(প্রথম পর্ব)
এ আর নতুন করে বলার কী! যে-কোনো শহর যেমনভাবে বেড়ে ওঠে, ঠিক তেমনই বেড়ে ওঠে তার রাস্তাঘাট, তৈরি হতে থাকে নতুন নতুন বাসরুট। কলকাতা থেকে মফঃস্বল, এক অপরিচিত ক্ষণস্থায়ী যৌথ পরিবারকে চার বা ছ’চাকায় সন্তুষ্ট করে যায় এ-সমস্ত বাসরুট। তাদের কোনোটির বয়স ৯০ বছর হলে কোনোটির ৭০। কিন্তু মজার বিষয় বাসস্টপ। এগুলির নাম সাধারণত হয়ে আসে কাছাকাছি বড় ল্যান্ডমার্কের নামে, আর তা অনুপস্থিত হলে বেছে নেওয়া হয় বাড়ির রং, অথবা পুরোনো মিষ্টির দোকান, যেমন লালবাড়ি অথবা কালিকা মিষ্টান্ন। কিছু ক্ষেত্রে সিনেমাহলও। আজ থেকে দু’দশক আগেও, মানুষের ছুটির দিনের, ভালো সময়ের সাক্ষী কিছু সিঙ্গল স্ক্রিন। এত বছর পেরিয়ে তার ৯০ শতাংশই বেঁচে নেই আর। অথবা মাল্টিপ্লেক্স হয়ে হারিয়েছে মৌলিকতা। ধুঁকে ধুঁকে চলছে কেউ কেউ। তবু মুছে ফেলা এত সহজ নয়। লোকমুখে এখনও তারা টিকে থাকছে, থাকবেও আগামী কয়েক দশক। গত দশ বছরের ইন্টারনেট বিপ্লবে সিনেমা অনেকাংশে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে হলের স্ক্রিন থেকে। বেড়েছে মোবাইল অ্যাপলিকেশন, পাইরেসিও। ধীরে কমে এসেছে হলে ছবি দেখার প্রবণতা। ফলে শহর মফঃস্বলের হলগুলি দ্রুত হারে বন্ধ হয়ে গেছে গত কয়েক বছরে। কেবল যেটুকু রয়ে গেছে তা, সিনেমা হলের নামে স্টপেজগুলি। হয়তো বহুদিন এভাবেই অস্তিত্ব রয়ে যাবে তাদের।
আরও পড়ুন
অভিনয় করেছেন রবীন্দ্রনাথ, দর্শকাসনে নেতাজিও – থামল কলকাতার রক্সি সিনেমা হলের যাত্রা
ধর্মতলা কলকাতার অন্যতম প্রাচীন জনবসতি। এক Talkie-টিভ এলাকাও। সেখানে পায়ে পায়ে ইতিহাস। অলিগলিতে ঘুরছে রিল। বাংলা থেকে ইংরাজি, ইংরাজি থেকে বাংলা ছবি। কীভাবে শুরু হয় এইসমস্ত হল? কীভাবে তারা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে? কেমন ছিল সেসব হলের পথচলা? কবে এবং কেনই বা বন্ধ হয়ে গেল যাত্রা? এসব নিয়ে এক সামান্য হেঁটে আসা মাত্র। ধর্মতলার চারটি পুরোনো হলকে বেছে নেওয়া হল। চ্যাপলিন, জ্যোতি, মেট্রো ও গ্লোব সিনেমা। কোনোটি শুরু থেকেই এক নামে, কোনোটির মালিকানার সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে নামও। তবু সর্বশেষ নামটিই রয়ে গেছে। এলাকার মাথার উপর ছাতার মতো ফুটে উঠেছে সেই নাম। এবার ঢুকে পড়া যাক গল্পে।
চ্যাপলিন
যে কম্পানিতে প্রপবয়ের কাজ দিয়ে শুরু হয়েছিল জীবন, ব্যবসায় নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে সেই কোম্পানিই কিনে নিলেন মুম্বাইবাসী এক পারসি ব্যবসায়ী। সাল ১৯০৭। প্রতিষ্ঠা হল কলকাতার প্রথম স্থায়ী শো হাউস ‘এলফিনস্টোন পিকচার হাউজ’। বহু বাঁক পেরিয়ে একসময় এই হলের নাম হয়ে দাঁড়ায় চ্যাপলিন। কলকাতার বিখ্যাত চ্যাপলিন সিনেমা, যার উপস্থিতি বাড়ির অসুখে ভোগা বয়স্ক মানুষটির মতো। জীবিত থাকা অবস্থায় তেমন কদর না পেলেও মৃত্যুর পর বোঝা যায় অস্তিত্বের শূন্যতা।
আরও পড়ুন
বাংলার পাশাপাশি, একাধিক হিন্দি সিনেমাতেও অভিনয় করেছিলেন ছবি বিশ্বাস
