বাংলাভাষী চলচ্চিত্র ইদানীং যথেষ্ট বৃদ্ধ হয়েছে, একশো বছর অতিক্রান্ত। বার্ধক্যের লক্ষণ যেমন প্রাজ্ঞতা, বিচক্ষণতা, প্রসন্নতা; তেমনই আবার অবসাদ, রুগ্নতা, মৃত্যুভয়। গত পঞ্চাশ বছরে (১৯৭০-২০২০) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটি আষাঢ়ে গল্পকথার আদলে বদলে গেছে, একই সঙ্গে এই প্রদেশের ছায়াছবিও… এবং সেই বদল অতি সক্রিয়। আমরা নিরীহ জনতা, নির্বিষ চলচ্চিত্রের প্রেমে মজে থাকি, এই প্রসঙ্গেই একটি সিরিজের দরকার অনুভব করলাম – যেখানে পরিবর্তনকামী বাংলা ছবি ও তার প্রবণতাগুলি বুঝবার চেষ্টা করা হবে। ইচ্ছে ছিল কালানুক্রম অনুসরণ ক’রেই এগোব, কিন্তু একটি সাম্প্রতিক মৃত্যু সেই বাসনায় সহসা ফাটল ধরিয়ে দিল। …সিদ্ধান্ত বদলালাম; এও মাথায় এল যে, অধুনাতন ছায়াছবির নন-লিনিয়ার অগ্রসৃতিকেই তরুণ অডিয়েন্সরা অধিক আকর্ষণীয় জ্ঞান করে থাকেন। ফরাসি চলচ্চিত্রকার অনেক আগেই বলেছেন, ‘একটি ছবিতে অবশ্যই আদি, মধ্য ও অন্ত থাকবে, তবে ক্রমানুসারে নাও থাকতে পারে!’
আরও পড়ুন
জলপাইশাখার মধ্যে দিয়ে যেতে
নতুন তথ্য নয়, সকলেই জানেন; বাইশ বছরের জনৈক তরুণ ১৯৮০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দাদার কীর্তি’ চলচ্চিত্রে এক সরল, আকাট ও সহৃদয় ‘ফুলদাদা’র চরিত্রে অভিনয় করেন, যে ছবি ও চরিত্র – দু’টিই অতি দ্রুত পশ্চিমবঙ্গের পপুলিস্ট সিনেমা-র মিথ হয়ে গেছিল। পর্দা ও প্রেক্ষাগৃহ এক অধুনালুপ্ত ম্যাজিকে একাকার হয়ে যায়, যেন স্বপ্নবৎ সাদা-কালো সাইলেন্ট ছবি… দর্শক দমফাটা হাসি হেসেছিল, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল এবং ক্লাইম্যাক্সে অবশ্যই হাত তুলে উল্লাস করে উঠেছিল। অতি উচ্চভুরুও স্বীকার করবেন যে ছবিটি ছিল আদ্যোপান্ত ‘বাঙালি’ এবং ভবিষ্যতে দ্বিতীয়বার এই ছবি হবে না। যেমনটা লিখেছিলেন আমাদের কবি, …‘এ পৃথিবী একবার পায় তাকে, পায় নাকো আর’!
