বংস হয়ে যেতে হবে তাদের। ফলে, এই অবমাননা থেকে মুক্তি নেই কিশোরীদেরও। কোনোদিন হবে কি? সময়ই উত্তর দেবে এর…