১৯৮৩ সালের মার্চ মাস। দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে জোট নিরপেক্ষ দেশগুলির একটি সম্মেলন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন বিশ্বের বহু রাষ্ট্রনায়ক। সেই সময় কিউবার বিপ্লব ভারতীয়দের মধ্যে বহুল আলোচিত একটি ঘটনা। ইন্দিরা গান্ধীর আহ্বানে সেই সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছিলেন কিউবার বিপ্লবের প্রাণপুরুষ তথা কিউবার রাষ্ট্রপতি ফিদেল কাস্ত্রো।
আরও পড়ুন
ভাড়া পাওয়া যায় বইও, কলকাতার ‘অজানা’ দোকানগুলি পাঠকের খিদে মেটাচ্ছে এভাবেই
দিল্লিতে ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গেই এসেছিলেন তাঁর এক বন্ধু। বন্ধুটি রাজনীতির জগতের মানুষ নন। রাষ্ট্রনায়কদের সম্মেলনে তাঁর বিশেষ কিছু কাজ নেই, তাই বন্ধুর কাছ থেকে ছুটি নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন ভারতবর্ষকে দেখতে। এদিকে তিন চারদিন ধরে আর বন্ধুর কোনো খবর নেই। কাস্ত্রো বিশেষ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। চিন্তিত ভারত সরকারও। একজন বিদেশি অতিথির নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িয়ে আছে এক্ষেত্রে। দিল্লির রাস্তায় রাস্তায় টহল নামল পুলিশের। অবশেষে নিরুদ্দেশ হওয়ার চারদিনের মাথায় সেই ভদ্রলোকের সন্ধান পাওয়া গেল দিল্লির জামে মসজিদের সামনে। সেখানে এক গণৎকারকে হাত দেখাচ্ছিলেন তিনি। বেশভূষা দেখে তাঁকে চেনার উপায় নেই। তবু সন্দেহবশত সেই পুলিশ অফিসার জিজ্ঞাসাবাদ করায় খুঁজে পাওয়া গেল।
আরও পড়ুন
সাহিত্যে মিলিয়েছিলেন বাংলা আর ওড়িশাকে, ৯২ বছরে চলে গেলেন যুগলকিশোর দত্ত
মানুষটিকে তখনও সেভাবে কেউ চিনতেন না। যদিও তার আগের বছরই সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। কিন্তু তারপরেও সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশে থাকতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের রহস্য খুঁজে পেতে গেলে যে তাকে কাছ থেকে দেখার প্রয়োজন। সেইসব রহস্যকে গড়ে তুলতেন বাস্তব আর কল্পনার টানাপোড়েনে। তাঁর নাম গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে জাদু-বাস্তবতার জন্ম যাঁর হাত ধরে। লাতিন আমেরিকার সাহিত্যকে সাড়া বিশ্বের মানুষের কাছে জনপ্রিয়ও করেছিলেন তিনি। দেশবিদেশের ৩৭টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর রচনা। একসময় প্রকাশক খুঁজে পেতে ঘাম ছুটে গিয়েছিল তাঁর, আবার ঝড়ের গতিতে বিক্রি হয়েছে তাঁর লেখার কপিরাইট। আসলে তাঁর লেখার মধ্যে একটা নতুন জিনিস ছিল। বাস্তব আর কল্পনার যে যুগলবন্দি তিনি হাজির করেছিলেন, বিশ্বসাহিত্যে এমনটা আগে কেউ করেননি।
আরও পড়ুন
প্রথম গল্প সংকলনেই এল পুরস্কার, সাঁওতালিতে সাহিত্য আকাদেমি কালীচরণ হেমব্রমের
মার্কেজ যদিও মনে করতেন, জাদু-বাস্তবতা তাঁর মৌলিক কোনো আবিষ্কার নয়। বহু আগে থেকেই লাতিন আমেরিকার লোককথায় এই টানাপোড়েন উপস্থিত ছিল। তিনি নিজেও এই শৈলী অর্জন করেছিলেন ছোটবেলায় দিদিমার কাছে রূপকথার গল্প শুনতে শুনতে। কল্পনার জগতের সেইসব কাহিনিতে উঠে আসত লাতিন আমেরিকার বাস্তব জীবন। ঠিক সেভাবেই বাস্তবকে তুলে ধরতেন মার্কেজ। শৈশবের স্মৃতিকে কল্পনার সুতোয় গেঁথে তাই তৈরি করে ফেললেন আস্ত একটা শহর। সেই শহরের নাম 'মাকন্দ'। মার্কেজের 'স্বপ্নে দেখা সেই শহর' আসলে হতে পারে আমার আপনার অথবা যেকোনো মানুষের হারানো স্মৃতির শহর। সেই শহরের ইতিহাস আছে। আর সেই ইতিহাসের সঙ্গে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে সংস্কার-কুসংস্কার, বাস্তব-কল্পনা, যৌনতা-অযাচার আর ফ্যান্টাসি। বাস্তব আর পরাবাস্তবের টানাপোড়েনে পাঠক পৌঁছে যায় এক উপলব্ধির চূড়ায়। ঠিক যেমনটা জীবনানন্দ বলেছিলেন। "স্বপ্ন নয় - শান্তি নয় - ভালোবাসা নয়, হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়"।
