বাড়িতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করে বাজারে বিতরণ, উদ্যোগে ব্যারাকপুরের তরুণরা

বাজার, স্টেশন চত্বরে সার দিয়ে বসে আছেন বিক্রেতারা। কেউ সবজি, ফল বিক্রি করছেন; কেউ বা মাছ। কেউ আবার চা-রুটির দোকান দিয়েছেন। প্রত্যেকে নিজের মতো কাজ করে যাচ্ছেন। খদ্দেরের সঙ্গে তৈরি হচ্ছে টাকা-পয়সার সম্পর্ক। কিন্তু তাঁদের হাতে দস্তানা নেই, মুখে মাস্ক নেই। দোকানে বা ঠেলাগাড়িতে উঁকি মারছে না স্যানিটাইজারের বোতল। অথচ তাঁরাও তো মানুষ! করোনার থাবা যে তাঁদের ওপরেও পড়তে পারে। তখন কে দেবে পছন্দের মাছটি; টাটকা মুসম্বি? সেই ভাবনা থেকেই উত্তরায়নের বাদামতলা বাজারে ওই মানুষগুলোর হাতে বিনামূল্যে তুলে দেওয়া হল হ্যান্ড স্যানিটাইজার। ঘরোয়া পদ্ধতিতে তৈরি করে এই কর্মকাণ্ডে অংশ হলেন কচিকাঁচারাও।

আরও পড়ুন
আবিষ্কার মাত্র ৫৪ বছর আগে, অখ্যাত নার্সের তৈরি ‘ফর্মুলা’ই আজ রুখছে সংক্রমণ

ব্যারাকপুর থেকে ইছাপুর যাওয়ার মাঝখানে এই উত্তরায়ন এলাকা। আশেপাশে রয়েছে আমবাগান, সংগ্রামগড়-সহ আরও ছোটো বড়ো তল্লাট। সেখানেই অবস্থিত এই বাদামতলা বাজার। ওই এলাকার সবচেয়ে বড়ো বাজার। প্রতিদিন অনেক মানুষের ভিড়ে জমজমাট থাকে ওই অঞ্চল। ক্রেতাদেরও সঙ্গে বিক্রেতাদেরও নানা রকমফের। সম্প্রতি করোনা ভাইরাসের রেশ পৌঁছে গেছে সেখানেও। প্রত্যেকে নিজেদের মতো সুরক্ষার ব্যবস্থা করে নিচ্ছেন। কিন্তু বাজারে মাছ-মাংস, ফল, আনাজ নিয়ে বসা মানুষগুলো? ওদের সচেতন করবে কে? ওদের অনেকেরই আর্থিক সঙ্গতিও তেমন নয় যে দোকানে গিয়ে মাস্ক আর স্যানিটাইজার কিনে আনবেন। অনেকে নামও শোনেননি এইসব জিনিসের। তাঁদের সুরক্ষা দেবে কে? ওঁরা যদি আক্রান্ত হন, বা চলে যান; তাহলে তো আমাদের রোজকার জীবনযাত্রারও অনেক ক্ষতি!

আরও পড়ুন
বিনামূল্যে রেশন, ৫ লক্ষ টাকার স্বাস্থ্য বিমা – করোনা-রোধে সদর্থক ভূমিকা প্রশাসনের

এমন ভাবনা থেকেই এগিয়ে আসে উত্তরায়ন, সংগ্রামগড়ের মানুষরা। তরুণ, কিশোর, কচিকাঁচা থেকে শুরু করে প্রৌঢ়— সবাই মিলে সচেতনতার উদ্যোগ শুরু করেন নিজেরাই। ঠিক করেন, প্রত্যেকে কিছু কিছু টাকা দিয়ে ফান্ড জড়ো করবেন। সেটা ঠিক হলে, নিজেরাই বাড়িতে শুরু করেন হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরির কাজ। এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কাঁচড়াপাড়া কলেজের জুলজির ছাত্র অভীক বিশ্বাস। তিনি প্রহরকে জানালেন, “অ্যালকোহল জোগাড় করাটাই অনেক মুশকিল। অনেক ভিডিও, আর কলেজের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলার পর ল্যাবের কেমিক্যাল সাপ্লায়ারের থেকে অ্যালকোহল জোগাড় করি। তারপর আমাদের অনেকের বাড়ির অ্যালোভেরা গাছ থেকে ভেতরের জেল নিয়ে তৈরি করি এই স্যানিটাইজার। এই পুরো পদ্ধতিটাই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ও নিয়ম মেনে করা হয়। যে যে যন্ত্র ব্যবহার করি, সব কিছু আগে থেকেই পরিশোধিত করা হয়েছিল। তারপরেই ৩০ মিলি’র প্রায় ২০০টি বোতলে ভরে আমরা বাজারে যাই। ওই ‘সবজি কাকু’, ‘ফল কাকু’-দের মধ্যে বিলি করে দেওয়া হয় সেসব।” এই সমগ্র কর্মকাণ্ডের একটি নামও দেওয়া হয়— ‘না-করোনা’।

আরও পড়ুন
বন্ধ রেস্টুরেন্ট-বার-মিউজিয়াম-চিড়িয়াখানা, জমায়েত এড়াতে সিদ্ধান্ত রাজ্য প্রশাসনের

অনেকেই জানতেন না, কী করে এই স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হয়। তাঁদেরকে রীতিমতো হাতে ধরে শেখানো হয় ওখানেই। কয়েকজনের আবার দারুণ ভয়! সেই ভয়, জিজ্ঞাসা কাটিয়েই পুরো কর্মকাণ্ডটি শেষ করা হয়। সেই সঙ্গে সবাইকে বলা হয় সতর্ক থাকতে, কোনোরকম গুজবে কান না দিতে। শুধু বাদামতলা বাজার নয়, পলতা স্টেশনের ধারে যারা রুটি, চা নিয়ে বসেন, তাঁদের কাছেও পৌঁছে দেওয়া হয় স্যানিটাইজার। আর এই পুরো উদ্যোগের সিংহভাগে ছিল তরুণ ও ছোটো বাচ্চারা। নিজেদের পড়াশোনা সামলে, শুধু সমাজের ওই প্রয়োজনীয় মানুষগুলোকে বাঁচাতে তাঁরা নেমে পড়েছিলেন ময়দানে। নিজেরা তো মানছেনই, আশেপাশের অসহায় মানুষগুলোও যাতে সুরক্ষিত থাকে; সেটারও একটু দায়িত্ব নেওয়া।

আরও পড়ুন
বিদেশের সঙ্গে যোগ নেই, করোনায় আক্রান্ত দমদমের বৃদ্ধ – কী অপেক্ষা করছে ভবিষ্যতে?

সম্প্রতি যাদবপুর, প্রেসিডেন্সি-সহ বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পড়ুয়ারা হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করে রাস্তায় বিলি করছেন। রিকশা, অটোচালক থেকে শুরু করে দোকানি— সবাইকেই দেওয়া হচ্ছে এগুলো। এভাবেই মানুষ মানুষের কাছে আসে; ভরসা দেয়। এই দুর্দিনে সেটাই হোক আমাদের সাহসের মন্ত্র।

ছবি ঋণ – রোদ্দুর মিত্র