একসময় দৃষ্টিহীনদের কাছে অক্ষরপরিচয়ও সম্ভব হত না। তাদের জগৎ ছিল শুধুই শব্দময়। তারপর লুই ব্রেইলের হাত ধরে দৃষ্টিহীনদের জন্য তৈরি হয়েছে বিশেষ ধরনের অক্ষর। কিন্তু এই ব্রেইল সিস্টেমের সাহায্যে কিছু বইপত্র লেখা ছাড়াও যে আরও নানা কিছু করা যায়, সেকথা আর কতজনই বা ভেবে দেখেছেন। ব্রেইল সিস্টেমের তেমনই এক ব্যতিক্রমী ব্যবহারের সাক্ষী থাকল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। ইউজি আর্টস বিল্ডিং-এর দেয়ালে গ্রাফিটি লিখলেন ছাত্রছাত্রীরা, তাও ব্রেইল সিস্টেমে।
আরও পড়ুন
দেশের সেরা দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিরোপা পেল কলকাতা ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
গ্রাফিটি, প্রতিবাদের একটি জনপ্রিয় হাতিয়ার। অবদমিত কথা রঙে রেখায় অক্ষরে সেজে ওঠে, আর বিরাট বিরাট দেয়ালে লেখা সেইসব গ্রাফিটির বার্তা অনায়াসেই পৌঁছে যায় মানুষের কাছে। ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলিতে তো বটেই, এমনকি ভারতবর্ষেও গ্রাফিটির জনপ্রিয়তা প্রচুর। বিশেষত ছাত্র আন্দোলনের সময় নানাধরনের শৈল্পিক গ্রাফিটির সাক্ষী থেকেছে শহর কলকাতাও। তবে এসব গ্রাফিটির একটি দোষ ছিলই। এইসব প্রতিবাদের আবেদন পৌঁছত কেবল দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষের কাছে। দৃষ্টিহীন মানুষের কাছে পৌঁছনো যায়, এমন গ্রাফিটির কথা বহুকাল কেউ ভেবেই দেখেননি।
আরও পড়ুন
নেতাজি-পরিবারের সদস্যা থেকে সংসদীয় রাজনীতি – কৃষ্ণা বসু’র প্রয়াণে একটি অধ্যায়ের ইতি
ইউরোপ আমেরিকাতেও ব্রেইল সিস্টেমে লেখা গ্রাফিটির ইতিহাস বেশ নতুন। বিগত দশকে বিভিন্ন দেশে এই ধরনের গ্রাফিটি বেশ জনপ্রিয়ও হয়ে উঠেছে। ফ্রান্স, রাশিয়া, আমেরিকার মতো দেশে ব্রেইল গ্রাফিটি লেখার বিশেষ অনুষ্ঠানও আয়োজন করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের রাজ্যে এরকম গ্রাফিটি এতদিন ছিল না। সম্ভবত আমাদের দেশেও না। এই প্রথম ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখা হল গ্রাফিটি, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোগে।
এই উদ্যোগের সঙ্গে জড়িয়ে মূলত ছ'জন পড়ুয়ার একটি দল। তারা প্রত্যেকেই ইংরেজি বিভাগের স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় বর্ষে পাঠরত। 'লিটারেচার অ্যান্ড মারজিনালিটি' কোর্সের অন্তর্গত বিশেষ মডিউল 'ডিসএবিলিটি অ্যান্ড লিটারেচার' এর জন্য প্রেজেন্টেশন তৈরি করতে গিয়ে তারা এই ব্রেইল গ্রফিটির কথা ভাবে। তাদের উৎসাহ দেন অধ্যাপক ঈশান চক্রবর্তী। ৬জন পড়ুয়ার এই বিশেষ দলটির নাম ঠিক হয়, 'গ্রাফিটি জয়েন্ট'। প্রেজেন্টেশনের জন্য তারা হাতে কলমে কিছু একটা করার কথাই ভাবে। আর এই ভাবনা থেকেই ইউজি আর্টস বিল্ডিংএর দেওয়ালে জন্ম নিল রাজ্যের প্রথম ব্রেইল গ্রাফিটি। সম্ভবত দেশেরও প্রথম।
আরও পড়ুন
‘পরিচয়’ পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীতে ছিলেন এই বাঙালি বিজ্ঞানী, ছাপ রেখেছেন রাজনীতিতেও
এই উদ্যোগ ইতিমধ্যে স্যোসাল মিডিয়ায় বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। ছাত্রদের এই উদ্যোগ নিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন অধ্যাপক ঈশান চক্রবর্তী নিজে। এইধরনের উদ্যোগ শিক্ষাকে পাঠ্যপুস্তক থেকে বাইরে বের করে জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেয় বলে মনে করছেন তিনি। পড়ুয়াদের একজন, শুভ্রদীপ চ্যাটার্জি প্রহরকে জানালেন, "আপাতত ইন্টারনাল পরীক্ষার প্রেজেন্টেশনের একটি অংশ হিসাবে এই কাজ হলেও আমরা মনে করছি আগামীতে এরকম কাজ খুব দরকার। আর আমরা নিজেরাও এরকম উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করব।"
আরও পড়ুন
দৃষ্টিহীনতা বাধা নয়, ছ’দশক ধরে স্বপ্নের পৃথিবী বুনছেন নরেন্দ্রপুরের ছাত্ররা
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউজি আর্টস বিল্ডিংএ লেখা ওই গ্রাফিটিতে ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখা হয়েছে 'সাবঅলটার্ন'। প্রান্তিক মানুষদের প্রতিবাদের ভাষায় যে শব্দ মিলেমিশে যায়। এই প্রতিবাদ তো কেবল দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষের প্রতিবাদ হয়ে থাকতে পারে না। প্রতিবাদের স্বর তো পৌঁছে যাওয়া চাই প্রতিটি মানুষের কাছে। সেই ভাবনা থেকেই অভিনব এই উদ্যোগের শুরু।
আরও পড়ুন
স্পষ্ট ও নির্ভুল বাংলা তাঁর, ভালোবাসেন রসগোল্লা-ইলিশ – জাপানি তরুণীর ভিডিও ভাইরাল
আসলে, সংখ্যাগরিষ্ঠের ব্যবহৃত অক্ষর দ্বিমাত্রিক। তাতে আর একটি মাত্রা যোগ করলেই প্রত্যেকের হয়ে উঠতে পারে। শিল্প-সাহিত্য থেকে জীবনের প্রতিটা উপাদান, এভাবেই আমাদের সকলের হয়ে উঠুক। প্রহরের পক্ষ থেকে এমন প্রয়াসকে অভিনন্দন।