এই সময়টা এলেই আকাশের রং কেমন আপন মনেই বদলে যেতে থাকে। বিশাল বিশাল কংক্রিটের দেওয়াল, হোর্ডিংয়ের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারে সতেজ সবুজ পাতা, ফুলের আবির। অজান্তেই সেই রঙে মিশে যাই আমরা। ‘আজ সবার রঙে রং মেশাতে হবে।’ ইতিহাস, সাহিত্য, সংস্কৃতির আঙিনায় নানা রূপ নিয়ে হাজির হয়েছে দোল। কালিদাস থেকে কালিকাপ্রসাদ— সবারই পরশ পেয়েছে এই উৎসব। রচিত হয়েছে মিলনগাথাও। যেখানে যোগ দিয়েছিলেন মুসলিম মুঘল বাদশাহরাও। দোল বা ‘হোলি’ তাঁদের কাছে সমাজের সবার সঙ্গে একত্রিত হওয়ার উৎসব, সম্প্রীতির উৎসব।
ইসলাম ধর্মে নাকি রং খেলা হারাম! যে রং সবাইকে একসঙ্গে জড়ো করে, আনন্দ দেয়, সেই রং খারাপ কী করে হয়! এই ভাবনা ভেবেছিলেন অনেকেই। ফলত, ভারতে এই নিয়ম বদলে গেল খানিক। ১৮ শতকে বুল্লেহ শাহের লেখায়ও পাওয়া যায় সেই নিয়মের উল্লেখ। কী সেই নিয়ম? নামাজের সময় কোনোভাবে রং খেলা যাবে না। সেটা বাদ দিয়ে, বাকি সময় ‘রং বরসে’…
আরও পড়ুন
বর্ধমানে এই পীরের মাজার তৈরির খরচ দিয়েছিলেন স্বয়ং আকবর
“হোরি খেলুঙ্গি, কাহ বিসমিল্লাহ।
নাম নবি কি রতন চারি,
বুন্দ পড়হি আল্লাহ আল্লাহ”
শুধু কি ১৮ শতক? প্রাচীন আমলের নানা ইসলাম সাহিত্যে, ছবিতে ছড়িয়ে আছে দোলের দৃশ্য। বাস্তবেও আবির রঙে ভরে উঠত রাস্তাঘাট। কৃষ্ণের আমল থেকে দোলের রোমান্টিক-আধ্যাত্মিক মেজাজে মেতেছিল ভারত। ততদিন পর্যন্ত কেবল হিন্দুদের উৎসবই ছিল এটি। এরপর মুসলিম শাসকদের আগমন ঘটে এদেশে। অনেক জিনিস যেমন যুক্ত হয় ভারতের সংস্কৃতিতে, তেমনই এখানকারও সনাতন রীতি আপন করে নেন তাঁরা। ধীরে ধীরে সব মিলিয়ে দোল চেহারা নেয় গণউৎসবের; যা কোনো ধর্ম, জাতির বাঁধ মানেনি। সুফি সাধকদের কাছে এই রং ছিল পবিত্রের। নিজামুদ্দিন আউলিয়া থেকে আমীর খসরু— সুফি লেখায়, সাধনায় এক অন্যতম সুন্দর দর্শন নিয়ে হাজির হয়েছিল হোলি। মনের ভেতরের রামধনু রং-কে সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার এই আকর্ষণকে অস্বীকার কে করবে!
আরও পড়ুন
মুঘল রাজপুত্র পাঠ করবেন উপনিষদ, বেনারস থেকে হাজির হয়েছিলেন পণ্ডিতরা
এটাই শৈল্পিক পর্যায়ে গিয়েছিল মুঘল আমলে। আকবর, জাহাঙ্গির, শাহজাহান— তিন বাদশাহের আমলেই হোলি অন্য উচ্চতায় গিয়েছিল। প্রকৃত অর্থে হয়ে উঠেছিল সামাজিক মিলনের জায়গা। ফুলের পাপড়ি থেকে তৈরি হল লাল, নীল, হলুদ নানা রঙের আবির। নগরবাসী সেজে উঠত সেই ফুলের ছোঁয়ায়। হোলি খেলবে, কিন্তু রং দেবে না; তা-ই কি কখনও হয়?
