এ যেন খড়ের গাদায় সূচ খোঁজার মতো অবস্থা! বছরের পর বছর কেটে যাচ্ছে, সঙ্গে এতগুলো লোকের পরিশ্রম, অর্থ; কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। মমির কাছে পৌঁছনোর দরজা কিছুতেই পাওয়া যাচ্ছে না। প্রায় সবারই ধৈর্য হারিয়ে যাচ্ছে, উল্টোদিকে ফান্ড তুলে নেওয়ার কথা বলছেন প্রধান পৃষ্ঠপোষক। কিন্তু হাওয়ার্ড কার্টার নাছোড়বান্দা। এত বছর কাজ করছেন, মিশর নিয়ে এত পড়াশোনা করেছেন। আরও খানিক চেষ্টা করে দেখা যাক না! হাওয়ার্ডের এই মনোভাবই পরবর্তীতে তৈরি করে ইতিহাস। মাটির বুক থেকে বেরিয়ে আসে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক আবিষ্কার; ফ্যারাও তুতেনখামেনের মমি। অবশ্য শুধু মমিই নয়, সেই সঙ্গে উঠে আসে বহু মিথ, গল্পকথা আর ‘অভিশাপ’। উঠে আসে মৃত্যুও…
আরও পড়ুন
৩০০০ বছরের পুরনো মমি থেকে উদ্ধার কণ্ঠস্বর, চমক বিজ্ঞানীদের
প্রাচীন মিশরের এই বালক রাজার সঙ্গে হাওয়ার্ড কার্টার যেন জড়িয়ে গেছেন অঙ্গাঙ্গীভাবে। মিশরের প্রতি টান যে গড়ে উঠেছিল ছোটো থেকেই। বাবা ছিলেন চিত্রশিল্পী। সেখান থেকেই আঁকায় হাতেখড়ি হাওয়ার্ডের। এটা সেই সময়ের কথা, যখন ব্রিটিশরা সবে মিশর দখল করেছে। সেখানকার ইতিহাস, প্রাচীন ধন-দৌলত সমস্ত কিছুর খবর উঠে আসছে সামনে। বিশেষ করে প্রাচীন মিশরের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব গবেষণা নিয়েই উৎসাহ সব মহলে। হাওয়ার্ডও উৎসাহিত হল, মিশর নিয়ে বেড়ে উঠল পড়াশোনা। সেই সময়ই, ১৭ বছর বয়সে মিশরে পা দেওয়া তাঁর।
আরও পড়ুন
গতজন্মে ছিলেন মিশরের পুরোহিত, দেখা পেয়েছেন দেবতারও – এক মহিলা ‘জাতিস্মর’-এর কাহিনি
যেন ভবিতব্যই ছিল সবটা। ধীরে ধীরে বিভিন্ন ফ্যারাও ও রাজপরিবারের মমি উদ্ধারের অভিযানে সঙ্গী হতে লাগলেন তিনি। নিজের তাগিদেই কাজ শিখতে লাগলেন। তরুণ এই ছেলের কাজে চমৎকৃত হলেন সবাই। কিন্তু কোথায় যেন সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না হাওয়ার্ড। নিজে থেকে স্বাধীনভাবে নতুন কিছু আবিষ্কার করতে চাইছিলেন। একসময় সেই সুযোগ এলও। বলা ভালো, জীবনের মোড় ঘোরানো প্রস্তাব। ব্রিটিশ ধনকুবের লর্ড কারনারভন একটি অভিযানের পরিকল্পনা করছিলেন। তখনও পর্যন্ত একটি বিশেষ মমির খোঁজ পাননি ঐতিহাসিকরা। যার মমি, তাঁর সম্পর্কে রহস্যের কোনো শেষ নেই। ফ্যারাও তুতেনখামেন। মাত্র ৯ বছর বয়সে যিনি মিশরের সিংহাসনে বসেছিলেন। মারাও গিয়েছিলেন অল্প বয়সেই, মাত্র ১৯ বছর বয়সে। মিশরের এই ‘বালক-রাজা’র মমি খুঁজতেই নিয়োগ করা হল হাওয়ার্ড কার্টারকে।
আরও পড়ুন
মরুভূমির মধ্যে তিমির জীবাশ্ম! আরেক বিস্ময় পিরামিডের দেশে
কিন্তু ওই, মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। ১৯০৭ সালে খোঁজা শুরু হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। তারপর আবার শুরু হয় খননকাজ। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও সমাধির কাছে পৌঁছনোর মূল ফটকটি পাওয়া যাচ্ছিল না। মনে রাখতে হবে, সেই সময় এত আধুনিক যন্ত্র, প্রযুক্তি কিছুই ছিল না। সেই অবস্থায় থেকে এরকম কাজ করা খুবই কঠিন ও পরিশ্রমের। এদিকে অধৈর্য হয়ে পড়ছিলেন কারনারভন। কিন্তু আশ্বাস দিলেন কার্টার। তাঁর বিশ্বাস, পারবেন তিনি। আর হলও সেটা। সাল ১৯২২। নভেম্বরে কার্টারের এক কর্মী হঠাৎই খুঁজে পান একটি গুপ্ত সিঁড়ি। যা নেমে গেছে মাটির নিচে। অভিজ্ঞ কার্টার বুঝতে পারলেন, এটাই সেই সময়। এটাই রহস্যে পৌঁছনোর রাস্তা। আস্তে আস্তে মোড়ক খোলে বিংশ শতকের উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারের। সস্ত্রীক লর্ড কারনারভনও চলে আসেন মিশরে। ২৬ নভেম্বর, ১৯২২। হাওয়ার্ড কার্টারের দল পৌঁছে গেল মমির মূল চেম্বারের সামনে। ভেতরে অপেক্ষা করছে অনন্ত বিস্ময়। সঙ্গে অগুনতি সোনাদানা, হিরে-জহরত।