আরও পড়ুন
জলপাইশাখার মধ্যে দিয়ে যেতে (দ্বিতীয় পর্ব)
…‘চ্যাপলিন কখনোই দর্শককে তাঁর দিকে চেয়ে স্মিতভাবে হাসতে দেন না; হয় তারা হাসিতে একেবারে ফেটে পড়বে নয়তো ভীষণ দুঃখিত হয়ে যাবে’, ‘দ্য সার্কাস’ দেখে মনে হয়েছিল তাত্ত্বিক ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের। রূপোলি পর্দায় চ্যাপলিনের একক ও নির্বিকল্প উপস্থিতি অল্প আয়াসে যে দুরূহ কাজটি করে ফেলত – অর্থাৎ জনতাকে শিল্পটির সঙ্গে ইনভলভ করা, একীভূত ক’রে ফেলা – একটু ঘুরপথে তরুণ মজুমদার সেই ইনভলভমেন্টের কাজটিই করিয়ে নিতেন। অবশ্যই কোনো চ্যাপলিন তাঁর ছবিতে ছিলেন না, সাইলেন্ট ছবির যুগও অস্ত গেছে, দর্শককে শুদ্ধ আবেগে মথিত করার কাজটি দিনে দিনে কঠিন হয়ে উঠেছে। কিন্তু আগেই বলা হয়েছে, তাঁর ছবিগুলি অসহ্য কোমল ‘বাঙালি’, একজন জ্যান্ত ‘চ্যাপলিন’-এর বদলি হিসেবে তাঁর ছবিতে ছিল ‘বাঙালিত্ব’। ছবি হিসেবে ‘দাদার কীর্তি’ কি তরুণবাবুর সেরা কাজ? অন্তত আমরা কখনই তা মনে করি না (তর্কসাপেক্ষে হয়তো সর্বাধিক জনপ্রিয় কাজ)। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাতিদীর্ঘ উপন্যাসে কিছু সোনারূপো ছিলই, পরিচালক পরম যত্নে তা থেকে একটি ঝলমলে জড়োয়া গয়না তৈরি করলেন। নাটকীয় প্লট, অনুপম সঙ্গীত, আর্কিটাইপ মধ্যবিত্ততা – এগুলি ছিল বরাবরের মতোই। কিন্তু পরিচালকের দরকার হয়ে পড়েছিল একটি নিষ্পাপ মুখের – যার নির্বুদ্ধিতা, সারল্য, সৌজন্য ও আত্মত্যাগের বিরল মুহুর্তগুলি ক্রমশই হাসিতে, বিস্ময়ে, কান্নায় তছনছ করে দেবে বাঙালি দর্শককে।
আরও পড়ুন
উত্তম-পরবর্তী বাংলা সিনেমার অন্যতম নায়ক তিনি, চলে গেলেন তাপস পাল
সেই মুখ-ই ঘটনাচক্রে হয়ে যান এক রূপবান যুবক। তাঁর অভিনীত চরিত্রে কয়েকটি বেসিক মোটিফ, – হে পাঠক! আপনারা লক্ষ করছেন কি? … পরিবারের স্নেহ ও অনাদর, সামাজিক অ-যোগ্যতা, মফসসল-সুলভ অনাধুনিকতা, দেবশিশুসুলভ সারল্য ও হাসিমুখে আত্মত্যাগ করতে-পারা (যার পেছনে অবশ্যই প্রচুর দীর্ঘশ্বাস ও কান্না রয়েছে) – এগুলিই নবাগত নায়কের পক্ষে আর্কিটাইপ হয়ে উঠেছিল। ১৯৮১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘সাহেব’ নামের সেই সাদাকালো ছবিটি মনে আছে? ‘দাদার কীর্তি’-তে ফুলদাদা ছিলেন বাড়াবাড়ি রকমের ‘ক্যাবলা’ ও ‘ভদ্র’, ‘সাহেব’ ছবিতে ছকটি উলটে যায়, তিনি হয়ে যান ‘বাচাল’, ‘ছটফটে’, কিন্তু দুজনেই মানুষ হিসেবে থাকেন পয়লা নম্বরের – সৎ, সরল ও সহৃদয়। দুজনেই লেখাপড়াতে মোটামুটি কাঁচা, দুজনেরই দুটি বিশেষ প্রতিভা আছে – ফুলদাদা চমৎকার গান জানেন, সাহেব দুর্দান্ত ফুটবল খেলে। দুজনেই পরিবারের কর্তা রাশভারী বাবার বিরাগভাজন, ‘ছেলের কিছুই হল না’ ফলে কিছু অনাদর পেয়ে থাকেন, (এবং গোপনে মহীয়সী বৌদিদের ঢালাও স্নেহ)। ফুলদাদা বিবাহযোগ্যা নায়িকার ওপর নিজের দাবি ছেড়ে দেন, ছোড়দাদা সাহেব তার বোনের বিবাহের জন্য নিজের কিডনি বিক্রি ক’রে দেয়। দু’ক্ষেত্রেই ত্যাগের উপলক্ষ হয়ে যায় এক নারী। এক অবাক-করা কাকতালীয় যে, দুটি চরিত্রেই অভিনয় করেছিলেন শ্রীমতী মহুয়া রায়চৌধুরী!