ভারতীয় চলচ্চিত্রের এক পরিচিত নাম জামশেদজি ফ্রেমজি ম্যাডান। পারসি এই ব্যক্তির জন্ম ১৮৫৬ সালে মুম্বাই শহরে। শৈশবে বম্বে রিক্ল্যামেশন ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হওয়ায় বহু টাকা ডোবে তাঁর পিতার, ফলত লেখাপড়ায় ইতি টানেন জামশেদজি। সংসারের অভাব ও আর্থিক অসহায়তার কারণে ১৮৬৮ সালে ১২ বছর বয়সে প্রপ বয় হিসাবে তিনি যোগ দেন ‘এলফিনস্টোন ড্রামাটিক ক্লাব’-এ। ১৮৮২ সাল পর্যন্ত এই কাজ করে যাওয়ার পর অবশেষে এসব ছেড়ে তিনি রওয়ানা হন করাচি। নিজের ব্যবসা দাঁড় করানোর স্বপ্ন বুকে নিয়ে। ঠিক একবছরের মাথায় সফল ব্যবসায়ী ম্যাডান করাচী থেকে কলকাতা যাত্রা করেন। কলকাতায় মিলিটারি ক্যান্টনমেন্টে কন্ট্রাক্টর হিসাবে ব্যবসা করেন কিছু বছর। তারপর লাভের টাকা দিয়ে তিনি তাঁর প্রথম কর্মস্থান ‘এলফিনস্টোন থিয়েটার কোম্পানি’ কিনে বসেন। এরপর শুরু হয় এক অন্য যাত্রা। ১৯০২ সাল নাগাদ কলকাতা ময়দানে তাঁবু খাটিয়ে তিনি শুরু করেন বায়োস্কোপ শো দেখানো। যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পায় এই প্রচেষ্টা।
আরও পড়ুন
সিনেমায় চশমা-পরা ব্যোমকেশ, সত্যজিতের ‘চিড়িয়াখানা’ দেখে অখুশি শরদিন্দু
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বাংলা থিয়েটার জগতে প্রভূত উন্নতি দেখা যেতে থাকে। অর্থে ও কাজে স্বর্ণযুগ বললেও কম বলা হবে এই সময়কে। ১৯১৯ সালে চলচ্চিত্র প্রযোজনার ব্যবসায় নামেন জে এফ ম্যাডান। ‘ম্যাডান থিয়েটার্স লিমিটেড’ নামক একটি যৌথ উদ্যোগ কোম্পানি স্থাপন করেন তিনি। ভারতীয় থিয়েটার হাউজে তখন বিরাট প্রভাব এই কোম্পানির। সে’বছরই তাঁদের প্রযোজনায় তৈরি হয় বাংলা ছবি ‘বিল্বমঙ্গল’।
আরও পড়ুন
তখনও ছাত্রাবস্থা পেরোননি জসীম উদ্দীন, বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিতা পড়ানো শুরু হল তাঁর
১৯২৩ সালে জে এফ ম্যাডানের মৃত্যুতে ম্যাডান থিয়েটার্স লিমিটেড-এর কর্ণধার হয়ে আসেন তাঁর তৃতীয় সন্তান জে জে ম্যাডান। ১৯২০-র দশকের শেষ দিকে সাফল্যের শিখরে পৌঁছায় ম্যাডানের কোম্পানি। সেই মুহূর্তে প্রায় ১২৭টি সিনেমা হল ছিল এই কোম্পানির অধীনে। যা প্রায় গোটা দেশের বক্স অফিসের অর্ধাংশ বললে খুব ভুল হবে না। এরপরও প্রায় ১৯৪০ সাল পর্যন্ত বাংলার বহু উল্লেখযোগ্য ছবির প্রযোজনা করে গেছে ম্যাডান থিয়েটার্স।
আরও পড়ুন
সিনেমার গোটা দলকে রেঁধে খাওয়াতেন বৃদ্ধা, সমস্ত সঞ্চয় তুলে দিল কিশোরী: আড়ংঘাটার রূপকথা
কেটে গেছে বেশ কয়েক দশক। ধীরে কমে এসেছে ম্যাডানের প্রতাপ। বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগ এগিয়ে গিয়েছে অবসরের দিকে। দর্শক হারিয়েছে বহুমাত্রায়। সিনেমা হলের ধারণাও বদলে গেছে অনেকাংশে। শহর জুড়ে তৈরি হতে শুরু করেছে তুলনামূলক আধুনিক হলগুলি। এমতাবস্থায় কলকাতা পৌরসংস্থা ১৯৮০ সালে প্রায় ভগ্নদশায় অধিগ্রহণ করে এলফিনস্টোন থিয়েটার হাউজ। হলের নাম বদলে হয় চ্যাপলিন। তারপর বেশ কিছুদিন চলে এই হল। অবশেষে ২০০০ সালের কাছাকাছি গিয়ে বন্ধ হয়ে স্ক্রিনিং। পড়ে থাকা অবস্থায় ক্ষয়ে যেতে থাকে হলটি। ২০১৩ সাল নাগাদ কলকাতা পৌরসংস্থার সিদ্ধান্তে অবশেষে ভেঙে ফেলা হয় হলটিকে।
আরও পড়ুন
বোন প্রতীতির শাড়িতে সিনেমার স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন ঋত্বিক, চলে গেলেন তিনিও
ধর্মতলার এই অংশ এখনও চ্যাপলিন সিনেমার নামে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। বহু সিনেমা হলই বন্ধ হয়েছে এর আগে তবু চ্যাপলিনের মাটিতে মিশে যাওয়া যেন বেশ গুরুতর আঘাত দিয়েছে কলকাতাকে। বছর ছয়েক সে ক্ষতে মাটি ভরতে ভরতে এখন উঁচু বাজার মাথা তুলেছে। চ্যাপলিন তবু নীরব, হেসে চলেছে, হাসিয়ে চলেছে আর বজায় রেখেছে নামের মাহাত্ম্যও।