আরও পড়ুন
৪০০০ বছর আগেকার ‘রহস্যময়’ কফিন পাওয়া গেল মিশরে
এরপরই শুরু হয় তুতানখামেনের মমিকে নিয়ে একের পর এক কাহিনি। সাধারণত মিশরের পুরনো মমির ঘরগুলি অক্ষত ছিল না। ডাকাতের দল ভেতরের সোনাদানা লুট করে চলে গেছে, এরম ঘটনাও দেখা গেছে। কিন্তু সেইদিক থেকে সম্পূর্ণ ব্যাতিক্রম ছিল তুতানখামেনের কক্ষ। একটিও ধনরত্ন খোয়া যায়নি। কেউ খুঁজেও পায়নি, পেলেও হাত লাগায়নি। কিন্তু কেন, এটাই প্রশ্ন ছিল হাওয়ার্ড কার্টারের। তখনই সামনে এল হায়রোগ্লিফিকে লেখা কিছু কথা। ‘তুতানখামেনের সমাধিতে যদি কেউ প্রবেশ করে, তবে তার জীবনে নেমে আসবে অভিশাপ।’ অবশ্য এই কথাটি প্রাচীন মিশরে অত্যন্ত প্রচলিত ছিল। কারণ তাদের কাছে মৃত্যুই জীবনের শেষ ছিল না। রাজা একটু ঘুমিয়ে আছেন, ঠিক জেগে উঠবেন— তাই সবরকম আয়োজন করা হত পিরামিডের প্রকোষ্ঠের ভেতর। কিন্তু তুতানখামেনের সমাধি না ছোঁয়ার কারণ কি এই সাবধানবাণী?
আরও পড়ুন
১৮,০০০ বছর পরেও অবিকল দেহ, বরফের নিচ থেকে উদ্ধার কুকুরছানা
৩০০০ বছর সারকোফ্যাগাসে থাকার পর তুতেনখামেনের মমিকে প্রকাশ্যে আনা হয় ১৯২৩ সালের এপ্রিলে। এই ঐতিহাসিক ঘটনার ঠিক ছয় মাস পর কায়রোতে আচমকা মারা যান লর্ড কারনারভন। শোনা যায়, একটি মশার কামড়ে নাকি মৃত্যু হয় তাঁর। এও বলা হয়, যখন মারা যান, ঘরের সমস্ত আলো নাকি নিভে গিয়েছিল। আরও আশ্চর্যজনক ঘটনা হল, যবে কারনারভন মারা যান, সেইদিনই লন্ডনের বাড়িতে মারা যায় তাঁর পোষা কুকুরটি। এখান থেকেই শুরু হয় মিথের। এর পরপরই যেন মৃত্যুমিছিল লেগে যায়। এই অভিযানের আরেক পৃষ্টপোষক জর্জ হঠাৎই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ইভলিন হোয়াইট, যিনি তুতানখামেনের সমাধির খননকাজে যুক্ত ছিলেন, তাঁর দেখা দেয় মানসিক বিষণ্ণতা। আত্মহত্যা করেন তিনি। প্রতিটা মৃত্যুর সঙ্গে যেন জড়িয়ে ছিল মিশর আর কিং তুত। অবশ্য হাওয়ার্ড কার্টারের কোনো ক্ষতি হয়নি। শুধু পরে লিম্ফোমা ধরা পড়ে তাঁর। সেই রোগেই ১৯৩৯ সালের ২ মার্চ মারা যান তিনি। বয়স ছিল ৬৪ বছর।
আরও পড়ুন
৩০০০ বছরের পুরনো মমি থেকে উদ্ধার কণ্ঠস্বর, চমক বিজ্ঞানীদের
তুতানখামেনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রহস্য। তিনি কীভাবে মারা গিয়েছিলেন, সেটা নিয়েও ঐতিহাসিকদের মধ্যে রয়েছে নানা সংশয়। পরে তাঁর মমি উদ্ধারের পরের ঘটনাগুলো নিয়েও হয়ে গেছে বহু বিতর্ক। অনেকের মতে, এরকম কিছুই হয়নি। যারা মারা গিয়েছিলেন, তাঁদের স্বাভাবিক মৃত্যুই হয়েছিল। কিন্তু প্রাচীন মিশরের অভিশাপকেও এড়িয়ে যাননি অনেকে। এইসব রহস্য, রোমাঞ্চের মাঝে কোথাও যেন ফিকে হয়ে যায় হাওয়ার্ড কার্টারের দীর্ঘ অধ্যাবসায়ের কথা। যে অসীম ধৈর্য নিয়ে, প্রায় কোনো সুবিধা না নিয়ে কাজ করে গেছেন, সেটা সবার কাছে শিক্ষণীয়। তাঁর এই অভিযান এবং আবিষ্কার ইতিহাসে চিরকাল অমর হয়ে থাকবে। যেমন অমর হয়ে থাকবে অভিযানের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা কাহিনিগুলো…
ঋণ- ন্যাশনাল জিওগ্রাফি
Powered by Froala Editor