আরও পড়ুন
প্রোজেক্টরে সিনেমা দেখতে চায় না কেউ, অভাবের সঙ্গে লড়ছেন কলকাতার বায়োস্কোপওয়ালা
আমরা মনে রাখব, উত্তমকুমার (১৯২৬-১৯৮০)-এর শূন্যতা জনপ্রিয় বাংলা ছবির পক্ষে এক অমোচনীয় দুর্বিপাক হয়ে ওঠে। স্বর্ণযুগের ছবির কারিগরি নৈপুণ্য, অপূর্ব অভিনয়, মন্থর চলন, দুরন্ত সঙ্গীত এবং সাহিত্যনির্ভর মেলোড্রামা দিনে দিনে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। হিন্দি ছবির আগ্রাসন, বাজারসভ্যতার অলজ্জ উত্থান, সিরিয়াস ছবির প্রতি সর্বৈব অনাগ্রহ টালিগঞ্জ ইন্ড্রাস্ট্রিকে প্রায় ডোবাতে বসেছিল। জনৈক তারকার হৃদয়কাড়া হাসি বা একটি প্রথম শ্রেণির চিত্রনাট্য দর্শককে আর প্রেক্ষাগৃহে টানতে পারল না। নতুন পরিচালকেরা নিশানা করলেন পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতাকে, যাঁরা প্রযোজকের আর্থিক লোকসান বাঁচাতে পারবেন। অতএব আশির দশকে বাংলা ছবির ইউ-এস-পি হয়ে ওঠে ‘বাঙালি’ সেন্টিমেন্ট। ভিড়ের আবেগে যা দ্রুত টোকা দেয়, এমন পপুলার মোটিফগুলি সহসা জরুরি হয়ে পড়ে। সুবিদিত তথ্য এই যে, ১/ সেই সময়ের বাঙালি আবেগপ্রবণ হতে ভালোবাসত। ২/ বাঙালি ব্যাক্তির পরাজয়কে উঁচু চোখে দেখত। ৩/ ক্রমেই যে-নতুন আধুনিক ব্যবস্থায় সে জড়িয়ে পড়ছে, বাঙালি তা নিয়ে সুখী ছিল না। ৪/ সে নিজেরই খুঁত বা ভুলচুক নিয়ে সমালোচনা নিতে রাজি ছিল। ৫/ বাঙালি এক অনাড়ম্বর একান্নবর্তিতায় বিশ্বাস করত এবং এর পালটা প্রবণতাকে ঘৃণা করত। …জনপ্রিয় ছবি যাঁরা বানাচ্ছিলেন, তাঁদের এগুলি সম্যক জানা ছিল।
আরও পড়ুন
হারিয়ে যাওয়া রিল পুনরুদ্ধার, ৬৩ বছর পর ‘মুক্তি’ পাবে কিশোর কুমারের সিনেমা
অঞ্জন চৌধুরী পরিচালিত অতিখ্যাত, সুপারহিট ‘গুরুদক্ষিণা’ (১৯৮৭) ছবিতেও পুরোনো আর্কিটাইপ অক্ষুণ্ণ থাকবে। ‘শিক্ষক’ দ্রোণাচার্যকে ভাবশিষ্য একলব্য নিজের বুড়ো আঙুল কেটে উপহার দিয়েছিলেন, যাতে প্রতিদ্বন্দ্বী অর্জুনই ভূভারতের শ্রেষ্ঠ বীর হতে পারেন। এই প্রাচীন গল্পটিই এবার পুরোনো মদ হিসেবে নতুন বোতলে ঢালা হল। … স্কোরবোর্ডে তখন রান ছিল শূন্য, ম্যাচের ‘দ্বাদশ ব্যক্তি’ পরিচয়ে এক যুবক এগোচ্ছিল ক্রিজ থেকে ফাঁকা প্যাভিলিয়নের দিকে; তার ক্লান্ত, পরাজিত, মন্থর হেঁটে যাওয়াকে সঙ্গ দিয়েছিল নিজেরই প্রেতায়িত দীর্ঘ ছায়া এবং প্রেক্ষাগৃহের ভেতর নীরব সাক্ষী থেকে ছিল আবেগমথিত জনতা। তারা তাদের নিজেদেরই কোনো এক স্নেহশীল দাদা, ভাই, কাকা কিংবা ছেলেকে সেই মুহূর্তে শ্রীযুক্ত তাপস পালের মধ্যে শনাক্ত করতে পেরেছিল।
(চলবে)