আরও পড়ুন
‘ঘুমের দরজা ঠেলে’ এল পুরস্কার, সাহিত্য অকাদেমি পেলেন চিন্ময় গুহ
১৯২৭ সালের ৬ মার্চ উত্তর কলম্বিয়ার এরাকাতাকা শহরে জন্ম মার্কেজের। তারপর তাঁর শৈশবের সময় জুড়ে উথালপাথাল বিশ্বের মানচিত্র। সেইসব রাজনৈতিক উত্থান-পতনের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছিল মানুষের জীবন। সমসাময়িক ঘটনার প্রবাহ তাই দ্রুত আকর্ষণ করে নিল মার্কেজকে। ১৯৪৭ সালে বাবার ইচ্ছায় আইন নিয়ে পড়তে গেলেন। কিন্তু ততদিনে যে তাঁর মন ছুঁয়ে গেছে ফ্রানৎজ কাফকার লেখনী। আর তাঁর 'মেটামরফসিস' উপন্যাসের সেই শুরুর বাক্যটা। "ঘুম থেকে উঠেই গ্রেগস সামসা দেখলো, সে পোকা হয়ে গেছে।" তাই শেষ পর্যন্ত কলম পেষাকেই জীবিকা করে নিলেন। সাংবাদিক হিসাবে কাজ করেছেন একাধিক সাময়িকীতে। বিতর্কেও জড়িয়েছেন বহুবার। তবে কল্পকাহিনি লেখাকেই শেষপর্যন্ত বেছে নিতে হল তাঁকে। অবশ্য আদৌ যদি সেগুলোকে কল্পকাহিনি বলা যায়, তবেই। কারণ প্রতিটা কাহিনির সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে বাস্তবের নানা ঘটনা।
আরও পড়ুন
দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড়ো সাহিত্য পুরস্কারের তালিকায় বাংলার মনোরঞ্জন ব্যাপারী
সাংবাদিকতার পেশায় শেষপর্যন্ত উন্নতি করতে পারেননি। এই পেশার সঙ্গে যেসব নিয়ম-কানুন জড়িয়ে থাকে, মার্কেজ সেসব মানতে পারতেন না। সাংবাদিকতাকে তিনি ইম্প্রেশনিস্ট শিল্প হিসেবে দেখতেই আগ্রহী ছিলেন। বাস্তব ঘটনা মানুষের মনে এবং জীবনে যে অভিঘাত তৈরি করে, খুঁজতে চেয়েছিলেন সেটাই। 'দ্য স্টোরি অফ শিপরেকড সেইলর-'এ তো বাস্তব একটি দুর্ঘটনার মানবিক অভিঘাতকেই হাজির করলেন। মার্কেজ স্মরণীয় হয়ে থেকে যাবেন এইসব কাহিনির জন্যই। মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে যে তিনি উপলব্ধি করে ফেলেছিলেন 'শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা'। আর অবশ্যই তাঁর সবচেয়ে স্মরণীয় কাজ, 'কলেরার দিনগুলিতে প্রেম'।
আরও পড়ুন
নিকারাগুয়া বিপ্লবের প্রাণপুরুষ তিনি, ৯৫ বছরে চলে গেলেন আর্নেস্টো কার্দেনাল
গল্প-উপন্যাস লেখার পাশাপাশি লিখেছেন বহু সিনেমার চিত্রনাট্য। বিশ্বসাহিত্যের আসরে তুলে ধরেছেন কলম্বীয় ভাষাকেও। তবে সাংবাদিকতাকেই চিরকাল শ্রেষ্ঠ পেশা মনে করে এসেছেন তিনি। ১৯৯৯ সালে লিম্ফেটিক ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পর ক্রমশ শক্তি হারিয়ে ফেলতে থাকেন। মাত্র একটি খণ্ড লেখার পর আর এগোয়নি আত্মজীবনী লেখার কাজ। তারপর ২০১২ সাল থেকে ক্রমশ স্মৃতি লোপ পেতে থাকে। মারা গেলেন ২০১৪ সালের ১৭ এপ্রিল। তবে এখনও তাঁর লেখার শৈলী যে সমালোচকদের আশ্চর্য করে। আর সেই শৈলীকে ঘিরে থাকা রহস্যের মধ্যেই বেঁচে আছেন মার্কেজ।
তথ্যসূত্র: সবচেয়ে প্রভাবসৃষ্টিকারী লেখকদের একজন, মানবেন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, কালি ও কলম
রোর বাংলা
মার্কেজের সাক্ষাৎকার, পিটার এইচ. স্টোন, প্যারিস রিভিউ
Powered by Froala Editor