পেশায় রসায়নবিদ, ২৬০০০ শব্দ নিয়ে লিখে ফেললেন ‘চলন্তিকা’ অভিধান

ছেলেটির ডাকনাম ফটিক। বর্ধমানে দিব্যি বেড়ে উঠছিল সে। বাড়ির দ্বিতীয় ছেলে, খানিক আদরের ছিল তার ওপর। খেলনাপাতিও পেয়েছে বিস্তর। কিন্তু সেসব আস্ত থাকলে তবে তো! খেলনা হাতে নেওয়ার মিনিট খানেকের মধ্যেই সেটা কয়েক টুকরো হয়ে যেত। এ তো আচ্ছা দস্যি ছেলে তো! টাকার ধ্বংস এভাবে কেন। কিন্তু ফটিকের মনে যে প্রশ্নগুলো তৈরি হচ্ছে, তার উত্তর দেবে কে? কী করে চলছে ওই ছোট্ট ইঞ্জিন? এইরকম নানাবিধ প্রশ্নের নিয়তি ছিল খেলনা ভাঙায়। যেন আবিষ্কারের নেশায় মেতেছে ফটিক। পরবর্তীকালে এই ছেলেই যে বিজ্ঞানকে পাথেয় করবে, তাতে আর আশ্চর্য কোথায়! তবে শুধুমাত্র বিজ্ঞানের একজন সাধক, বা পরবর্তীতে বেঙ্গল কেমিক্যালের একজন রসায়নবিদ হিসেবে মনে রাখেনি মানুষ। এসবের সঙ্গে ‘ভুশুণ্ডির মাঠে’ও যাতায়াত ছিল অব্যাহত। ফটিকের লেখার ‘ধারে’ যুগ যুগ ধরে মুগ্ধ বাংলা। চিনতে পেরেছেন ফটিককে? হ্যাঁ, তিনিই কলিযুগের বাঙালি ‘পরশুরাম’; রাজশেখর বসু।

আরও পড়ুন
দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড়ো সাহিত্য পুরস্কারের তালিকায় বাংলার মনোরঞ্জন ব্যাপারী

বড়ো ছেলের নাম শশীশেখর। এবার দ্বিতীয় ছেলেও কি আরেক ‘শেখর’ হবে, নাকি অন্য কিছু? মহারাজ লক্ষ্মীশ্বর সিংহের এই প্রশ্নের জবাব যেন সঙ্গেই ছিল চন্দ্রশেখর বসু’র। রাজার সামনেই, তাঁরই আশীর্বাদে ছেলের নাম রাখলেন ‘রাজশেখর’। ১৮৮৫ সালে দ্বারভাঙ্গার রাজ স্কুলে ভর্তি হন। একমাত্র বাঙালি ছাত্র ছিলেন সেখানে। কাজেই, হিন্দি ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গেও একটা যোগ তৈরি হয়েছিল ছোটোবেলায়। তবে বাংলা সাহিত্য তাঁকে দুটি নামে চেনে। রাজশেখরের ‘পরশুরাম’ হওয়ার কাহিনিটিও আকস্মিক, প্রয়োজনের জন্যই। কোনো ধার্মিক অনুষঙ্গ ছিল না এর পেছনে। বাড়িতে আড্ডা বসত ভাইদের; সঙ্গে থাকতেন ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার সম্পাদক জলধর সেন, শৈলেন সাহা প্রমুখ। তখন রীতিমতো লিখছেন রাজশেখর। তখনও তাঁর কোনো বই প্রকাশিত হয়নি। গল্প তো লিখছেন, কিন্তু যত আপত্তি, সংকোচ নিজের নামে প্রকাশ করায়। তাহলে তো ছদ্মনাম দরকার। কিন্তু কী নাম দেওয়া যায়? সেই খানেই হঠাৎ উঠে এল পরশুরামের নাম। ব্যস, সেটাই থেকে গেল। কালে কালে এই নামই রাজশেখর বসু’র সঙ্গে জুড়ে যায় সারাজীবনের মতো।

আরও পড়ুন
পাকিস্তানের বুকে বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড, আজও উজ্জ্বল তার গরিমা

১৮৯৭-তে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। সেই ছোটো থেকেই বিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ। যতই সাহিত্য ভালোবাসুন, বিজ্ঞানের টান কি সহজে যায়? রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় স্নাতক হন। তারপর রসায়ন নিয়ে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় একেবারে প্রথম হন। এরপরই আইন পড়ার শুরু। এবার ক্ষান্ত হলেন রাজশেখর বসু। তিনদিন আদালতে গেলেন। তারপর যেন হাঁফ ছাড়লেন। না, এই আইন-আদালত-মোকদ্দমা তাঁর দ্বারা হবে না। এরপর ১৯০৩-এ সাক্ষাৎ হয় আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সঙ্গে। ব্যস, জীবনের সঙ্গে জুড়ে গেল বেঙ্গল কেমিক্যাল। প্রথমে রসায়নবিদ হিসেবে যোগ দিয়ে, অল্প কয়েক বছরেই ম্যানেজার হয়ে গেলেন। তাঁর গুণে, ব্যক্তিত্বে সবাই মোহিত; তটস্থও। অবসর নিলেও, মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ছিলেন বেঙ্গল কেমিক্যালের টেকনিকাল অ্যাডভাইসার।

আরও পড়ুন
কোরান নয়, অস্ট্রেলিয়ার প্রাচীন মসজিদে লুকিয়ে আছে বাংলা কবিতার বই!

