একসঙ্গে বসে আছেন বেশ কিছু মানুষ। দোকানে চা-ও তৈরি। বেঞ্চের মানুষগুলোর হাতে হাতে যাবে কিছুক্ষণ পরেই। আড্ডার জন্য একদম আদর্শ পরিস্থিতি। কিন্তু কেমন একটা অদ্ভুত নৈঃশব্দ রয়েছে এখানে! কেউ কোনো কথা বলছে না। আসলে সবই হচ্ছে, আড্ডাও চলছে। কিন্তু সবই হচ্ছে ইশারায়। হ্যাঁ, এই মানুষগুলো কথা বলতে পারেন না, শুনতেও পারেন না। কিন্তু ভাষা শুধু এতেই সীমাবদ্ধ থাকে নাকি! ভাষা দিবসের উদযাপন তো এভাবেও হতে পারে। আর সেটাই হচ্ছে বাংলাদেশে…
শুরুটা হয়েছিল ২০০৬ সালে। তখন বাংলাদেশের পাবনা জেলা শহরের রায় বাহাদুর গেটের কাছে বসত চায়ের আড্ডা। মূক-বধির দু-তিনজন মানুষ প্রথমে একত্রে বসে কথা চালাতেন নিজেদের মধ্যে। ধীরে ধীরে সখ্যতা বাড়ে। তখনই এই অভিনব উদ্যোগ নেন তাঁরা। রাস্তায় অপরিচিত মূক-বধির মানুষ দেখলেই ডেকে নিতেন চায়ের দোকানে। আলাপ জমিয়ে দিতেন। সেভাবেই চলছিল। অনেকে ভরসা পেত না প্রথমে। তবে আড্ডার দলটি বহরে বাড়ছিল। ১০ থেকে ২০, তারপর ৩০-এও পৌঁছয় সংখ্যাটা।
আরও পড়ুন
নেই-হাত মধ্যবিত্তদের মসীহা তিনি, স্বল্পমূল্যে কৃত্রিম হাত বানিয়ে কামাল ২৮-এর প্রশান্তর
কিন্তু সমস্যা ছিল একটাই। জায়গাটায় ভিড় লেগেই আছে। অন্যান্য ‘সুস্থ’ মানুষরাও অসন্তুষ্ট হতেন। কাজেই, অন্য জায়গায় চলে যাওয়ার ভাবনা। সুযোগও এল, ২০১১ সালে। পাবনা জেলা শহরেরই এলএমবি মার্কেটে নতুন চায়ের দোকান খুললেন ইয়াকুব আলি নামের এক ব্যক্তি। ভিড় কম, একটু চুপচাপ। এখানেই খুঁজে নিলেন জায়গা। ব্যস, তারপর থেকে আজ অবধি এখানেই বসছেন মানুষগুলো। শব্দ নেই কোনো, তাও পরস্পরের মধ্যে বয়ে যাচ্ছে অক্ষরের স্রোত। তৈরি হচ্ছে সেতু। এই নীরবতার মধ্যেই লুকিয়ে আছে আন্তরিকতা। আজ এই আড্ডার সদস্য সংখ্যা ৫১ জন। কারোর মধ্যে কোনো মন কষাকষি নেই। সব কাজ সেরে, মনের খানিক শান্তির জন্য পাবনার ইয়াকুবের এই চায়ের ঠেকই তাঁদের আশ্রয়।
শুধু দাবি একটাই, সরকার এবার একটা ঘর যেন করে দেন তাঁদের সংগঠনের জন্য। সদস্যরা সকলেই মধ্যবিত্ত, গরিব। বাংলাদেশের সমস্ত জেলায় একটি করে সংস্থা থাকলেও, পাবনায় একটিও নেই। এবার সেটারই আশায় এই মানুষগুলো। ভাষা দিবসের দিনে, এই মানুষগুলোর ‘ভাষা’ও উঠে আসুক আমাদের মধ্যে। সমস্ত ভাষারই উদযাপন চলুক সারা বছর ধরে।