প্রথমবার ভারতে এসে এই উৎসব দেখে চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল বাবরের। এমন সুন্দর উৎসব যে আগে দেখেননি তিনি! ঐতিহাসিক জাকাউল্লাহের বইতে উল্লেখ আছে সেই সময়ের কথা। সেই যে প্রেমে পড়লেন মুঘলরা… আকবরের আমল থেকে মুঘল রাজপরিবারও অংশ নিল এই খেলায়। ধর্মীয় অনুষঙ্গের কথা মাথাতেও আসেনি তাঁদের। রাস্তায় রাস্তায় রাখা থাকত চৌবাচ্চা; তাতে গোলা থাকত রং। থাকত পিচকারি। সে দৃশ্য কেমন ছিল, তা সেই সময়ের বিভিন্ন চিত্রশিল্পীর ছবি দেখলেই বোঝা যায়। যেন আরও একটি ঈদ অনুষ্ঠিত হচ্ছে রাজপথে! একই রকম পবিত্র, একই রকম সুন্দর। স্বয়ং আকবর প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে আসতেন। প্রজাদের মধ্যেই আবির হাতে মিশে যেতেন। মুছে যেত সমস্ত বেড়াজাল। একই বর্ণনা পাওয়া যায় ‘তুজুক-ই-জাহাঙ্গিরি’তেও। প্রাসাদের ভেতরেই রঙের উৎসবে মাততেন জাহাঙ্গির আর নূরজাহান। এমনকি, সঙ্গীতের মহা আসরও বসত সেখানে।
আরও পড়ুন
২৫০ পেরিয়েছে বয়স, বিলুপ্তির পথে বাংলার প্রাচীন মিষ্টি ‘বাবরসা’
রোমান্টিক ও সৌন্দর্যের পূজারি হিসেবে পরিচিত ছিলেন শাহজাহান। হোলি তাঁকে টানবে না, তা কী করে হয়? লাল কেল্লা সেদিন শুধু ‘লাল’-ই থাকত না। তাঁর সময়ই হোলির নাম হয়েছিল ‘ঈদ-ই-গুলাবি’ আর ‘জশন-ই-আব-পাশি’। সত্যিই তো, এমন মিলনক্ষেত্রেই তো ভগবান, আল্লাহ নেমে আসেন। কিন্তু এই পুরো উদ্যম বন্ধ হয়ে যায় ঔরঙ্গজেবের আমলে। তারপর আবার শুরু হয় বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফরের আমল থেকে। লাল কেল্লার সরকারি উৎসবের তকমা পায় হোলি। শুধু তাই নয়, উর্দু সাহিত্যে তৈরি হয় একটি নতুন জঁরের। আজ যাকে আমরা ‘হোরি’ নামে জানি।
শুধু দিল্লির মসনদই নয়; বাংলা, অযোধ্যা, লখনউ ইত্যাদি নবাবি জায়গাতেও হোলি পূর্ণতা পায় নানা আঙ্গিকে। বাংলা তো সেই চৈতন্যদেবের সময় থেকে দোলে মেতে উঠেছে। এখানে যে ‘ব্রজগোপী খেলে হোরি’… সেই খেলার অংশ হয়ে উঠলেন আলিবর্দি খাঁ, সিরাজদ্দৌলারা। উর্দু কবিতায়, শায়রির ছোঁয়া পড়তে লাগল দোলে। সত্যিই কি সেখানে বিভেদের চিহ্ন ছিল? যে রং, যে আবির মানুষের মুখে হাসি ফোটায়, মিলিয়ে দেয়, তা কী করে ‘হারাম’ হয়? কী করে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর মধ্যে আটকে থাকে সেটা? এভবেই তো ভগবান নেমে আসেন এখানে; যেমন করে আসেন কৃষ্ণ, আল্লাহ। আমীর খসরু নিজেও তো লিখেছেন সেই কথা—
আরও পড়ুন
ঔরঙ্গজেব হত্যা করেছিলেন তাঁকে, মুঘল রাজপুত্র দারা শিকো-র ‘বিলুপ্ত’ সমাধির খোঁজ
“খেলুঙ্গি হোলি, খোয়াজা ঘর আয়ে,
ধন ধন ভাগ হামারে সজনী,
খোয়াজা আয়ে আঙ্গন মেরে”…
Powered by Froala Editor