রাশভারী প্রকৃতির মানুষ। কিন্তু লেখায় ছিল ভরপুর মজা, ব্যঙ্গ। ‘বিরিঞ্চি বাবা’র কথাই ভাবুন না! সাধু-সন্ন্যাসীর বেশে কত ভণ্ডরা ঘুরে বেড়ায় চারপাশে। তখনও যেমন এটা সত্যি ছিল, এখনও। সেই বিষয়টাকেই হাসির মোড়কে সামনে এনেছেন রাজশেখর বসু। স্বয়ং প্রফুল্লচন্দ্রের উক্তি ছিল, “এই বুড়া বয়সে তোমার গল্প পড়িয়া হাসিতে হাসিতে chocked হইয়াছি।” রাজশেখরের লেখার ভক্ত ছিলেন আরও একজন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেখানেও ছিল মুক্ত হাওয়া। একবার লেখায় মুগ্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি এত রস পাও কোথায়?” রাজশেখরের তৎক্ষণাৎ উত্তর, “আপনি ভুলে যাচ্ছেন, আমি রসায়নের লোক!”

আরও পড়ুন
৯৬ বছর আগে, বাংলায় শব্দবিজ্ঞানের বই লিখেছিলেন শান্তিনিকেতনের শিক্ষক

‘শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড’ প্রকাশিত হওয়ার পর সবাই রীতিমতো চমকে উঠেছিল। প্রথম লেখা ছাপা হচ্ছে যখন, তখন তাঁর বয়স ৪২ বছর! রাজশেখর, তথা পরশুরামের তৈরি করা একের পর এক চরিত্র বাংলা সাহিত্যে অনন্য স্থান করে নিয়েছে। তবে শুধু গল্পই নয়। রামায়ণ-মহাভারতের অনুবাদ ও অভিধান রচনাও তাঁর জীবনের অন্যতম বড়ো কাজ। নিজের সম্পর্কে একটি সভায় রাজশেখর বসু বলেছিলেন, “আসলে আমি আধা মিস্ত্রি, আধা কেরানি। অভিধান তৈরি ও পরিভাষা নিয়ে নাড়াচাড়া মিস্ত্রির কাজ। রামায়ণ মহাভারত অনুবাদ কেরানির কাজ।” ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উৎসাহে ও অনুরোধে ‘চলন্তিকা’ অভিধানের কাজ শুরু করেন। সঙ্গে পান সুরেশচন্দ্র মজুমদার ও শৈলেন্দ্রকৃষ্ণ লাহাকেও। লক্ষ্য ছিল একটাই, বাংলা বানানের একটা আধার তৈরি করা। সেখানে স্থান পায় পরিভাষাও। এই বিশাল কাজে মতামতের জন্য চলে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, প্রমথ চৌধুরী, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতো মানুষদের কাছে। অবশেষে ২৬০০০ শব্দ নিয়ে প্রকাশিত হয় অভিধান ‘চলন্তিকা’। পরে এই শব্দসংখ্যা বেড়ে হয় ৩০০০০। সেই সঙ্গে ছিল পরিভাষার সমাহারও। রবীন্দ্রনাথ যোগ করলেন মন্তব্য, “এতদিন পর বাংলা ভাষার অভিধান পাওয়া গেল।”

আরও পড়ুন
সাহিত্যে মিলিয়েছিলেন বাংলা আর ওড়িশাকে, ৯২ বছরে চলে গেলেন যুগলকিশোর দত্ত

এর সঙ্গেই চলেছিল রামায়ণ-মহাভারতের অনুবাদ। নানা জটিলতা পেরিয়ে, সহজ সরল ভাষায় পরিবেশিত করেছিলেন তিনি। এই কাজটা করতে গিয়ে যাতে আসল আখ্যানটির কোনো ক্ষতি না হয়, সেটাও মাথায় ছিল। সব নিয়েই একটা আকর্ষণীয় জগত তৈরি করেছিলেন রাজশেখর বসু। তাঁর ভাষায়, ‘কেরানির কাজ’ই সম্পন্ন হল।

আরও পড়ুন
১৫৭ বছর আগে, শুধুমাত্র নারীদের জন্য প্রকাশিত বাংলা পত্রিকা, চলেছিল দীর্ঘ ছয় দশক

এত প্রজ্ঞা, জ্ঞান, তীক্ষ্ণ রসবুদ্ধি নিয়ে যিনি চলতেন, তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে বারবার আছড়ে পড়েছে ঝড়-ঝাপটা। খুব অল্প সময় অবধি জীবিত ছিলেন তাঁর জামাই। যবে মারা যান, সেইদিনই তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে চলে যান মেয়েও। ১৯৪২-এ মারা যান স্ত্রী মৃণালিনী দেবীও। অসম্ভব দুঃখ, একাকিত্ব— কিন্তু তার মধ্যেও অসম্ভব একটা জোর। সব ভুলে থাকতে হবে। একটি চিঠিতে রাজশেখর লিখছেন, “মন বলছে, নিদারুণ দুঃখ, চারিদিকে অসংখ্য চিহ্ন ছড়ানো, তার মধ্যে বাস করে স্থির থাকা যায় না। বুদ্ধি বলছে, শুধু কয়েক বছর আগে পিছে।” এই নিয়মেই চলেছেন নিয়মনিষ্ঠ মানুষটি। তার মধ্যে থেকেই সামলেছেন কাজ, লেখা, অনুবাদ। রাজশেখর বসু এমনই। গাম্ভীর্য ওপরে; ভেতরে বয়ে যাচ্ছে এক অনন্ত প্রসারিত মন…

ঋণ-
১) আনন্দবাজার পত্রিকা, 'পার্শিবাগান থেকে হাবশীবাগান'
২) নেট থেকে প্রাপ্ত অন্যান্য তথ্য

More From Author See More

Latest News See More